Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

একা এবং কয়েকজন

পরিবারের অবহেলায় নয়, দায়মুক্ত জীবনের খোঁজেও এখন বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। লিখছেন সোমা মুখোপাধ্যায়পরিবারের অবহেলায় নয়, দায়মুক্ত জীবনের খোঁজেও এখন বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। লিখছেন সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৭ ০১:৩৪
Share: Save:

বেসিনের কলটা গড়বড় করছে। মিস্ত্রিকে খবর দিতে হবে। শোওয়ার ঘরের এসি থেকে জল পড়ছে। এসি-র ‘অ্যানুয়াল মেনটেনান্স’-এর টাকা জমা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। সেটাও সামলাতে হবে। এ ছাড়াও রোজের বাজার, সপ্তাহান্তের জিনিসের ফর্দ তৈরি, কাজ কম নয়।

ক্লান্তি ক্রমশ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে মণিমালাকে। ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সে নিজের মতো করে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে তাঁর। মনে হয়, অনেক তো হল। এখন কি নিজের মতো গান শুনে, বই পড়ে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে কাটাতে পারেন না তিনি? কিন্তু সংসারের দায়দায়িত্ব পালন করবে কে? আমেরিকায় থাকা ছেলে-বউমাকে এই কথাগুলো বলে লাভ নেই। মণিমালার ধারণা, তারা এটা বুঝবে না। বরং প্রসঙ্গটা তুললেই ‘‘প্লিজ তুমি এখানে চলে এসো মা’’ বলে ফের তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলবে।

টানা মাস কয়েক খোঁজখবরের পর তাই মণিমালা সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেন। আপাতত তাঁর আস্তানা কলকাতার উপকণ্ঠে এক বৃদ্ধাশ্রম। যে দিন কথা হল, দুপুরের শো-এ সিনেমা দেখে ফিরে চা খাচ্ছিলেন। বললেন, ‘‘এখানে একা থাকার অস্বস্তিটা নেই। নিজেকে নিজের দায়দায়িত্ব নিতে হয় না। সবটাই এখানকার লোকজনেরা করেন। অসুখ হলে ডাক্তার দেখানোর দায়িত্বটাও এঁদের। এমনকী কোনও সিনেমা দেখতে যেতে চাইলে সেই ব্যবস্থাটাও এঁরাই করে দেন।’’

বৃদ্ধাশ্রম বলতেই যে জীর্ণ বাড়ি, মলিন ঘরদোর আর ছলছল চোখের ছবি ভাসে, পরিস্থিতি এখন বহু ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বদলে গিয়েছে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেলেমেয়েরা ফেলে রেখেছে বৃদ্ধাবাসে, এ যদি বাস্তবের একটা দিক হয়, তা হলে অন্য দিকও আছে। বহু বৃদ্ধ মানুষ, তাঁরা একা হন বা দম্পতি, বৃদ্ধাবাসকেই বেছে নিচ্ছেন তাঁদের বার্ধক্যের ঠিকানা হিসেবে। কোনও ক্ষেত্রে বাড়িতে একা থাকার নিরাপত্তার অভাব, আবার কোথাও ছেলে-বউমা বা মেয়ে-জামাইয়ের সংসার থেকে দূরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার ইচ্ছা, অনেককেই এই বিকল্প ভাবাচ্ছে।

‘দহন’ ছবিতে সুচিত্রা মিত্র অভিনীত চরিত্রের কথাই ভাবা যাক। সংসারে অবাঞ্ছিত ছিলেন না। তবুও নিজের মতো করে বাঁচার স্পৃহাটা তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দিয়েছিল। ক্রমশ এই সংখ্যাটা বাড়ছে। মনোরোগ চিকিৎসক আবীর মুখোপাধ্যায় যেমন বললেন, ‘‘ক্রমশ ‘ওল্ডএজ ক্যাপিটাল’ হয়ে উঠছে এই শহর। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই ভিন রাজ্যে বা ভিন দেশে গিয়ে থাকছে। বাবা-মা থেকে যাচ্ছেন এখানেই। ছেলেমেয়েরা অবহেলা করছে, তা নয়। তারা পাশে থাকতে চেয়েও শিক্ষাগত বা পেশাগত কারণে পেরে উঠছে না। বাইরে থেকে তারা খোঁজ নিচ্ছে। টাকা পাঠাচ্ছে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের লজিস্টিক সাপোর্টটা দিয়ে উঠতে পারছে না। অনলাইনে ফোনের বিল মেটানো সম্ভব, কিন্তু আচমকা শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখানো কী ভাবে সম্ভব?’’

তা হলে উপায়? বিকল্প উপায় হিসেবে একাধিক সংস্থা তৈরি হয়েছে, যারা শারীরিক সমস্যায় চটজলদি হাজির হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লে যদি একা থাকা মানুষটি কাউকে খবর দিতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর কবজিতে ২৪ ঘণ্টা লাগিয়ে রাখা হচ্ছে একটি ব্যান্ড বা ঘড়ির মতো জিনিস, যেখানে চাপ পড়লেই খবর পৌঁছে যাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। তারা তৎক্ষণাৎ টিম পাঠাবে।

কিন্তু অসুস্থতার বাইরে যে জীবন, সেখানে কে সঙ্গ দেবে? রোজকার বেঁচে থাকাকে দায়হীন, নির্ভার, নিশ্চিন্ত করে তোলা যাবে কী ভাবে? কী ভাবে ব্যবস্থা করা যাবে সঙ্গীর? এই প্রশ্ন থেকেই ‘হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম’-এর ভাবনাকে ব্যবহার করতে চাইছে বহু প্রতিষ্ঠান। তারা গড়ে তুলছে বৃদ্ধাবাস। দক্ষিণ কলকাতার এমন একটি বৃদ্ধাবাসের কর্ণধার জানালেন, তাঁদের কাছে থাকার খরচ বেশি। সাধারণ ভাবে উচ্চবিত্তরাই সেটা পারেন। কিন্তু টাকা বেশি হলেও স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা তাঁরা নিশ্চিত করতে চান। একই দাবি উত্তর ২৪ পরগনার এক বৃদ্ধাবাসের মালিকের। বাগান ঘেরা বাড়ি। নিজের মতো করে সময় কাটানোর সুযোগ, এমন নানা বিজ্ঞাপনী প্রতিশ্রুতি রয়েছে তাঁদের। আশ্চর্যের বিষয় হল, টাকা বেশি হলেও এ সব জায়গায় ঘর কিন্তু ফাঁকা থাকছে না। আবেদন করলে বছর দুয়েক অপেক্ষা করতে হতে পারে, এমনও বলা হচ্ছে।

দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অঞ্চলের একটি বৃদ্ধাবাসের আধিকারিক জানালেন, তাঁদের কাছে ঠাঁই পাওয়ার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, এমন নজিরও আছে। সুভাষগ্রামের একটি বৃদ্ধাবাস জানাল, প্রতি দিন অন্তত সাত-আটজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা তাঁদের পরিবারের লোকেরা যোগাযোগ করেন। সকলকেই জানাতে হয়, ‘ঠাঁই নাই’। রাজারহাটের এক বৃদ্ধাবাস কর্তৃপক্ষ জানান, কেউ যোগাযোগ করলে তাঁরা আবেদনপত্র জমা দিয়ে রাখতে বলছেন। আবেদনপত্রের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৭০০ ছাড়িয়েছে!

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ‘জেরেন্টোলজি’ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বয়স্ক মানুষদের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক নানা বিষয় নিয়ে চর্চাকেই বলে জেরেন্টোলজি। চিকিৎসক মহলের একটা বড় অংশ মনে করেন, মানুষের গড় আয়ু যতই বাড়ুক, জেরেন্টোলজিস্টের অভাবে এ দেশে বয়স্ক মানুষের সমস্যা বহু ক্ষেত্রেই অধরা রয়ে গিয়েছে। হৃদরোগ চিকিৎসক সুনীলবরণ রায়ও মনে করেন, সমাজ বা সন্তানেরা যে খুব বেশি নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে তা নয়, আসলে পরিস্থিতিটাই এমন যে চাইলেও সকলে একসঙ্গে থাকা যাচ্ছে না। সেই কারণেই বয়স্কদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি হওয়া খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধাবাস অন্যতম বিকল্প ঠিকই। তাঁর মতে, ‘‘পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিথ্যা আশ্বাসে কেউ তাঁদের ভোলাচ্ছে কি না, আর্থিকভাবে ঠকাচ্ছে কি না সেই নজরদারিটাও জরুরি। কিছু কিছু বিষয়ে বয়স্করা তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করে ফেলেন। সেই বিশ্বাসের সুযোগ যাতে কেউ না নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে আগেভাগে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্বটা কিন্তু নিতে হবে পরিজনদেরই।’’

যাচাই করে নিন

• বৃদ্ধাবাসের লাইসেন্স রয়েছে কি না

• কত দিনের পুরনো, এলাকার মানুষের ধারণা কেমন

• পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ রয়েছে কি না

• পুরনো আবাসিকদের অভিজ্ঞতা কেমন

• সঞ্চয় সংক্রান্ত তথ্য জানতে কর্তৃপক্ষ বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে কি না

• ডাক্তারের ব্যবস্থা আছে কি না

• খাওয়াদাওয়ার মান কেমন

• ঘরের দরজা এবং আসবাব বয়স্কদের ব্যবহারের পক্ষে সুবিধাজনক কি না

• আবাসিকের সংখ্যা অনুযায়ী শৌচাগারের সংখ্যা পর্যাপ্ত আছে কি না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE