Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সেই সব বিয়েবা়ড়ি

ঘটক। ভিয়েন। কাগজপাতা টেবিল। শুরুর পাতে কুমড়োর ছক্কা। নাপিতের নষ্ট ছড়া। নহবতে সানাইবাদক। ফেলে আসা বিয়েবাড়িতে ঢুকলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তীবিয়ে শব্দটার মধ্যেই কেমন রিমঝিম ছিল। লজ্জা-আনন্দ-ভয় ইত্যাদির বিবিধ মশলা মেশানো। বালক বয়সে, বালক-বালিকা সম্মেলনে একটু পাকা বালিকা অপেক্ষাকৃত কাঁচা বালককে প্রশ্ন করত ‘বাটা’ বানানটা কী বল তো? পুজোয় চাই নতুন জুতোর পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনের সুবাদে বাটা খুবই পরিচিত নাম। ছেলেটি বলেই দিতে পারত— বিএটিএ। মেয়েটি এবং অন্যরা তখন সমস্বরে বলত, ‘‘এম্মা, কী অসভ্য... বিয়েটিয়ে বলছে!’’

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

বিয়ে শব্দটার মধ্যেই কেমন রিমঝিম ছিল। লজ্জা-আনন্দ-ভয় ইত্যাদির বিবিধ মশলা মেশানো।

বালক বয়সে, বালক-বালিকা সম্মেলনে একটু পাকা বালিকা অপেক্ষাকৃত কাঁচা বালককে প্রশ্ন করত ‘বাটা’ বানানটা কী বল তো?

পুজোয় চাই নতুন জুতোর পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনের সুবাদে বাটা খুবই পরিচিত নাম। ছেলেটি বলেই দিতে পারত— বিএটিএ। মেয়েটি এবং অন্যরা তখন সমস্বরে বলত, ‘‘এম্মা, কী অসভ্য... বিয়েটিয়ে বলছে!’’

বিয়েটিয়ের মধ্যে একটা আলোছায়া আছে, সেটা বালক বয়েসেই বোধগম্য হত। কিশোরী দিদিদের পারস্পরিক ফিসফাসে শুনতাম, ‘‘জানিস, চম্পাদিদিকে দেখতে এয়েছিল।’’

এই সব চম্পাদি, মায়াদি, মঞ্জুদিরা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠলে ওদের ধিঙ্গিপনা বন্ধ হয়ে যেত। বাড়িতে লাজুকলতা হয়ে বসে থাকতে হত।

ছেলেরা রোজগারপাতি করলেই ‘পাত্র’ হয়ে ওঠে। ওদের অবশ্য লজ্জাভাব দেখাতে হয় না, তবে আমার কাকা-মামাদের বিয়ের কথা উঠলেই বলতে শুনেছি, ‘‘আমি বিয়ে করব না।’’ অন্ততপক্ষে, ‘‘এখন বিয়ে-ফিয়ে করব না।’’

বাংলায় অনুকার শব্দে তুচ্ছার্থে ‘ফ’ ব্যবহার হয়। বউ-টউ বললে বউকে যতটা তুচ্ছ করা যায়, বউ-ফউ বললে আরও বেশি। মদটদ খাওয়ার তুলনায় ‘মদফদ’ খাওয়া আরও খারাপ।

যাই হোক, বিয়েফিয়ে হয়ে যেত এবং বেশ ক’দিন আগে থেকেই বোঝা যেত, বাড়িতে বিয়ের ফুল ফুটতে চলেছে। এক্কেবারে ‘ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রুম শুনে লাগে খটকা, ফুল ফোটে?...’

হ্যাঁ, বিয়ের ফুল নিঃশব্দে ফুটত না। চ্যাঁচামেচি, ঠাট্টা-মশকরা, ঝগড়াঝাটি, নাপিতের ছড়া, সানাইয়ের পোঁ, শাঁখের ভোঁ, হাকাহাকি, ডাকাডাকি এরকম নানা শব্দ সমন্বয়ে বিবাহকার্য সমাধা হত ষাট-সত্তর দশকেও— যখন ক্যাটারিং প্রথা চালু হয়নি, চালু হয়নি বিভিন্ন প্যাকেজ। সম্প্রতি কাগজে দেখলাম, কনের পিঁড়ি ধরার লোকও প্যাকেজে পাওয়া যাচ্ছে।

ফুল ফুটলে ভ্রমর বসে। বিয়ের ফুলে ঘটক। বাড়ির ছেলেরা অর্থ-রোজগেরে আর মেয়েরা ‘সোমত্থ’ হলেই গোলচশমার বুড়োরা হাজির হত। নাকে নস্যি, হাতে খাতা। অমুক বাড়ির তমুক বাড়ির বংশ পরিচয়, কুলুজি ব্যাখ্যা করত। তারপর পাত্রীর গুণপনা।

পাত্রীর গুণাবলির মধ্যে রাঁধাবাড়া, সেলাইফোঁড়াই তো বড়াই করে বলা হতই, ‘হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতে পারে’— এটা হল এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাকটিভিটি।

মামার বাড়িতে আমার এক মামাতো দিদি প্রাণপণে তিনটি গান প্র্যাকটিস করত— ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে’, ‘কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী’ আর ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে’। রবীন্দ্র-নজরুল-শ্যামাসঙ্গীত। সকালবেলা গান প্র্যাকটিস হয়ে গেলে মামিমা ওর মুখে দুধের সর মাখিয়ে দিত। দিদি এর পর রান্নাঘরে গিয়ে ঝিরিঝিরি ডুমোডুমো, ফালি ফালি তরকারি কোটা প্র্যাকটিস করত।

আমার জন্ম দেশভাগের বছর পাঁচেক পর। কিন্তু জ্ঞান হবার পরই বুঝতে পেরেছিলাম আমার গুরুজনরা ওদের শরীর-সত্তায় ফেলে আসা গ্রাম বহন করে চলেছেন শামুকের মতো। পাত্র পরিচয়ে বলা হত ‘করিমপুরের অমুক চক্রবর্তীর বড় হিস্যার তমুক চক্রবর্তীর মাইজ্যা পোলা’। এই মাইজ্যা পোলা হয়তো থাকে যাদবপুর কিংবা বিডন স্ট্রিটে।

বিয়ের চিঠিতেও লেখা হত— সোনাচাকার অমুকের পুত্রের সহিত বাবুপুরের তমুকের কন্যা... ইত্যাদি। এই সব সোনাচাকা-বাবুপুর গ্রামগুলোর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই আর, শুধুই স্মৃতির সম্পর্ক। আর স্মৃতির সম্পর্কেই বেঁচে ছিল কিছু শব্দাবলি।

বিয়ের দিন এগিয়ে এলে বাড়িতে যে আত্মীয়স্বজনরা আসতেন, ওঁদের বলা হত নায়রী। ‘নাও’ হল নৌকা। খালবিল নদীর দেশে ওঁরা নৌকাতেই তো আসত। তাই নায়রী। এঁরা ‘মোলা’ বাঁধতেন— মানে মোয়া। গুড় জ্বাল দিয়ে মুড়ির মোয়া তৈরি করে টিনে ভরা হত। অতিথি-অভ্যাগতের জন্য এটাই ছিল জলখাবার।

আমার ছোট কাকার বিয়ের কথা মনে আছে। ১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। বাবার কাকিমা-মামিমা-মাসিমা সব এসেছিলেন। একটা হই হই ব্যাপার। দুই ঘরের ভাড়াবাড়িতে এত লোক কী ভাবে থাকত ভেবে পাই না। মেঝেতে ঢালা বিছানা।

বাবার এক মামিমা ছিলেন। চাঁদপাড়ায় থাকতেন বলে আমরা বলতাম চাঁদপাড়ার দিদিমা। উনি এই নায়রী সমাবেশে গান গাইতেন। দু-একটা গান এখনও মনে আছে।—

আমরা কুসুম মেয়ে লো

বাপে আমার দিল বিয়া

বুড়া জামাই দেইখা গো

কথা কয়না বার্তা কয়না

বইয়া বইয়া থাকে লো।

নীচে ছিল কলের জল। টালার। ওই অন্ধকার-অন্ধকার কলঘরটাই যেন যমুনা। ওঁরা নিজেদের মধ্যে গাইতেন—

ললিতা-বিসকা চম্প মালতিকা

বিন্দে বিনোদিনী আয় লো

আয় লো চিত্ররেখা চল সবে মিলে

যমুনার কূলে চল লো।

সে সময় বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল। এর আগে হত মেনু প্রণয়ন ও খরচ-চর্চা। দইটা মোল্লার চক থেকে আনতে পারলে খরচ কম, বনগাঁ থেকে কাঁচাগোল্লা। পাতিপুকুরে মাছ সস্তা, নাকি মানিকতলা বাজারে — এ নিয়ে মতভেদ।

এক এক জন এক-এক বিষয়ে স্পেশালিস্ট থাকতেন। প্রচুর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শবদেহ সৎকারে বিশেষজ্ঞ যেমন থাকেন, বহু বিয়ে পার করিয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞরাও থাকেন। ওঁরাই ঠিকঠাক বলতে পারেন— কত লোকের জন্য কী পরিমাণ চাল-ডাল-মাছ-মিষ্টি আনতে হবে।

তখন ভোজবাজিতে ‘খাইয়ে’ লোকের সংখা ছিল খুব। কুড়ি পিস মাছ কিংবা চল্লিশটা রসগোল্লা উদরস্থ করার লোক অপ্রতুল ছিল না। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা ওড়িশার দেশীয় পাচকদের সঙ্গে গূঢ় পরামর্শ করতেন। পাচক ঠাকুর অভয় দিতেন— ‘‘কিছি ভাবনা করন্তু নাহি, মুহ মারি দেবি।’’ মানে, এমন কিছু ব্যবস্থা করা যাতে ‘মুখ মেরে দেওয়া যায়’। হতে পারে সেটা পোলাওতে ডালডা ঘি-এর আধিক্য, কিংবা সন্দেশ পরিবেশনের আগে খুব বেশি মিষ্টি দেওয়া দরবেশ পরিবেশন।

ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছে শুনেছি, বিয়েবাড়িতে ওঁরাই রান্নাবান্না করতেন। বেশি লোকের রান্না করতে পারেন, এমন দু-চারজন মহিলা ঠিক পাওয়া যেত। কড়াই নামাবার জন্য ‘দেওর’ বা ‘জামাই’ জাতীয় ব্যাটাছেলের দরকার হত।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গের বিয়ে বাড়িতে লুচি-পোলাও-কোর্মার চল ছিল না। ভাত হত। শেষ পাতে পায়েস দেওয়া হত। ছোটবেলায় আমিও দেখেছি অঢেল পায়েস বালতি থেকে বড় হাতায় পাতে ঢেলে দেওয়া হত, গরমকালে পায়েসের সঙ্গে আমও দেওয়া হত। আম চিপে পায়েসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে নিমন্ত্রিতরা সুরুৎ সুরুৎ শব্দে পায়েস খেতেন, কব্জি বেয়ে রস গড়াত। এটাকেই প্রকৃত অর্থে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া বলে। বাঙালবাড়ির বিয়েতে মেনু হিসেবে কুমড়োর ঘ্যাঁট, এমনকী মানকচুও থাকত।

ঘটি বাড়ির মেনু ছিল আলাদা। বিয়েবাড়ির ভোজ-এ লুচিই থাকত। সঙ্গে ছোলার ডাল, শাক ভাজা, কখনও কুমড়োর ছোকা ও ছ্যাঁচড়া। ডাঁটাওলা বেগুনভাজা থাকত বেগুনের সময়। মাছের কালিয়া, কখনও পোলাও, খাসির মাংস, দই, দরবেশ, রসগোল্লা বা সন্দেশ। মোটামুটি প্যাটার্নটা এরকমই।

বড়লোকের বাড়ি মেনু নিশ্চয়ই আলাদা রকম। চিত্রা দেব কৃষ্ণনগরের মহারাজ সৌরীশ চন্দ্র রায়ের ‘পাকা দেখা’ অনুষ্ঠানের একটা মেনু পেয়েছিলেন। ওখানে দেখায়— পাঁচ রকমের পোলাও, মাছের আট রকম পদ। যেমন রুই পেটি, ভেটকি ফ্রাই, রুই দমপোক্ত, কই পাতুরি, চিংড়ি মালাইকারি, ভেটকি ক্রুকেড, দই মাছ, মাছের অম্বল।

মাংসের পদ পাঁচ রকম। মুরগির মাংস বিবর্জিত। উচ্চবর্ণ হিন্দু বাড়িতে সাধারণত মুরগির মাংস ঢুকত না। নিরামিষ তরকারির ছিল বারোটা পদ। কয়েকটা বলি। কুমড়োর হুসেন শা, লাউ রায়তা, ফুলকপির জামাইভোগ, ফুলকপির মোগলাইকারি, বাঁধা কপির বুক ধড়ফড়ি, ফুলকপির রোস্ট, পাঁপড় কারি, মোচার চপ, বাঁধাকপির মির্জাপুরী, আলুর জয়হিন্দ।

সে সময় (১৯৪২ থেকে ১৯৫৭) নানা রকমের ‘জয়হিন্দ’ হত। কলকাতার একটা দোকানে ‘জয়হিন্দ’ সন্দেশ সে দিনও পাওয়া যেত। সেই বরফি সন্দেশের তিনটি স্তরে তিনটি রং থাকত। গেরুয়া, সাদা, সবুজ।

চিত্রা দেব শেষ পাতের মিষ্টির যে তালিকা দিয়েছেন— তাতে দেখি দিগনগরের দেদো মন্ডা, স্বরূপগঞ্জের পানতোয়া, মুড়াগাছার ছানার জিলাপি, বর্ধমানের সীতাভোগ, বহরমপুরের ছানাবড়া, বেলডাঙ্গার মনোহরা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া, দ্বারিকের গোলাপ সন্দেশ, ও কালাকন্দ, নবদ্বীপের বেদানাবোঁদে, শান্তিপুরের নিখুতি, কালীগঞ্জের রসকদম্ব...

ঠাকুরবাড়ির বিয়েতেও পদের বাহার ছিল। রবীন্দ্রনাথও মেয়েদের বিয়েতে বহু রকম পদ রেখেছিলেন। মহেন্দ্রনাথ দত্ত বিয়ের ভোজের ব্যাপারে ওঁর শৈশবস্মৃতির কথায় লিখেছেন— বড় বড় লুচির সঙ্গে আলুনি কুমড়োর ছক্কা দিত। আলুনি মানে নুন ছাড়া। সম্ভবত লবণ না দিলে খাদ্যবস্তু গোঁড়া ব্রাহ্মণদেরও খাওয়া চলে, এমন একটা রীতি ছিল বলেই ‘আলুনি’ রাখা হত।

মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘‘কলাপাতার কোণে একটু নুন দিত। সে আলুনি কুমড়া এখনও বড় মিষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে। সে রান্নার পাকা হাত আর নাই এখনকার কুমড়ার ঘণ্ট যেন রাবিশ। তারপর আসিত কচুরির সরা। এখন সেটা উঠে গেছে। কড়াই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকোগজা, মতিচূর এই রকম সরাতে থাকিত। অন্য খুরিতে সন্দেশ থাকিত। পেনেটির সুপো সন্দেশ খুব বিখ্যাত ছিল। তারপর আসিত ক্ষীর, দৈ। খাজা দিয়ে ক্ষীর খাওয়া হইত। ইহাকে ক্ষীরখাজা বলিত। তখনও রাবড়ি ওঠেনি। রাবড়ির প্রচলন লক্ষ্ণৌতে হয়। রসগোল্লাও প্রচলিত হয়নি। ক্রমে ক্রমে শাকভাজার আবির্ভাব হইল। পরে পটলভাজা বাহির হইল। আর বিশেষ উন্নতি হইল না। তারপর ইংরাজি পড়ার ঠেলায় নুন দেওয়া ছোলার ডাল ও নুন দেওয়া আলুর দম প্রকাশ পাইলেন এবং আলুনি ঠান্ডামূর্তি কুমড়ার ছক্কা গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। ক্রমে সরা সাজানো লোপ পাইল।’’

মহেন্দ্রনাথ দত্তের শিশুকাল মানে ১৮৭০-৭২ সাল ধরা যেতে পারে। মহেন্দ্রলালের স্মৃতিচারণায় দেখা যায়— ‘‘ভোজবাড়িতে যখন মাছ এল, তখন জাতধর্ম গেল গেল রব উঠেছিল। গোঁড়া বামুনরা অনেক দিন পর্যন্ত ক্ষীর লুচিতেই আটকে ছিলেন।’’

এখন তো মেনু বিপ্লব ঘটে গেছে। ফিশ ওরলি, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান, বিরিয়ানি-আইসক্রিম কত কী...! ক্যাটারার তো মেনু কার্ড আগেই দিয়ে দেন। মেনু কার্ডেও কত বাহার হয়েছে। একটা মেনু কার্ড ছিল এরকম—

আজকের নাটক: শুভ বিবাহ

প্রযোজনা: ভুড়িভোজ ক্যাটারার

পরিচালনা: মধুসূদন সাহা

চরিত্রলিপি

সূত্রধর: কড়াইশুঁটির কচুরি

দোহার: পনির মশালা

নায়ক: ফ্রায়েড রাইস

নায়িকা: চিকেন মাঞ্চুরিয়ান

খলনায়ক: ফিশ বাটারফ্রাই

অ্যাকশন: খাসির কষা মাংস

অতিথি শিল্পী: কাতলা কালিয়া

হাস্য কৌতুক: প্লাস্টিক চাটনি

সঙ্গীত: রাজভোগ ও আইসক্রিম

ক্যাটারিং কোম্পানির ছেলেপুলেদের গায়ে থাকে ইউনিফর্ম। গ্লাভস পরা হাতে ধরা চিমটে যন্ত্র নিয়ে যেন ডাক্তারের অ্যাসিসট্যান্ট। ওরা ভাতকে বলে রাইস। অতি সন্তর্পনণ একটা করে কিংবা একটু করে পাতে ছাড়ে। তার আগে প্রশ্ন করে, ‘‘দেবো?’’ গত শতাব্দীর আশির দশকেই একটু একটু করে ক্যাটারিং প্রথা ঢুকে যায়। ক্যাটারিং পূর্ববর্তী বিয়ের কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম। সে কথাতেই ফিরি।

সব পাড়াতেই খোকন টোটন বাবলু কালুরা থাকত। ওরা পাড়ার জিম্মাদার। বে-পাড়ার কোনও ছেলে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে এলে এরাই ‘ওয়ার্নিং’ দিত। অঞ্জন দত্তর ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ গানটায় ওই সময়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব বলেছে পাড়ার দাদারা/অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই’। কিন্তু পাড়ার অঞ্জু, মঞ্জু, ডলি, মলিদের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করে পার্থ, অমিতাভ, অরুণ, বরুণদের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলা হলে খোকন, টোটন কালু বাবলুরাই কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশন করে দিত। কোমরে প্যাঁচানো গামছাটাই ছিল বিয়ের ভলেনটিয়ারদের ব্যাজ। বিয়েবাড়ির কর্মকর্তারাই ভলেনটিয়ারদের ‘গামছাবান’ করতেন। গৃহস্থের বাথরুমের গামছা তোয়ালেতে উত্তীর্ণ হলেও বিবাহ-কর্মীদের কোমরের গামছা ‘তোয়ালে’ হয়নি। কারণ তোয়ালে দিয়ে জুৎসই কোমরবন্ধনী হয় না।

তো সেই গামছাধারী খোকনরা বরযাত্রীদের খাতির করে বলত, ‘‘আরও দু-চার পিস মাছ খেয়ে যান, আমাদের পাড়ার প্রেস্টিজ।’’

এদেরই কারও হাতে গৃহকর্তা সিগারেটের প্যাকেট সমর্পণ করতেন। ভোজনের পরে পান চিবোতে চিবোতে কেউ কেউ সিগারেটে সুখটান দিতেন গুরুজনদের চোখ বাঁচিয়ে। পাড়ার বিশ্বস্ত ছেলেরা কায়দা করেই সিগারেট সাপ্লাই করত। কখনও এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি বাড়ির কোনও জামাইবাবাজিও সমাধা করত।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ছিল বরযাত্রীদের গোলাপ জল স্প্রে করা। কনেবাড়িতে ঢুকতেই গোলাপ-বারি বিন্দুতে সুবাসিত হত। হাতে গোলাপ ফুলও ধরিয়ে দেওয়া হত অনেক সময়। জানলায় দু’চারটে রজনীগন্ধার স্টিক এবং হেড লাইটের কাছে কয়েকটা ফুলের তোড়া লাগানো ছিল বরের গাড়ি। আজকাল এই কায়দাতে শববাহী গাড়িও সাজানো হয়। বর এলেই কচিকাঁচারা ‘বর এসেছে বর এসেছে’ বলে জড়ো হত। এখন এত কচিকাঁচার সাপ্লাই নেই, থাকলেও ওরা আবেগহীন। আর আবেগহীনতাই তো আরবানাইজেশন।

পুরনো সময়ের কচিকাঁচাগণ নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য কলাপাতার কোনায় নুনটুকু পরিবেশন করতে তৎপর থাকত। নুন থেকে প্রমোশন হত জলে। পেতলের জগ থেকে মাটির খুরিতে জল ঢালার টেকনিক আয়ত্ত করতে একটু বড় তো হতেই হত। ক্রমশ স্কিল বাড়ত। কাঠের টেবিলে জলের ছিটে দিয়ে কাগজের সাদা চাদর বিছিয়ে ‘সাঁট’ করে ছিঁড়ে নেবার কায়দা রপ্ত করতে পেরেছিলেন যাঁরা, আমাদের চোখে তাঁরা ছিলেন ‘কাগজসিদ্ধ পুরুষ’।

পাঞ্জাবি পরা বর, মুখে চন্দনের বুটি, কাচুমাচু মুখ নিয়ে বসে থাকত, সঙ্গে দু-চারজন বন্ধু কিংবা জামাইবাবু, বা দাদাশ্রেণির কেউ, যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। মেয়েরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে। বরযাত্রীদের হাতে শরবতের গ্লাস, একজন কেউ গামলায় শরবত গুলছে, বোতলের সিরাপ ঢালছে আর গেলাশে ঢেলে দিচ্ছে। বালক-বালিকা থালায় সাজিয়ে বিলি করছে।

শরবত কেবল বরযাত্রীদের জন্য। চা সর্বসাধারণের। চায়ের সঙ্গে গোল গোল নোনতা বিস্কুট। তখন কোথায় বেবিকর্ন, কোথায় মাশরুম? চিকেন পকোড়া কল্পনাই করা যায় না।

ভিয়েন বসানো হত একতলার কোথাও। কাঠের আঁচে রান্না। ধোঁয়া ছড়াত উৎসবের ঝাঁঝ গন্ধ নিয়ে। লেডিকেনি বা বোঁদে আগের দিন রেডি হয়ে যেত। একটা ভাঁড়ার ঘর থাকত, সেখানে মিষ্টি মজুত করা হত। ভাঁড়ার ঘরের ইনচার্জ হতেন মামা বা পিসেমশাই জাতীয় কোনও কড়া লোক। তাঁর অনুমতি ছাড়া মিষ্টি গলত না।

আর একজন করিৎকর্মা থাকতেন রান্নার তদারকিতে। ভাঁজকরা হলুদ চেয়ারে বসে থাকতেন। মাছের পিস বড় কাটা হয়ে গেলে অপারেশন করিয়ে ছোট করাতেন। মাছের মুড়ো কতটা ডালে যাবে, কতটা ছ্যাঁচড়াতে যাবে ঠিক করে দিতেন। মাংসের চর্বি দিয়ে বড়া ভাজিয়ে নিতেন। ওটা দুপুরবেলার পদ। মাংসটা ঠিকঠাক সেদ্ধ হল কি না পরখ করে নিতেন। তখন টেস্ট করার লোকজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে যেত। সবাই টেস্ট করতে চাইত। কিচেন ইনচার্জ কারও কারও উপর সদয় হয়ে টেস্ট করিয়ে দিতেন। ফিশ ফ্রাই টেস্ট করার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল।

আমার মামা ছিলেন সদয় ও মানবিক কিচেন কর্তা। বিকেলের দিকে ছোট সাইজের অনেকগুলো ফিশফ্রাই বানানোর হুকুম দিতেন ঠাকুরকে, তার পর হাঁক দিতেন ফিশ ফ্রাই টেস্ট করবি আয়...। তখন আমাদের সে কী কলরব!

বিয়েবাড়ির হাঁকডাকটাই তো বিয়ে বাড়ির আসল মজা। কী রে ভোঁদা, কই গেলি রে, কাজের সময় কাছে থাকিস না, রেকর্ডে দম লাগিয়ে দে, ঠিক উলু দেবার সময় মেজ বউমাই বা গেল কোথায়, ওরে কোথায় গেলি এই পাতে খানকতক লুচি দিয়ে যা।

এ দিকে ফাটা রেকর্ডটা ট্র্যাকব্যাক করছে। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়’-তে এসে কেবল ‘ভুলে যায় ভুলে যায়’ করে যাচ্ছে। ও দিকে কে একজন বাইরের লোক এসে সাঁটিয়ে যাচ্ছে, বলছে আমি বরযাত্রী, বরপক্ষের লোক বলছে কই এ তো আমাদের কেউ নয়...। কোন এক মেসোমশাই এই অনিমন্ত্রিতকে পাকড়াও করে বাহবা নিচ্ছেন। বলছেন, ‘‘দেখেই বুঝেছিলাম খাবুলিওয়ালা।’’ যাঁরা বিয়েবাড়িতে ঢুকে গিয়ে খেয়ে যায়, ওদের খাবুলিওয়ালা নাম দিতেন কেউ কেউ।

সত্তরের দশকের একটা পুরো বিয়েবাড়ির ছবি ধরা আছে নবনীতা দেবসেনের ‘মেসোমশাইয়ের কন্যাদান’ গল্পটিতে।

ছোটবেলায় দেখতাম বিয়ের পদ্য। গোলাপি গোলাপি কাগজে ছাপা ‘বড় নাতির শুভ বিবাহে ঠাকুমার উচ্ছ্বাস— ‘‘পরানের ধন বিলু সোনা করতে যাবে বি‌য়ে/টুকটুকে বউ আনবে বিলু টোপর মাথায় দিয়ে...’’ কিংবা প্রাণাধিকা ছোট শ্যালিকার বিবাহে বড় জামাইবাবুর খেদ— ‘‘ছোট শ্যালিকা মালবিকা আমার আকর্ষণ/তাঁকেই আমি সঁপেছিনু আমার প্রাণ-মন/কত যত্ন করে আমার বাছত পাকা চুল/তার লাগি সম্বন্ধ করে করেছিলাম ভুল...।

এউ ধরনের ইয়ার্কিময় পদ্য যেমন বাছাই লোকের হাতে যেত, তেমনই বাছাই লোকের হাতেই সমর্পিত হত সিগারেট বিলি করার ভার। বাছাই বৌদিরা আসতেন কনে সাজাতে। বাছাই ফোক্কড় বন্ধু আসত বরের সঙ্গে বাসর জাগতে, বাছাই সঙ্গীরা থাকত বাসী বিয়েতে বরকে র‌্যাগিং করতে। জামাই ঠাকানো ব্যাপারটার মধ্যে ছিল কত বৈচিত্র। আবার ফুলশয্যার রাতে ‘আড়িপাতা’ নামে একটা প্রথা বা কুপ্রথাও ছিল। আবার কনে এলে হাতে ল্যাটা মাছ ধরিয়ে দেবার ইঙ্গিতে হয়তো আদিরসও থাকত। কিছুটা মোটা দাগের মজাও ছিল নাপিতবচনে। বিয়েবাড়িতে ‘নরসুন্দর’ ছিল অপরিহার্য। মালাবদলের আগে কিংবা পরে ওরা ছড়া কাটত, যা এখন অবলুপ্ত। একটা নমুনা—

উমা বসেন মহাদেবের কোলে

আর ভমর বসে ফুলে

এখন দুই গতরের মিল হল

সবাই হরি হরি হরি বলো।

এই গতর কথাটা আসলে ছিল গোত্র। শব্দটা সামান্য পাল্টে উচ্চারণ করাটা কেমন এক নিষ্পাপ দুষ্টুমি।

একটা বিয়েকে ঘিরে হইহই, হাঁকডাক, দুষ্টুমি ছিলই, কিন্তু পাড়াপড়শি-আত্মীয়স্বজনের আমোদ-আহ্লাদে অভিনয়টা ছিল না।

এখন সব কিছুরই কর্পোরেটায়ন হয়েছে। বিবাহ ব্যাপার এখন প্যাকেজিত। আবার অনেক শহুরে বিয়েই দেখি সিরিয়াল-নিয়ন্ত্রিত। এক বিউটিপার্লারের বোর্ডে দেখলাম, কনে সাজানোর প্যাকেজে বিভিন্ন সিরিয়ালের নামের পাশে পাশে টাকার অঙ্ক লেখা।

সম্প্রতি একটা বিয়েতে ‘লাজ-খই’ আহুতি দেবার সময় এক পুরোহিতের নির্দেশ কানে এসেছিল, ‘‘কুলোটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খই ফেলো। সিরিয়ালের কনেদের মতো।’’

সিরিয়ালের কি সাধ্য আছে পুরনো বিয়ের গানগুলো, গুণগুলো বা দোষগুলো ফিরিয়ে দেবার? পতিগৃহে যাত্রার সময়ে কন্যাটির মনের আনন্দ-বিষাদের আলোছায়া কি পড়ে টেলিভিশন পর্দায়?

পতিগৃহে যাত্রার পূর্ব মুহূর্তে বাবা-মায়ের উদ্দেশে এক আধুনিকা নব-পরিণীতাকে বলতে শুনেছি, ‘‘টেক কেয়ার।’’

জানি না তাতে আর্দ্রতা ছিল কিনা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swapnamoy chakraborty marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE