Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিজনতা থেকে ভিড়ের মাঝে

লন্ডনে এসে যে অপ্রত্যাশিত নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই সব কথা শান্তিনিকেতনের অনেককেই চিঠিতে জানাচ্ছিলেন।

রবিচক্র: ইলিনয়ের আরবানায় সিমুরদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ ও আলোচনা শোনার জন্য সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী। মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। ১৯১২-১৩

রবিচক্র: ইলিনয়ের আরবানায় সিমুরদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ ও আলোচনা শোনার জন্য সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী। মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। ১৯১২-১৩

প্রণতি মুখোপাধ্যায় 
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

‘‘রূপের রেখা রসের ধারায় আপন সীমা কোথায় হারায়, তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি’’— গীতাঞ্জলি/ সং অফারিংস-এর কবিতাগুলিতে রূপ-রসের যে মিলন, অধ্যাত্মবোধের যে প্রকাশ, যে চিত্রকল্পের দ্যোতনা, তা যখন বিশ্বজনের মনকে অভিভূত করেছে, বহুজনের প্রতি দিনের আকর্ষণ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ক’জন পাঠক বা জেনেছিলেন এই সব কবিতা যখন রচিত হচ্ছিল তখন কবির মন একের পর এক স্বজন হারানোর বেদনায় কী দীর্ণ-বিদীর্ণ।

১৯১২ সাল, বেশ কিছু দিন থেকে কবি অনেকটা রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছিলেন। ইচ্ছা, চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাবেন। যাওয়ার আগে কিছু দিন শিলাইদহে পদ্মানদীর চরে বিশ্রামে ছিলেন, বসন্তকালের সেই মনোরম প্রিয় পরিবেশে কিছুটা সুস্থও হলেন। আপন মনে বসে বসে নিজের কিছু কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলেন— গীতাঞ্জলি-রই বেশি। নৈবেদ্য, স্মরণ, খেয়া-রও কয়েকটি। সে যেন এক সময়ে রচিত নিজেরই কবিতা ভিন্ন ভাষায় নতুন করে সৃষ্টি করার নেশা তাঁর মনকে মাতিয়ে তুলেছিল।

সমুদ্রপথেও সেই সৃষ্টির খেলাতেই মগ্ন রইলেন, প্রথম নোটখাতা ভরে গিয়ে অনুবাদের পালা দ্বিতীয় খাতায় পৌঁছল। মনে ইচ্ছা, লন্ডনে যে সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় হবে তাঁদের কাছে এই অনুবাদ কবিতাগুলি হয়তো তাঁর কবিসত্তার পরিচয় পৌঁছে দিতে পারবে।

সাধনা/ জীবনের উপলব্ধি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুবাদ: নীলা দাস
৩০০.০০, সিগনেট প্রেস

প্রত্যাশাকে বহু দূর ছাপিয়ে গেল প্রাপ্তি। কবি, কাব্যরসিক এবং বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে পরিচয়ে দিনগুলি নতুনতর হয়ে উঠছে, কবি সম্বর্ধিত, সমাদৃত তাঁর কবিতা। একটি কবিতা সঙ্কলনের কথা ভাবা হচ্ছে। কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস-এর সঙ্গে বসে কবিতা নির্বাচন করলেন রবীন্দ্রনাথ, কিছু সম্পাদনার কাজও হল। সঙ্কলনের ভূমিকা লিখবেন ইয়েটস, বই প্রকাশ করবে ইন্ডিয়া সোসাইটি।

লন্ডনে এসে যে অপ্রত্যাশিত নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই সব কথা শান্তিনিকেতনের অনেককেই চিঠিতে জানাচ্ছিলেন। ২০ জুন ১৯১২ ক্ষিতিমোহন সেনকে লিখলেন, ‘‘সকলের চেয়ে আমার এইটে আশ্চর্য বোধ হচ্ছে আমি এঁদের থেকে দূরে না— এবং আমার জীবন এঁদের পক্ষেও অনাবশ্যক নয়। ... মানুষ বাইরের দিকে এতই দূরে ছড়িয়ে আছে অথচ ভিতরের দিকে এতই নিবিড়ভাবে পরস্পর নিকটে আকৃষ্ট— সেখানে সেই সনাতন মনুষ্যত্বের ক্ষেত্রে জাতিবর্ণ ভাষার ব্যবধান এমনি তুচ্ছ হয়ে যায়... । মানুষের আনন্দযজ্ঞে বিচ্ছেদের পাত্রেই মিলনসুধা পান করবার ব্যবস্থা ভগবান করে দিয়েছেন।’’

ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রথম প্রকাশিত হবে— গীতাঞ্জলি/ সং অফারিংস, কিন্তু সুদূরের পিয়াসি কবিমন সে অপেক্ষায় লন্ডনের সীমানায় আটকে রইল না। মনে হচ্ছে যেন, ‘আমায় বেঁধেছে কে সোনার পিঞ্জরে ঘরে’। ১৬ অক্টোবর অজিতকুমারকে জানালেন, ‘‘এখানকার বন্ধনজাল কাটিয়ে আবার একবার মুক্তিলাভ করবার জন্যে সমস্ত মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আমি শিলাইদহের নির্জন ঘরে বসে ‘গীতাঞ্জলি’ তর্জমা করছিলাম।... সে বিজনতা থেকে একেবারে মানুষের ভিড়ের মাঝখানে এসে পড়েছি।’’

কয়েক দিন পর, ১৯ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করলেন, নিউ ইয়র্ক পৌঁছলেন ২৭ অক্টোবর, সঙ্গী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র। সে যাত্রায় সমুদ্র বড়ই উত্তাল ছিল। ডা. মৈত্রের স্মৃতিচারণে সে সফরের এক টুকরো ছবি, ‘‘রাত্রি তখন অনেক— ভোরের কাছাকাছি— পৌনে ৪টা। অশান্ত মহাসাগরের দোলানির চোটে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চেয়ে দেখি ঘরের অপরদিকে Port hole বা গোল জানালার দিকে সমুদ্রের ধারেই, কৌচের উপর বসে কবি গুনগুন করে গাইছেন।... তাঁর সে অনিন্দ্যসুন্দর মুখের উপর জানালা থেকে আলোর আভা এসে পড়েছে; তিনি উপাসনার আসনে আসীন। গাইছেন “এইতো তোমার প্রেম ওগো হৃদয়-হরণ”।’’

এটুকু গৌরচন্দ্রিকা। নতুন একটি বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম ইংরেজি প্রবন্ধ সঙ্কলন সাধনা/ দ্য রিয়ালাইজ়েসন অব লাইফ-এর বঙ্গানুবাদ, সাধনা/ জীবনের উপলব্ধি, অনুবাদক নীলা দাস। রবীন্দ্রনাথের রচনাশৈলী, শব্দ-প্রয়োগ, তাঁর প্রবন্ধের বিষয় বিন্যাস, সব মিলিয়ে যে বৈশিষ্ট্য তার কি অনুবাদ হয়! ‘তোমার পথ আপনায় আপনি দেখায়’, বাস্তবিকই সব সার্থক রচয়িতা সম্পর্কেই একথা বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের বাংলা রচনার অনেক সফল ইংরেজি রূপান্তর হয়েছে। আর তিনি আজীবন বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলি অনুবাদের প্রয়োজনে যাঁর উপর নির্ভর করেছেন, তিনি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ইংরেজি রচনার বাংলা রূপান্তর বোধহয় খুব বেশি হয়নি। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃত পার্সোনালিটি গ্রন্থের তর্জমা ব্যক্তিত্ব-র (বিশ্বভারতী, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ) কথা মনে পড়ছে। সে যাই হোক, আলোচ্য গ্রন্থটিতে নীলা দাস রবীন্দ্রনাথের সাধনা-র যে বাংলা অনুবাদ করেছেন তা যথেষ্ট অধ্যবসায়ী এবং সনিষ্ঠ। প্রশংসার দাবি অনস্বীকার্য। অনুবাদকের নিবেদন অংশটি তিনটি উপ-অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম বার আমেরিকায় যে যে উপলক্ষে সাধনার প্রবন্ধগুলি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, অনুবাদক প্রথম ভাগে তার ইতিহাস বিবৃত করেছেন। সে কথায় যাওয়ার আগে অনুবাদকের সামান্য একটি ত্রুটির উল্লেখ করি। লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কের পথে কবির সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী ছিলেন না, তাঁরা ইতিমধ্যেই আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। আর একটি অস্বস্তির কথাও বলি, বক্তৃতাগুলির বিশদ বিবরণের জন্য মেরি এম লাগো-র দি ইম্পারফেক্ট এনকাউন্টার গ্রন্থের কোন পরিষ্কার ছবির প্রতি নীলা দাস ইঙ্গিত দিলেন যা রবীন্দ্রজীবনী বা রবিজীবনী-তে অলভ্যতা, বোঝা গেল না।

কবি ভেবেছিলেন আরবানায় শান্ত নিরালা অবকাশে আপন মনের খেয়ালে তাঁর দিনগুলি কাটাবেন। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই ইউনিটেরিয়ান চার্চের পাদ্রি ড. ভেল-এর আমন্ত্রণে পর পর চারটি রবিবার তাঁকে চারটি প্রবন্ধ পড়তে হল। অজিতকুমারকে লিখেছিলেন, ‘‘সে কেবল উপনিষদের ঋষিদের প্রতি সাধ্যমত আমার কর্তব্য পালনের জন্যে।’’ কবি রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি আগেই পৌঁছেছিল আমেরিকায়। এ বার বক্তৃতার জন্য বিভিন্ন স্থানের আমন্ত্রণে ইলিনয়ের মায়া কাটিয়ে তাঁকে বেরোতেই হল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জনসমাবেশে যে সব বক্তৃতা দিলেন, রচেস্টারের রিলিজিয়াস লিবারেলস-এর কংগ্রেস সভায় পঠিত বক্তৃতাটির চরিত্র অন্যগুলির সঙ্গে মেলে না বলেই নিশ্চয়ই তা সাধনা-য় স্থান পায়নি। সেটির গতি কী হল? নীলা দাস জানাননি, ‘রেস কনফ্লিক্ট’ নামের প্রবন্ধটি প্রথমে ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ (এপ্রিল ১৯১৩) ও অজিতকুমার চক্রবর্তীর বঙ্গানুবাদে ‘জাতি সংঘাত’ (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২০ ব.) এবং প্রিয়ম্বদা দেবী কৃত অনুবাদে ‘জাতি-বিরোধ’ (ভারতী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২০ ব.) প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধটি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে দি ইংলিশ রাইটিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর, তৃতীয় খণ্ডে (সাহিত্য অকাদেমি)।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ভারতীয় দর্শন বিভাগের অধ্যাপক জেমস হটন উডস বক্তৃতাগুলির একটি সঙ্কলন প্রকাশে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বক্তৃতা সঙ্কলনটি আমেরিকা থেকে প্রকাশের প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথও সম্মত ছিলেন, পরে তিনি দ্বিধান্বিত হন। লন্ডনে ফিরে বন্ধুদের সমাবেশে প্রবন্ধগুলি পড়ে শোনালেন রবীন্দ্রনাথ এবং ম্যাকমিলান থেকে সাধনা/ দ্য রিয়ালাইজ়েসন অব লাইফ সঙ্কলনটি প্রকাশিত (অক্টোবর ১৯১৩) হল। এইটুকু অনুল্লেখ ছাড়া ভূমিকার প্রথম অংশটি সুখপাঠ্য।

ভূমিকার দ্বিতীয় অংশে রবীন্দ্রনাথের সাধনা-র প্রত্যেকটি প্রবন্ধ ধরে ধরে অনুবাদক যে ভাবে তার মূল নির্যাস উপস্থিত করেছেন, তা যে কোনও মনোযোগী পাঠকের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত সাদামাটা ছোটখাটো চেহারার সাধনা/ দ্য রিয়ালাইজ়েসন অব লাইফ-এর তুলনায় বঙ্গানুবাদটি আয়তনে বেশ বড় এবং সুদৃশ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Book Book Review Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE