Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Soumitra Chatterjee

এক অভ্রময় বিস্ফোরণ প্লাবিত করে দেয়

আমরা গত ছয় দশক ধরে দেখে আসছি, এই সদা ব্যতিক্রমী মেধাবী ও অনুভূতিশীল মানুষটির প্রতিটি সৃজন এক নিরন্তর অন্বেষণ, এক গভীর জীবনানুসন্ধানের অঙ্গ।

চিন্ময় গুহ
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:১১
Share: Save:

যখন মানুষ এক অন্ধকার খাদের কিনারে কাঁপছে, তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই নতুন কাব্যগ্রন্থের ঢেউ এক অভ্রময় বিস্ফোরণে আমাদের প্লাবিত করে দেয়। সমস্ত চকঝমকের বাইরে মাটিতে ধুলোয় নির্মাণ করে এমন এক চিত্রপট যেখানে তাঁর নিশ্বাস আঁকা আছে।

আমরা গত ছয় দশক ধরে দেখে আসছি, এই সদা ব্যতিক্রমী মেধাবী ও অনুভূতিশীল মানুষটির প্রতিটি সৃজন এক নিরন্তর অন্বেষণ, এক গভীর জীবনানুসন্ধানের অঙ্গ। তাঁর প্রথম আবির্ভাবে ‘একটি আশ্চর্য উপন্যাস’-এর স্বপ্ন দেখা অপুর মতোই তিনি কখনও হার মানেননি। চার পাশের ধাতব মৃত্যুশব্দের মধ্যে পাঠকের মনে পড়বে ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯) ছবির সেই শুভ্র সংলাপের কৌমার্য:

‘‘...বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া সে কোনও কিছু মানতে চাইছে না, ছোট ছোট জিনিস তাকে আনন্দ দিচ্ছে, তাকে ‘মুভ’ করছে... সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, ‘এসকেপ’ করছে না, সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ।’’

কখনও জীবনবিমুখ না হয়ে, প্রবল ভাবে বাঁচতে গিয়ে তিনি যে কাজই করেছেন, চলচ্চিত্রাভিনয় বা মঞ্চাভিনয়, কবিতা গদ্যরচনা বা আবৃত্তি, আমরা লক্ষ করব কবিতার উন্মীলন তার শিকড়ে শিকড়ে ছাওয়া। কবিতাই তার কেন্দ্রকোরক। এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নিজেই বলেছেন, তিনি ‘কবিতা দিয়ে ভিজিয়ে দিতে চেয়েছেন’ তাঁর অভিনয়!

ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
২০০.০০
সিগনেট প্রেস

সত্তরের দশকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে (১৯৭৫) ও ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা (১৯৭৬) পড়েই মনে হয়েছিল তিনি আশিরনখ কবি। তাঁর সহজ ও গভীর অনুরণনময় উচ্চারণ তাঁকে বাংলা কবিতায় এক আলাদা আসন দিয়েছে। সেখানে মেকি শব্দের কোনও স্থান নেই, কৃত্রিমতা নেই। অভিনয়ের সময় বিচিত্র চরিত্রের গ্যালারির সামনে তিনি দাঁড়িয়েছেন, আপন আঙ্গিকে পুনরাবিষ্কার করেছেন শেকসপিয়র, ইবসেন থেকে ডুরেনমাট ও অ্যান্টনি শ্যাফারকে, মানবমনের নানা সূক্ষ্মতা তাঁর অধিগত। সত্যজিৎ রায়ের প্রধান অভিনেতা তিনি, রবীন্দ্রনাথকে তিনি তন্নতন্ন করে পড়েছেন, জীবনানন্দকে তিনি ‘আধুনিকতম’ মনে করেন, যখন ‘আট বছর আগে একদিন’ আবৃত্তি করেন তখন মনে হয় নিজের রচনা পড়ছেন। কিন্তু কবিতা লেখার সময় তিনি শব্দের অনন্ত স্রোতমূলে একা।

শঙ্খ ঘোষ, যাঁকে উৎসর্গ করে এই বই, অবাক হয়েছেন কী ভাবে ‘কাব্যভাষার এত গভীরে স্বচ্ছন্দে চলে যায়’ তাঁর কলম। টানা গদ্যে লেখা এই নক্ষত্রপ্রতিম অক্ষরমালা শুধু জাগিয়ে তোলে এক বিস্ময়বোধ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থে ছিল ‘দীর্ঘশ্বাসের করতলে’, ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে’, বা ‘মধ্যাহ্ন’-র মতো টানা গদ্যের কবিতা। হয়তো তাঁকে পথ দেখিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় কবি অরুণ মিত্র, যিনি লিখেছিলেন, ‘প্রাজ্ঞের মতো নয়, অন্ধের ছুঁয়ে দেখার মতো করে বলো’, যাঁর অন্তরঙ্গ গদ্যকথন আজও বাংলা কবিতার এক বিস্ময়চিহ্ন হয়ে আছে। সৌমিত্র নিজেও জীবনের অনেক অনুসন্ধান পার হয়ে আজ আবার সেই অবগাহনে ফিরে এসেছেন। ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’ সেই অবগাহনের কবিতা।

তিরিশটি ভাগে বিভক্ত এই (দু’একটি প্রশ্নচিহ্ন ছাড়া) যতিচিহ্নহীন লিখন, যা আসলে একটিই কবিতা, কাঠকয়লা দিয়ে ভালবাসার আগুন জ্বালাতে চায়। যার মৃদু আলোর ভাঙা আয়নায় প্রতিভাত হয় স্মৃতির গভীর থেকে একটি গোটা জীবনের পর্ব ও পর্বাঙ্গের অণু-কাহিনি। টুকরো

টুকরো স্বরের মন্তাজ যা এক পূর্ণতা খুঁজছে। মগ্নচৈতন্যের এমন উদ্ভাস, বাক্যের অন্তরালবর্তী ছন্দ, বুদ্ধদেব বসুর কথা চুরি করে বলি, কল্পনায় আগুন ধরায়।

ভাঙবার জন্য যে শিক্ষা লাগে, বাংলা সাহিত্যে আজ যা প্রায়শই অনুপস্থিত, তা যে সৌমিত্রের আছে আমরা জানি। কোনও কবিই তো একা নন। ফরাসি কবিতায় গদ্যের এই আবিষ্কার উনিশ শতক থেকেই শুরু হয়েছিল। আলোইজিউস বেরত্রাঁ, বোদল্যের, লোত্রেয়ামঁ, র‌্যাঁবো থেকে আঁরি মিশো, রনে শার, স্যাঁ-জন পের্স যার সাক্ষী। এই লিখন চকিতে স্যাঁ-জন পের্সের বিস্তার মনে পড়ায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেই আমায় বলেছিলেন তাঁর কথা। টি এস এলিয়ট যাঁকে আদর্শ মেনেছেন সেই পল ভালেরির একটি ডায়েরিতে দেখেছি, ‘Le plus grand poète, c’est le système nerveux’ (স্নায়ুতন্ত্রই সর্বশ্রেষ্ঠ কবি)। স্নায়বিক শব্দপ্রয়োগের আশ্চর্য সব উদাহরণ এই বইতে ছড়িয়ে আছে। যেমন,

‘‘অঘ্রানের সকালে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই পথের পাশে পুষ্পিত এক জারুলের সঙ্গে দেখা আর তার চোখে পড়ল গেটের ওপর খিলান তৈরি করে ফুটে আছে বোগেনভিলিয়া এবং এই নতুন শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় একটা-দুটো করে শান্তভাবে ঝরেও পড়ছে তার মভ ফুল— এই দেখার মুহূর্তেই সে বুঝতে পারল সে আর নিজের মধ্যে নেই নিজের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সে’’

‘‘মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোর শেষ ট্রেন এক পারকাশনের ধ্বনি ছড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল বহুদূর পর্বতমালার থেকে হাওয়ার ঘোড়সওয়ার শীত নিয়ে এসেছে এ শহরে তার প্রবাহ আমার পথকে নিস্তব্ধ জনহীন করে রেখেছে’’

বা,

‘‘যেসব নদী এই দারুণ গ্রীষ্মে খাক হয়েছে দু’-একটা দুর্বল রোগা সোঁতায় তার ইতিহাস রয়ে গেছে বালিপাথর সরিয়ে তা তুমি খুঁজে পাবে না নক্ষত্রপুঞ্জ যদি তোমার প্রবাহকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তোমার নিজস্ব যুদ্ধের কাছেই তোমাকে ফিরতে হবে বারবার’’

অথবা,

‘‘ছেলেটার এখন অনেক বয়স এত পথ পার হয়ে আসার পর যখন বার্ধক্য বেদনার মোকাবিলা করতে গিয়ে তার নিশিযাপন নিদ্রাহারা হয়ে যায় তখন সেই মায়াবী কার্বাইডের আলো কোথা থেকে জানি ফিরে এসে তার কবিতাকে নিষিক্ত করে দেয় কোনও শুশ্রূষার মতো’’

বালিপাথরকে সরিয়ে শৈশব আর কৈশোরের শুশ্রূষার কাছে ফিরে আসা এই স্মৃতিভ্রমণকে এক অপূর্ব বাঙালিত্ব দিয়েছে। সেখানে মিশে আছে জ্যৈষ্ঠের আমপাকা গরমে ভরদুপুরে ঘরের মেঝের থেকে হলকা বেরোনো, খড়খড়ি তুলে হাওয়াকে ডাকা, মুড়িমুড়কি ফুটি খরমুজ, ঠাকুরদার খামারবাড়ি, আমবাগানের বাখারি দিয়ে বাঁধা বেঞ্চি, ইস্কুলের গ্রীষ্মের ছুটির হোমটাস্ক, অঝোর শ্রাবণে গোশালার টিনের চালে সারারাত বাজা জলতরঙ্গ, মাস্টারমশায়ের ধমকে জামাকাপড় বদল, ঘড়ির ঠং ঠং, ছেলেদের দে ছুট দে ছুট দে ছুট, নৌকো খুলে দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া, ভোরের নবীন ধ্যানকল্প আলো।

নিজের ব্যথা তাঁকে আর পাঁচ জনের ব্যথার কাছে নিয়ে আসে। এক অনিবার্য দার্শনিকতা এই জাদুদীপ্ত অনুভূতিমালা থেকে উত্থিত হয়:

‘‘কীসের খোঁজে এত দীর্ঘ পথ সে চলে এসেছে তা যেন লোকটা এখন আর বুঝতে পারে না কেন সে এখানে এসেছিল কেনই বা সে ভ্রমমাণ রয়ে গেছে কোন সংকল্প কোন দায় নিয়ে এই পথকষ্ট স্বীকার করেছে সে তো আজও তার বোঝা হয়নি এই পথ-রেখার দু’পাশে অবিরাম যা দেখতে দেখতে সে চলে এসেছে সেই চলচ্ছবিতে সুখ আর দুঃখ সমাহরণে ছিল’’

এর আগেই আছে:

‘‘হয়তো ওই শারদ আকাশের অন্ধকার সরণিতে কালপুরুষ আর তারার তরবারি নিয়ে প্রহরায় বিশ্বস্ত হয়ে আছে এসবই ভাবতে ভাবতে আমি সপ্তর্ষির চিরজিজ্ঞাসার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সীমার অতীতকে বোঝার চেষ্টা করতে থাকব’’ স্মৃতিই এই কাব্যগ্রন্থকে অন্তঃকাঠামো দিয়েছে। দিয়েছে তার সাহসী স্নায়ুর পোশাক। কিন্তু এর অন্তরাত্মা এক দার্শনিকের। গ্রন্থনামে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ তা স্মরণ করিয়ে দেয়।

কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হওয়ার পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আরও তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, ক্যালাইডোস্কোপ, মধ্যরাতের সংকেত, আর স্বেচ্ছাবন্দি আশার কুহকে। কিন্তু বর্তমান বইটি অপ্রত্যাশিত ভাবে সব গ্রন্থি খুলে দিল।

এর সারা গায়ে মুক্তির আস্বাদ। এর ভাষা মুখরতার নয়, মগ্নতার। আত্মাবলোকনের। যেন অবচেতনের জলপাতালের ঢেউয়ের ভেতর এই কবি নতুন করে বাঁচার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন। আস্তিত্বিক সঙ্কটের এই দুঃসময়ে তাই এই কাব্যগ্রন্থ এক অনন্ত চেতনার ইশারা মেলে ধরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Soumitra Chatterjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE