Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Book Review

ঘণ্টা বাঁধবে কে, কী করেই বা

পিকেটি ঘোষণা করেছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মার্ক্সের থেকে স্বতন্ত্র। তিনি মনে করেন, কোন সমাজব্যবস্থা কী ভাবে তার স্বপক্ষে মতাদর্শগত যুক্তি খাড়া করে, সেটাই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২০ ১৪:১১
Share: Save:

ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি (২০১৪) অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির খ্যাতির বিশ্বায়ন ঘটিয়েছিল। তাঁর নতুন বইটির দৈর্ঘ্য তার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি, টীকাটিপ্পনী ইত্যাদি বাদ দিয়ে ছাঁকা পাঠ্যবস্তু ধরলে ৮০ শতাংশ। দুনিয়া-কাঁপানো মহাগ্রন্থের এমন একটি বৃহত্তর উত্তরকাণ্ডের কাছে পাঠকের বাড়তি প্রত্যাশা থাকেই। কেবল নতুন প্রশ্নের সন্ধান নয়, তার উত্তরের প্রত্যাশাও অন্যায্য বলা চলে না। সে প্রত্যাশা মিটল কি?

ভূমিকার প্রথম বাক্যে লেখক বলেন: ‘‘প্রতিটি সমাজকে যুক্তি খাড়া করে দেখাতে হয়, তার মধ্যে যে অসাম্য আছে সেটা কেন যুক্তিসঙ্গত: অসাম্যের সাফাই খুঁজে নিতে না পারলে গোটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইমারতটা ভেঙে পড়ার ভয় থাকে।’’ এই বইয়ের মূল প্রেরণা ওই প্রথম বাক্যেই নিহিত। অসাম্য নিয়ে পিকেটির চিন্তা নতুন নয়, ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ইনইকোয়ালিটি, পরে তার একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ পেয়েছি আমরা, শেষটি ২০১৪ সালেই। এবং তাঁর ক্যাপিটাল-এর অন্দরে অন্তরেও সতত ছায়া ফেলে অসাম্যের সমালোচনা। সেই ধারায় অগ্রসর হয়েই নতুন বইটিতে তাঁর সুস্পষ্ট ঘোষণা: সমকালীন সমাজে যে ভয়াবহ অসাম্য, তার প্রচলিত যুক্তিগুলো আর একেবারেই দাঁড়াচ্ছে না, অসাম্য নিয়ন্ত্রণে না আনলে ইমারত ভাঙবে। এই চিন্তার সূত্র ধরে তিনি খতিয়ে দেখেছেন সে-কাল থেকে এ-কাল অবধি দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র, বিশ্লেষণ করেছেন ক্যাপিটাল-এর গতি ও প্রকৃতি, তার সহযোগী অসাম্যের ব্যাপ্তি ও গভীরতা।

পুঁজির সত্য অন্বেষণে দীর্ঘ ইতিহাসের পথে আর এক জনও হেঁটেছিলেন, আমরা জানি। তাঁর নাম কার্ল মার্ক্স। বইয়ের সপ্তম পৃষ্ঠাতেই পিকেটি ঘোষণা করেছেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি মার্ক্সের থেকে স্বতন্ত্র। তিনি মনে করেন, কোন সমাজব্যবস্থা কী ভাবে তার স্বপক্ষে মতাদর্শগত যুক্তি খাড়া করে, সেটাই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। এবং তাঁর ভাষায়, ‘আমি জোর দিয়ে বলছি, ধারণার ভুবন, রাজনৈতিক তথা মতাদর্শগত পরিসর সত্যিই স্বাধীন।’ নিজের এই অবস্থানকে তিনি সংস্থাপন করেছেন বহুলপ্রচলিত মার্ক্সবাদের বিপরীতে, যে মার্ক্সবাদ বলে— অর্থনীতির ‘ভিত’ই অন্য সব ‘উপরিকাঠামো’কে নির্ধারণ করে, ধারণা এবং মতাদর্শকেও। মার্ক্সীয় তত্ত্বের ধারা, আমরা জানি, ইতিমধ্যে এই নির্ধারণবাদের ঘেরাটোপ ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। অথচ পিকেটি, এই ২০২০’তেও, মার্ক্সবাদ বলতে সেই পুরনো শিলীভূত মডেলটিই বোঝেন! এমনকি, মতাদর্শের আধিপত্যকে তিনি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করেন, অথচ তাঁর সুদীর্ঘ আলোচনায় আন্তোনিয়ো গ্রামশ্চি অনুপস্থিত থেকে যান!

ক্যাপিটাল অ্যান্ড আইডিয়োলজি
টমাস পিকেটি
২৪৯৯.০০, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

কোন সমাজে ক্ষমতাবানরা কী ভাবে নিজের আদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, তার বিচার করতে গিয়ে ছ’টি প্রধান ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন লেখক: দাসপ্রথা, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, যাজক-অভিজাত-শ্রমজীবীতে বিন্যস্ত ত্রিমাত্রিক সমাজ (প্রসঙ্গত, লেখক ফরাসি), সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট, কমিউনিস্ট এবং প্রোপ্রাইটারিয়ান বা সম্পত্তিকেন্দ্রিক। এই বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তাদের রাজনৈতিক প্রকল্পের চরিত্র উন্মোচনে তথ্য-পরিসংখ্যানের যে বিপুল সম্ভার তিনি পেশ করেছেন এবং তার যে কুশলী বিশ্লেষণ করেছেন, সেটা এ-বইয়ের অনন্য সম্পদ। সেই আলোচনার কোনও সংক্ষিপ্ততম পরিচিতি দেওয়ার অবকাশও এখানে নেই।

কেবল, লেখকের একটি মূল প্রতিপাদ্যের কথা বলা দরকার। সম্পত্তির মালিকানাকে যে প্রশ্নহীন মর্যাদা দিতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, পিকেটি খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, তার কোনও শাশ্বত বা প্রাকৃতিক যুক্তি নেই, সম্পত্তির অধিকারকে মাথায় তোলার মতাদর্শটি ক্ষমতাবানদের একটি কৌশল। সম্পত্তির মালিকানা যার, সেই সম্পত্তি যে ভাবে খুশি ব্যবহার করার এবং তার সমস্ত ফল ভোগ করার ‘নৈতিক’ অধিকারও তারই— এই ‘যুক্তি’ আসলে পুঁজিবাদের আত্মরক্ষার সাফাই। তার বিরাট সাফল্য এখানেই যে সে আমাদের এই সাফাইটিকেই সত্যিকারের যুক্তি বলে ভাবতে অভ্যস্ত করিয়েছে। এটাই চেতনার আধিপত্য। গত চার দশকে এই সম্পত্তিকেন্দ্রিকতার সাফাইটিকে একেবারে কব্জি ডুবিয়ে ব্যবহার করেছে নিয়োলিবারাল অর্থনীতি, জীবনের প্রতিটি পরিসর এবং প্রকৃতির প্রতিটি সম্পদ অবধি সব কিছুকে সম্পত্তিতে পরিণত করার মধ্য দিয়ে পুঁজির মালিকানা উত্তরোত্তর কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সেই অতিকায় পুঁজির অধীশ্বরদের অন্তহীন মুনাফা-সাধনার পরিণামে অসাম্য বেড়ে চলেছে বেলাগাম। পিকেটির বক্তব্য, এটা চলতে দেওয়া যায় না, কারণ যে ব্যবস্থায় বহু মানুষ তাঁদের জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর কোনও সুযোগ পান না, অথচ কোম্পানির বড়কর্তারা ‘অর্থহীন রকমের বিপুল উপার্জন’ করেন, সেই ব্যবস্থা হাড়েমজ্জায় অন্যায়। বিল গেটস বা জেফ বেজ়োসদের প্রতিভা বা ব্যবসাবুদ্ধির দোহাই পেড়ে তাঁদের অকল্পনীয় সম্পদস্ফীতির সাফাই গাইলে পিকেটি সাফ বলে দেবেন: হল না, হল না, ফেল। এবং এখানেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে তাঁর বড় নালিশ— তাঁরা এই অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারেননি, নিয়োলিবারাল অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং তার সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন হারিয়েছেন।

অতঃ কিম্?

পিকেটির উত্তর: পার্টিসিপেটরি সোশ্যালিজ়ম। গত শতাব্দীর গোলার্ধ-বিজয়ী সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার বিস্তর তফাত। কেমন সেই ব্যবস্থা? তার ভিত্তিতে থাকবে কয়েকটি প্রধান আয়োজন। এক, ব্যবসায়িক সংস্থার পরিচালনায় শ্রমিক-কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চাই। দুই, শুধু আয় নয়, সম্পদ এবং উত্তরাধিকারের ওপর চড়া হারে কর নেওয়া হবে— যে যত ধনী, তার ওপর করের হার তত চড়া, ৮০ বা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এর ফলে সম্পত্তির মালিকানা ব্যাপারটাই কার্যত ‘সাময়িক’ অধিকারে পর্যবসিত হবে। তিন, সমস্ত নাগরিকের জন্য চাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মূল প্রয়োজনের সংস্থান, চাই সর্বজনীন বুনিয়াদি আয়। এবং, প্রত্যেক তরুণের হাতে একটা নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ তুলে দিতে হবে, যা সর্বজনীন সম্পত্তি বা পুঁজির কাজ করবে। এই শর্তগুলি পূর্ণ হলে— ‘আমি দৃঢ়নিশ্চিত যে, পুঁজিবাদ এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে অতিক্রম করা সম্ভব, প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ।’

এই দাবিসনদ সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করব। সমর্থন করব পিকেটির এই মতটিও যে, অসাম্য কমলে আয়বৃদ্ধির কোনও সমস্যা হবে না। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আমেরিকা-সহ পশ্চিম দুনিয়ায় করের হার এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল, এবং সেটা ছিল ধনতন্ত্রের ‘সুবর্ণযুগ’। বেশি কর দিতে বললেই যে ‘গ্রোথ কমে যাবে’ বলে রব ওঠে, সেটা ডাহা মিথ্যে। আসলে ক্ষমতাবানরা কর দিতে চায় না।

কিন্তু সমস্যা তো সেখানেই। পিকেটির দাবি আদায় করার উপায় কী? তিনি আয় ও সম্পদের যে বিরাট পুনর্বণ্টন চাইছেন, কোম্পানি চালনায় মালিকের ক্ষমতা খর্ব করে কর্মীদের স্বাধিকার বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিচ্ছেন, ক্ষমতার অধীশ্বররা তাঁদের দাঁত নখ এবং সর্বশক্তি দিয়ে তাতে বাধা দেবেন। সেই বাধা অতিক্রম করার জন্য যে লড়াই জরুরি, তা কোনও উন্নততর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সাধ্য নয়।

বোধ করি, পিকেটি সেটা জানেন। কিন্তু জেনেও, এবং বুঝেও, তিনি নাচার। মার্ক্সের পথে তাঁর যাত্রা নাস্তি। অতএব হাতে রইল ১০৪১ পৃষ্ঠার মূল্যবান তথ্যভান্ডার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE