Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক মাত্রা

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস লন্ডনে ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে থেকে একটির পর একটি দেশে ছুটে বেড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের ঘোষিত অবস্থান প্রচার করার জন্য, যারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রদান করেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা, তাঁদের বিরাট অবদান সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি।

স্মরণীয়: বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন আবু সাঈদ চৌধুরী (ডান দিকে)। ছবি বই থেকে

স্মরণীয়: বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন আবু সাঈদ চৌধুরী (ডান দিকে)। ছবি বই থেকে

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি

আবু সাঈদ চৌধুরী

২৩৫.০০

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা

মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য এবং বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্যুৎগতিসদৃশ অভিযান সম্পর্কে আমরা অবহিত। মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড এবং ত্রাণশিবিরে উদ্বাস্তুদের চরম দুর্দশা সম্পর্কেও আমরা জানি। কিন্তু যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস লন্ডনে ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে থেকে একটির পর একটি দেশে ছুটে বেড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের ঘোষিত অবস্থান প্রচার করার জন্য, যারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রদান করেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা, তাঁদের বিরাট অবদান সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি।

তাঁদের দৃপ্ত অঙ্গীকার এবং একনিষ্ঠ কর্ম আলোচ্য বইটির উপজীব্য। যিনি এই বইটি লিখেছেন, সেই প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ-বিচারক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিনয়ী ও সজ্জন আবু সাঈদ চৌধুরী, তাঁর নেতৃত্বেই এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ করা হয়। ফলে তাঁর লেখা বইটি পড়েই আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি প্রবাসীদের অবদান কতটা দিকনির্ণয়ী ছিল। গ্রন্থটির ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যা লিখেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য: “শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কর্তব্যবোধে পরিচালিত হয়ে, পাকিস্তানের অমানুষিক বর্বরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন। বিদেশ-বিভূঁইয়ে সেদিন তাঁর কোনো সহায় সম্বল ছিলনা, ছিল প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ ও গভীর প্রত্যয়। প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি, বিদেশে জনমত গঠন করেছিলেন, প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন প্রবাসে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের। তাঁর সেই ভূমিকাই তাঁকে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে।”

স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসীদের এই জনমত প্রতিষ্ঠার পুণ্য কর্ম, তাঁদের অক্লান্ত ভ্রমণ ও সফর, অশেষ বাক্যালাপ ও অজস্র সাংবাদিক সম্মেলন থেকে আমি শুধু দুটি কার্যক্রম বেছে নিচ্ছি। এক, লেখকের স্ক্যান্‌ডেনেভিয়া যাত্রা ও সেখানে সম্পাদিত প্রচারের কাজ, এবং দুই, লেখক ও তাঁর অনুগামীদের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে জোরালো যোগদান। ১৯৭১-এর ৬ সেপ্টেম্বর লেখক অসলো যান, সেখান থেকে স্টকহলম এবং সব শেষে হেলসিঙ্কি। এই সফরকালেই লেখক বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং এশিয়ান ড্রামা-র লেখক গুনার মিরডাল-এর সঙ্গে মত বিনিময় করেন। মিরডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটিতে চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের জন্যও তিনি অনুরোধ জানান। অধ্যাপক মিরডাল এতে সানন্দে সম্মত হন। আর একজন স্মরণীয় চিন্তাবিদ ও লেখক আঁদ্রে মালরোও অভিন্ন সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “আমি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিতে চাই।”

লেখক ও তাঁর অধীনস্থ সহকর্মীরা নিউইয়র্কে পৌঁছন ১৯৭১-এর ২৩ সেপ্টেম্বর এবং সেখানে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পয়লা অক্টোবর, রাষ্ট্রপুঞ্জের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত চার্চ সেন্টারে, একটি ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশবিদেশের সাংবাদিকরা। এঁরাই তাঁদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের লক্ষ্য ও অঙ্গীকার মেলে ধরেন।

পাঁচটি মহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশ লেখক ও তাঁর সতীর্থদের স্বাগত জানিয়েছিল। এই দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সম্যক বুঝেছিলেন যে পাকিস্তানের শাসককুল ও সেনাবাহিনী পূর্ববঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে নিপীড়ন-যজ্ঞে মেতে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম আত্মপ্রকাশ যে অনিবার্য তাও তাঁরা হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। নীরব আপত্তি জানিয়েছিল শুধু ইসলামিক বিশ্বের অন্তর্গত দেশগুলি। লেখক রাখঢাক না করেই বলেছেন যে পাকিস্তানের কূটনীতি এই বিশেষ ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করে। পাকিস্তানের কূটনীতির অন্তঃসার ছিল— হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারত পরিকল্পনা করে পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশকে দ্বিখণ্ডিত করতে মরিয়া। অর্থাৎ যা ঘটছে তা কূটকর্ম ও চক্রান্তের বিষফল। এই প্রক্রিয়া যত দিন চলেছিল তত দিন মুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে লেখক একটিও কটু শব্দ উচ্চারণ করেননি। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরাট অধিবেশনে লেখক ও তাঁর অনুগতেরা পাকিস্তানের পক্ষে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে সৌজন্য অটুট রেখেছিলেন। সত্যি বলতে, কয়েকজন সহযোগী তাঁকে বলেছিলেন, “স্যার এদের পিছনে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।” কিন্তু স্যার শোনেননি। স্বীকার করতে হবে যে লেখকের সুভদ্র আচরণই বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি অথচ বাঙালি কূটনীতিবিদকে শিবির পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

এক দিকে লেখক ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্র, নমনীয় এবং স্বহৃদয়ী; অন্য দিকে তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো কঠিন। এমনকি মৃত্যুভয়ও তাঁকে তাঁর অভীষ্ট যাত্রা ও চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করেনি। তাঁর নিরাপত্তার ওপর নজর রেখেছিল খোদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তাঁর এই একান্ত অভিলাষকে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন সুদৃঢ় ভাষায়, “লণ্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে, তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস করে দেশে ফিরবো না।” উজ্জ্বলতম এই মানুষটির নিমগ্ন ব্রত মূল্যায়ন করে প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, “ব্যক্তিগত জীবনে এই নিরীহ, নির্বিবাদী, নিরহংকারী সজ্জন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন অমিতবিক্রম আপোসহীন যোদ্ধায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দের তোয়াক্কা না করে তিনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের দুর্মর শপথ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।”

আক্ষেপ শুধু একটাই। দিনপঞ্জিটি শেষ হয়েছে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আলোচিত হয়নি, কারণ লেখকের অকালপ্রয়াণ। এই অসমাপ্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আনিসুজ্জামান তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন, “এই রচনাটি ১৯৮৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘দৈনিক সংবাদ’এ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।” তারপরে চিরস্থায়ী নীরবতা এবং তার পরিণামে আমরা বেশ কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বৃত্তান্ত হাতে পাইনি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসের শেষে ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে সংলাপের বিবরণ তিনি লিখে যেতে পারেননি। এরপর ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষে ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া ও ইয়েল-এ প্রদত্ত ভাষণে ও সংলাপে তিনি যা বলেছিলেন তা অলিখিত থেকে গিয়েছে।

তবে অলিখিত অংশটি কী রকম হত, সে বিষয়ে আমরা পূর্ববাণী অবশ্যই করতে পারি। প্রকাশিত অংশটির মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের স্মৃতিচারণ হত সহজ-সরল তো বটেই; তার উপর সহযোগীদের গুণকীর্তনে মুখর এবং নির্মোহ ও নিরাসক্ত। শেষ করছি শ্রদ্ধাপূর্ণ পুনরাবৃত্তি দিয়ে। আমি এই রচনাটির সঙ্গে তুলনীয় নির্লিপ্ত পর্যবেক্ষণ আগে পড়িনি এবং ভবিষ্যতেও পড়ব বলে মনে হয় না। প্রকাশক ঠিকই বলেছেন, “সর্বত্র নিজের ভূমিকার বর্ণনায় তিনি সংক্ষিপ্ত, নির্মোহ ও নির্লিপ্ত। আত্মজীবনীমূলক রচনায় এই নিরাসক্তি দুষ্প্রাপ্য।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE