Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Book

তাঁতশিল্পের অতীত-বর্তমান

উৎপাদন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনটি বিভিন্ন স্তরে বস্ত্রশিল্পের বিবর্তন দেখা যায়।

শিল্পসুষমা: ঢাকাই জামদানিতে সাঁওতাল উৎসবের রূপায়ণ

শিল্পসুষমা: ঢাকাই জামদানিতে সাঁওতাল উৎসবের রূপায়ণ

শ্যামলী দাস
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০০:২২
Share: Save:

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প
শাওন আকন্দ
২৪০০.০০ (বাংলাদেশি টাকা)
দেশাল, ঢাকা

শাওন আকন্দের বইটি দেখলে ‘কফি টেব্‌ল বই’ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মলাট উল্টোবার পরে সে ভুল ভেঙে যায়। বোঝা যায় কতখানি উদ্যম, নিষ্ঠা, কঠিন পরিশ্রম, সরেজমিন পরিদর্শন ও নিবিড় অনুসন্ধিৎসার ফল এই মহাগ্রন্থ।

১৯৮৪ সালে প্রখ্যাত বস্ত্রবিশেষজ্ঞ মার্তণ্ড সিংহ ও অমর বস্ত্রকোষ সংস্থান ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বস্ত্রশিল্পের যে সব ধারা এখনও টিকে আছে বা দ্রুত অবলুপ্তির পথে— তার অনুসন্ধান করে প্রামাণিক গ্রন্থ প্রকাশের কাজ শুরু করেন। নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষা ও ডকুমেন্টেশনের পর মাত্র তিনটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। শাওন আকন্দের পরিকল্পনা প্রধানত বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। তবে এই প্রাচীন তাঁতশিল্পের ধারা যে হেতু বর্তমান রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ নয়, তাই পশ্চিমবঙ্গের তাঁতশিল্প যথোচিত গুরুত্ব পেয়েছে।

তিনি ঠিকই বলেছেন, চারুশিল্পের বিচারে তাঁতশিল্পকে এক পাতে ফেলা হয় না। যদিও এক জন তাঁতশিল্পীর দক্ষতার পিছনে যে সৃজনী প্রতিভা, শিল্পজ্ঞান ও দীর্ঘ অনুশীলন থাকে তা প্রথাগত চারুশিল্পীদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ইসলামিক দুনিয়ায়, চিন, জাপান বা কোরিয়ায় বস্ত্রশিল্পীদের যে সম্মানজনক স্থান রয়েছে, আমাদের দেশে তার কণামাত্রও নেই। তাই অন্যান্য কারুশিল্পীর মতো তাঁতশিল্পী ও তার সৃষ্টিকর্তারা অজ্ঞাত ও অবহেলিত থেকে যান। অথচ প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে আমরা কত রকমের কত ধরনের কাপড় ব্যবহার করি, সংগ্রহ করার সময় শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, গুণগত মান ও নকশার বাহারের কথা বিবেচনা করি, কিন্তু তাঁদের স্রষ্টার কথা ভেবে দেখি না। স্নানঘরের গামছা থেকে জানলা-দরজার পর্দা, মেঝেতে পাতবার গালিচা, শতরঞ্চি, বিছানায় পাতার চাদর, পুজোর ঘরের আসন, চন্দ্রাতপ, পালাপার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান ও বিয়েবাড়িতে যে কত রকমের কাপড় ব্যবহার হয় তা আমরা ভাল করে ভেবে দেখি না যে কারা কোথায় ও কী পদ্ধতিতে নির্মাণ করেছেন। শাওন আকন্দও চারুশিল্পে তালিম নেওয়ার সময় ও শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় প্রথমে ততটা মাথা ঘামাননি। তারপর ক্রমশ তাঁর মনে হয় যে ইতিহাসের আদিযুগ থেকে বাংলার বস্ত্রশিল্পের যে দুনিয়াজোড়া সমাদর ও খ্যাতি— তার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা একান্ত প্রয়োজন। তখন তিনি বাংলার তাঁতশিল্প বিষয়ে একটা বহুমুখী অনুসন্ধান প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বেশ ক’জন তরুণ সমমনস্ক গবেষক, শিল্পী, আলোকচিত্রী ও দক্ষ কারিগরদের নিয়ে দীর্ঘ চার বছর কাজ করে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করলেন তার সারাংশ নিয়ে এই বই।

বইটি মোট ১১টি ‘পর্ব’ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। বাংলার তাঁতশিল্পের সোনালি অতীতের কথা আলোচনার পর তাঁতশিল্পের মূল উপাদান ও বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। এতে আছে কার্পাসের প্রকারভেদ, উৎপাদন, তুলা থেকে সুতো তৈরি, সুতোকে বোনার উপযোগী করা ও নানা রকমের রঙে রঞ্জিত করার কথা। কার্পাস সুতোয় সহজে রং ধরে না, ধরলেও সে রং বেশি দিন টিকে থাকে না। প্রাচীন ভারতে যে ভাবে বিভিন্ন রকম ভেষজ— ফুল, পাতা, ফলের খোসা, গাছের ছাল, বীজ ও বীজ থেকে নিষ্কাশিত তেল, মাটির খনিজ পদার্থ থেকে রং তৈরি হত— দুনিয়ার আর কোথাও তা হত না। তাই এ দেশের রংরেজ বা রঞ্জনশিল্পীদের ‘মাস্টার ডায়ারস টু দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলা হত।

পরবর্তী পর্বগুলিতে লেখক তাঁতযন্ত্রের কী ভাবে বিবর্তন হয়েছে লিখেছেন। আলোচনা করেছেন যাঁরা তাঁত বুনে কাপড় তৈরি করেন সেই সব জোলা, যোগী বা যুগী, তন্তুবায় কারিগর, বিভিন্ন সামাজিক স্তরে বিভক্ত হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের তাঁতশিল্পীদের কথা। লেখক দেখিয়েছেন, এক পেশাজীবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁতের কাজে যাঁরা যুক্ত, সামাজিক ভাবে তাঁরা একই বর্ণের ছিলেন না। বিভিন্ন মানের ও ধরনের বস্ত্র বয়নের পদ্ধতিও বিভিন্ন ধরনের। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মসলিন বোনার পদ্ধতির সঙ্গে সাধারণ আটপৌরে ধুতি, শাড়ি, চাদর বোনার কারিগরি তো এক হতে পারে না। মসলিন, জামদানি, টাঙ্গাইল, পাবনা বা ঢাকাই বেনারসি ছাড়াও শতরঞ্চি, কম্বল ও আদিবাসী তাঁতবস্ত্রের বয়নপদ্ধতি এই বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

‘বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের নকশা’ অধ্যায়ে লেখক জামদানি শাড়ির নানা ধরনের নকশার কথা জানিয়েছেন। জনপ্রিয়তা ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে কী ভাবে জামদানি নকশায় বৈচিত্র ও নতুনত্ব দেখা যায় তার উল্লেখ করেছেন। টাঙ্গাইল শাড়ির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায় তাকে বৈপ্লবিক বলা চলে। পাড়ে ও জমিতে শিল্পী ও ডিজ়াইনারদের সাহায্য নিয়ে যত ধরনের নকশার ব্যবহার হচ্ছে তেমনটি আগে কখনও দেখা যায়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জনজাতির নিজস্ব ধারায় যে রকম বস্ত্রের নির্মাণ হয় লেখক তার উল্লেখ করেছেন।

চারটি পরিশিষ্টে বাংলার তাঁতশিল্পের বর্তমান স্থিতির আলোচনা। এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা আজ আগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি, তবে তার উৎপাদনের ধরন ও প্রকৃতি যেমন বদলেছে তেমনই তার ব্যবসা ও বিপণনে পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন ভারতবর্ষে যে ভাবে দেখা যায় বাংলাদেশে সে রকম নয়। এখানে তাঁতপণ্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে আধুনিক রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী অসংখ্য ফ্যাশন হাউস ও বুটিকের সৃষ্টি হয়েছে। এক দিকে যেমন সংস্কৃতিমনস্ক ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যবহারের জন্য পুরনো দিনের নকশার কদর বেড়েছে তেমনই নতুন নকশারও উদ্ভব হয়েছে।

তবে এই পুনরুত্থানের কাহিনিটা এত সরল নয়। কম দামি উপাদান থেকে পাওয়ার লুমে তৈরি উৎপাদনের সঙ্গে হাতে বোনা তাঁতের জিনিস, তা সে যতই আকর্ষণীয় ডিজ়াইনের বা টেকসই হোক, বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। তাই উৎপাদন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনটি বিভিন্ন স্তরে বস্ত্রশিল্পের বিবর্তন দেখা যায়। প্রথমটি সাবেকি পদ্ধতির তাঁতশিল্প— এর বাজার সীমিত হলেও গুণগত মান আগের মতোই; দ্বিতীয়টি গ্রামে-গঞ্জে-শহরে আপামর জনসাধারণের দৈনন্দিন ব্যবহারের বস্ত্র পাওয়ার লুমে আমদানি করা সস্তা সুতো ও রঙে তৈরি কাপড়ের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে থাকা হাতে গোনা কিছু তাঁতের কাজের সহাবস্থান; তৃতীয়টি একান্ত বিদেশের বড় বড় ফ্যাশন-লেবেলের অর্ডার মতো পোশাক তৈরি করা যার আর্থিক মূল্য তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি হলেও বাংলার তাঁতশিল্প বা তন্তুবায় শ্রেণির উপর তেমন প্রভাব ফেলে না। লাভবান হয় মহাজন, শহুরে ব্যবসায়ী আর সরকার।

শেষ অংশে লেখক এই শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু জায়গায় তাঁতশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ তাঁতশিল্পী ও নাগরিক নকশাবিদ, গবেষক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সারাংশ প্রকাশ করেছেন। এই অংশের আর্থসামাজিক ও ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম কারণ এই দ্রুত পরিবর্তনশীল দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে তাঁদের অভিজ্ঞতা, মতামত, সাফল্য ও হতাশার কাহিনি না জানলে দুই বাংলার তাঁতশিল্পের চেহারা ও ভবিষ্যৎ কী রকম হতে পারে তার ঠিক কর্মপন্থা স্থির করা যাবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE