Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

চমৎকার প্রেমের উপন্যাস

এই উপন্যাস কমিক স্ট্রিপ আর পপুলার কালচারের। সত্য-মিথ্যা, খবর আর ভুয়ো খবর একাকার হয়ে যাওয়ার এই যুগে সুপারম্যান বা ব্যাটম্যানের মতো অতিমানবিক নায়ক নেই। বরং ব্যাটম্যানের খলনায়ক জোকার আমেরিকার ভোটে জেতে, কেউ অন্য রকম কিছু বলতে গেলে ‘ট্রোলড’ হয়, সাইবার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসা অদৃশ্য শক্তিরা তাকে ছেঁকে ধরে।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২০
Share: Save:

এই উপন্যাস সিনেমার। এখানে কথক রেনে উন্টারলিডেন একটি ছবি তৈরি করছে। ছবিটা তৈরি হবে নিউ ইয়র্কে তার পাড়ার পার্কের পাশে ‘গোল্ডেন হাউস’-এর বাসিন্দাদের নিয়ে। ফলে সিনেমাপ্রেমী সলমন রুশদি এখানে পাতায় পাতায় বিখ্যাত সিনেমার রেফারেন্স আর ক্রস রেফারেন্স নিয়ে লোফালুফি খেলে গিয়েছেন। আইভি নামের একটি মেয়ে গ্যালু‌জ় সিগারেট ফুঁকতে থাকে। তাকে তখন গদারের ‘পিয়েরে লে ফু’ ছবির নায়িকা আনা কারিনার মতো লাগে। উপন্যাসের প্রধান এক চরিত্রের নাম অপু গোল্ডেন। অপু কোন সিনেমার রেফারেন্স, বাঙালি জানে। অতঃপর কুরোসাওয়া, বার্তোলুচি, এমির কোস্তুরিকা থেকে আব্বাস কিয়োরেস্তামি কেউই বাকি নেই। লেখক যখন মুম্বইয়ে জন্মানো সলমন রুশদি, তখন রামগোপাল বর্মা বা বলিউডই বা থাকবে না কেন? অতএব তারাও এসেছে প্রবল ভাবে। দাউদের ডি কোম্পানির সঙ্গে ‘গডফাদার’-এর ডন ক্যারোলিনকে হাসতে হাসতে মিশিয়ে দিয়েছেন লেখক। সিনেমা ও সাহিত্যের প্রায় আইঢাই ভূরিভোজ।

এই উপন্যাস কমিক স্ট্রিপ আর পপুলার কালচারের। সত্য-মিথ্যা, খবর আর ভুয়ো খবর একাকার হয়ে যাওয়ার এই যুগে সুপারম্যান বা ব্যাটম্যানের মতো অতিমানবিক নায়ক নেই। বরং ব্যাটম্যানের খলনায়ক জোকার আমেরিকার ভোটে জেতে, কেউ অন্য রকম কিছু বলতে গেলে ‘ট্রোলড’ হয়, সাইবার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসা অদৃশ্য শক্তিরা তাকে ছেঁকে ধরে। স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাটে বন্দুকগুলি সহসা জীবন্ত হয়ে মানুষকে মৃত্যু-উপহার দিয়ে যায়। ব্যাটম্যানের ‘গথাম’ শহর আর বাস্তবের নিউ ইয়র্ক প্রায় এক। দুই শহরেই এসে গিয়েছে ভয়ঙ্কর এক ক্লাউন। এখন ধর্ষণকারীরাই ধর্ষণ-ধর্ষণ বলে চেঁচায়, বদমাশ লোকেরা পাল্টা আঙুল তোলে, আমি বলছি, তুমিই বজ্জাত।

জোকারদের এই অন্ধকার দুনিয়াতেই রুশদি পরোক্ষে মনে পড়িয়ে দেন হ্যারি পটারের ‘যার নাম করতে নেই’ সেই খলনায়ক ভোল্ডেমর্টকে। নিউ ইয়র্ক তো অভিবাসীদের শহর! এখানে ‘গোল্ডেন হাউস’-এর নিরো গোল্ডেন আর তার তিন ছেলে এসেছিল সেই দেশ থেকে, ‘যার নাম করতে নেই’। সেই দেশে ২জি কেলেঙ্কারি, সুরম্য ‘তাজ হোটেল’ অনেক কিছুই ছিল। ২০০৮-এর ২৬ নভেম্বর সেখানে প্রতিবেশী দেশের জঙ্গিরা হামলা করে। সেখানে মুম্বই শহরটা চালায় সিনেমা ও রিয়াল এস্টেট মাফিয়ারা। দেশের প্রধান চালিকাশক্তি ঘুষোদুর্নীতি (ঘুষ ও দুর্নীতি)। লেখক ‘briberyandcorruption’ নামে একটি দ্বন্দ্বসমাসও তৈরি করেছেন। উপমহাদেশ ও দুনিয়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে জাদুবাস্তবতার ভারতীয় লেখক ফের তাঁর জাত চেনালেন।

দ্য গোল্ডেন হাউস

সলমন রুশদি

৬৯৯.০০

পেঙ্গুইন/ হ্যামিশ হ্যামিল্টন

এই উপন্যাস আইডেন্টিটি বা পরিচিতির। একটা পরিচিতিই কি সব? মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচতে নাম-করতে-নেই দেশ থেকে নিরো গোল্ডেন ও তার তিন ছেলে আমেরিকায় চলে এসেছে। আমেরিকায় কেন? এখানে ক্লার্ক কেন্ট হয়ে যায় সুপারম্যান, ব্রুস ওয়েন বনে যায় ‘ব্যাটম্যান’। যার নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স, সে বিখ্যাত হয় মার্ক টোয়েন নামে, আলফন্স গাব্রিয়েল কাপোন নামের গ্যাংস্টার দ্যুতি ছড়ায় আল কাপোন নামে। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা রুশদি জানেন, আমেরিকাই সেই দেশ, যেখানে একটা পরিচিতি মুছে নতুন পরিচিতি নিয়ে বাঁচা যায়।

এই উপন্যাসের আর এক চরিত্র রিয়া কাজ করে নিউ ইয়র্কের ‘মিউজ়িয়াম অব আইডেন্টিটি’তে। রিয়া মেয়ে, তার প্রেমিক ডায়োনিসাস গোল্ডেন আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভোগে। মেয়েদের পোশাক পরতে তার ভাল লাগে, অস্ত্রোপচার করে মেয়ে হতে চায়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরেও তো আত্মপরিচয়ের গোলকধাঁধা শেষ হয় না, MTF (মেল টু ফিমেল), FTM (ফিমেল টু মেল) কত যে লিঙ্গ-রাজনীতি! শেষ অবধি রিয়া বলে, আসলে বহু পরিচিতির বহুত্ব নিয়েই আমাদের পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে হয়।

রুশদির উপন্যাস মানেই এক ফাঁপা গাছের গুঁড়ি। সেখানে উপকথা থেকে আধুনিকতা, সংবাদ থেকে রাজনীতি সবই জাদু-কার্পেটে উড়ান দেয়। মধ্যরাতের সন্তান সালিম সিনাইরা কখনও নীরবে টেলিপ্যাথিতে কথা বলবে, মরাঠি অস্মিতা মুম্বই শহরে হরতাল ডাকবে। কিংবা ‘টু ইয়ার্স এইট মান্থস অ্যান্ড টুয়েন্টি এইট নাইটস’ উপন্যাসে জিন-রাজকন্যা নিউ ইয়র্কের ফ্ল্যাটবাড়িতে এসে গজগজ করবে, ‘‘এই কারণেই কার্পেটে চড়ে আসি না। পজ়িশনিং সিস্টেমটা ঠিকঠাক থাকে না।’’ তাঁর এই তেরো নম্বর উপন্যাসও ব্যাতিক্রম নয়। এখানে অমিত বিত্তশালী প্রৌঢ় নিরো গোল্ডেন নিজেকে বলে বুড়ো ভাম বা ‘ডোটার্ড’। খবরের কাগজের দৌলতে এই মধ্যযুগীয়, অপ্রচলিত শব্দটি আমাদের জানা। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কিম জং উন কয়েক মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওই বিশেষণে বিভূষিত করেছিলেন। গোল্ডেন হাউস নিয়ে রেনে যে ছবি ভাবছে, সেটা মোটেও ফিচার বা ডকুমেন্টারি নয়। Mockumentary, নকলতথ্যচিত্র। রুশদির শক্তিমত্তা এখানেই। পোস্ট ট্রুথ বা উত্তর-সত্যের এই যুগে যখন সত্য, মিথ্যে একাকার, তথ্যচিত্রেও তো থাকবে উপন্যাসের মতো কাল্পনিক তথ্য! সাংবাদিকতার চেয়ে সাহিত্য আজও ঢের শক্তিমান!

যা হোক, জোয়ানমদ্দ তিন ছেলের বাবা নিরো গোল্ডেন বুড়ো বয়সে সুন্দরী এক রুশ কন্যাকে বিয়ে করে। অতঃপর নিরো ক্রমশ ক্লান্ত, জবুথবু হতে থাকে। তার সদ্যোজাত শিশুপুত্রের জনকও নয় সে। সেই গোপন কর্মটি করেছে কথক রেনে উন্টারলিডেন। রুশ মেয়ে তাকে বাধ্য করেছিল সেই কাজে।

মিথ ও বাস্তবতা নিয়ে রুশদির পলিটিকালি ইনকারেক্ট সব কৌতুক আজও উপভোগ্য! রেনের বাঙালি বংশোদ্ভূত প্রেমিকা সুচিত্রা রায় তাকে ‘নাম করতে নেই’ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস শোনায়। প্রথমে একটাই দল ছিল সিপিআই। কিন্তু দেশে সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ নেই, জনবিস্ফোরণ হয়। তাই সিপিআই থেকে পিলপিল করে সিপিএম, সিপিআইএমএল, এমসিসি ইত্যাদি অজস্র কমিউনিস্ট দলের জন্ম হয়। সে দেশের হিন্দুত্ববাদীরাও নাকি ওরকম। আরএসএস, ভিএইচপি কত যে দল! সুচিত্রার মা-বাবা একদা নিউ ইয়র্কে আরএসএসের ডিনারে গিয়েছিলেন। সেখানে নমো নামের এক প্রশস্তবক্ষ নায়ককে দেখে তাঁরা মুগ্ধ। আর এক জায়গায় রিয়া ভাবে, ‘‘আজ ভাবছি ছেলে হব। কাল আবার মেয়ে হতে ইচ্ছে করবে। ঠিক আছে, আজ এই ইচ্ছে, কাল ওই ইচ্ছে এই রকম ইচ্ছাবদল তো মেয়েদের অধিকার।’’

এত বজ্জাতি, বাস্তবতা এবং গদ্যশৈলীর জাদু নিয়ে শেষ অবধি এ এক চমৎকার প্রেমের উপন্যাস। রেনে স্বীকার করে, সে-ই নিরো গোল্ডেনের শিশুপুত্রের বাবা। প্রেমিকা ও লিভ-ইন পার্টনার সুচিত্রা তাকে ছেড়ে চলে যায়। শেষে রেনে এক দিন সুচিত্রার এ়ডিটিং স্টুডিয়োতে যায়। অনেক অপেক্ষা, তার পর বলে, ‘‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’’ কম্পিউটারগুলি তখন বন্ধ, অন্ধকার পর্দার সামনে শব্দের আড়ালে-থাকা নৈঃশব্দ্য দিয়ে কথা বলে বিচ্ছিন্ন দুই জনে। ততক্ষণে গোল্ডেন হাউস বিস্ফোরণে ভস্মীভূত, নিরোর অনাথ শিশুপুত্রকে দত্তক নেয় সুচিত্রা ও রেনে।

ভালবাসা, সহমর্মিতা নিয়েই আজ এগিয়ে চলতে হবে। রুশদি জানেন, জোকারদের পরাস্ত করতে পারে মানবিক প্রেম-ই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Review Salman Rushdie
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE