Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Book

আমি আর আমার দেহ কি এক

সাইকোথেরাপি, সাইকায়াট্রি এক রকম সমধান। আর একটা উপায় ‘ফিলজ়ফিক্যাল থেরাপি’ বা দর্শন-শুশ্রূষা।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

অন্তিম নিশ্বাস নির্গত হয়েছে। ওই চোখে বিশ্বসংসারের রূপ আর ছায়া ফেলবে না, ওই অধরোষ্ঠ স্ফুরিত হবে না উচ্চারণে, ওই হাতের সব কাজ শেষ। মানুষ থেকে দেহ, কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। এ ভাবনা মগজের পিছনের কোনও কুঠুরিতে ঠেলে রেখে বাস্তববাদী মানুষেরা ‘প্রোডাকটিভ’ দিন কাটায়। কিন্তু জীবন বড় অশিষ্ট। এক ঝটকায় কাপড় খুলে বলে, দেখো, অতি উৎপাদনশীল, অতি ঈপ্সিতরাও প্লাস্টিক-মোড়া হয়ে অপেক্ষা করছে ধাপায়, আবর্জনার চুল্লিতে ঢুকবে বলে। কেউ সৎকারে রাজি নয়, তাই পুত্র ডিপ ফ্রিজে রেখেছে পিতাকে। জ্যান্ত থাকলেই বা কী, সংক্রমণ হলে প্রিয়জনও পরিহার করবে তোমার দূষিত দেহ। বেঁচে থাকতে দেখে নাও, কী হবে মৃত্যু হলে। এই ভয়ানক সত্য হজম করা কঠিন, তাই মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার, চ্যবনপ্রাশ, হোমিয়োপ্যাথির পরেও মনের ডাক্তারকে ফোন— খুব ডিপ্রেশন, তীব্র অ্যাংজ়াইটি।

সাইকোথেরাপি, সাইকায়াট্রি এক রকম সমধান। আর একটা উপায় ‘ফিলজ়ফিক্যাল থেরাপি’ বা দর্শন-শুশ্রূষা। যে সব প্রশ্ন মুখে উড়িয়ে দিলেও ভিতর ভিতর বিপন্ন করে, সে সম্পর্কে দর্শনের অলিগলিতে সন্ধান। ‘জীবনের অর্থ কী?’ এ হল তেমন একটা প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন, ‘আমি’ আর ‘আমার দেহ’, দুটো কি এক? বিজ্ঞান তাই বলে, অথচ বিজ্ঞান-অনুগতরাও প্রিয়জনের মৃত্যুতে টলে যায়। অকালমৃত বান্ধবীর উদ্দেশে এক তরুণীর পোস্ট, “তোকে দাহ করে ফিরতে কত রাত হল, তুই এক বার ফোন করে খবর নিলি না।” অভিমানী প্রশ্ন, আবার গুরুতর প্রশ্নও বটে। দেহের অবসানেই কি কর্তব্যের অবসান?

অরিন্দম চক্রবর্তী এ প্রশ্নগুলো বাঙালি পাঠকের কাছে তুলছেন বার বার, দিগ্দর্শীদের চিন্তার সন্ধান দিয়ে উস্কে দিতে চেয়েছেন দেহ-চিন্তা। দেহ, গেহ, বন্ধুত্ব (২০০৮), তার পর দেহ থেকে সন্দেহ (২০১৭), সেই ধারায় এই বই। ব্যক্তি, চেতনা আর দেহ— এরা কোথায় আলাদা, কেনই বা রক্ত-মাংসের দেহকে ঘিরে ঘৃণা-তাচ্ছিল্য-মুগ্ধতার ভাবোচ্ছ্বাস, লেখক দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞানের নানা গলিতে তার খোঁজ করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কেবল ‘ভগবদ্গীতা মেড-ইজ়ির আলুসেদ্ধ’ খেলে হবে না, ‘নব্যন্যায়ের সজনে ডাঁটা’-ও বাঙালির পাতে পড়া চাই। চিন্তা চিবিয়ে যাদের সুখ, তেমন উৎসুকচিত্ত পাঠকের কাছে অরিন্দমবাবুর বইগুলি সম্পদ। কিন্তু এই মহামারির কালে এ তনু ভরিয়া বইটি যে কারও জন্য একটা থেরাপিরও বটে।

এ তনু ভরিয়া: দর্শন আপাদমস্তক

অরিন্দম চক্রবর্তী

৪০০.০০

অনুষ্টুপ

ধরা যাক মৃত্যুভয়ের কথাটাই। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর রোমান দার্শনিক লুক্রেশিয়াস ছিলেন দেহাত্মবাদী, অতএব ‘আত্মা অবিনশ্বর’ বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন না। বলছেন, যখন আমি আছি তখন মৃত্যু নেই, যখন মৃত্যু আসবে তখন আমি থাকব না। তা হলে মৃত্যুর অনুভব আমার হতেই পারে না। ঠিকই, জঙ্গলে যে বাঘ, কিংবা অতীতের যে বাঘ, ঘরে বসে তাকে তো ভয় করি না। তা হলে মৃত্যুকে ভয় কিসের? যুক্তিটা মন্দ নয়, কিন্তু তাতে খুঁতখুঁতানি যায় না। রয়ে যাবে প্রিয়জন, সাধের সম্পদ, মধুর চরাচর, শুধু আমিই থাকব না, এই চিন্তা থেকেই তো মৃত্যুভয়। লুক্রেশিয়াস বলছেন, তোমার জন্মের আগে যুগ-যুগান্তরে যা কিছু ঘটে গিয়েছে, তার কথা ভেবে তো কই বিষাদগ্রস্ত হও না। এ বার সেই জন্ম-পূর্ববর্তী অনাদিকালকে যেন একটা আয়নার ফ্রেমের মধ্যে ধরে বসাও তোমার মৃত্যু-পরবর্তী অনন্তকালের সম্মুখে। দেখো, মরণোত্তর না-থাকা আসলে জন্মের আগে না-থাকারই প্রতিচ্ছবি। জন্মকে যদি ভয় না পাও, মৃত্যুকেও ভয় পেয়ো না।

জন্মকেও ভয়াবহ মনে করা যেতে পারে। সাংখ্য দার্শনিকেরা যেমন মনে করেন, নবম মাসে ভ্রূণের পূর্বস্মৃতি জেগে ওঠে, সে কর্মফলের জন্য অনুতাপ করে, যদিও ভূমিষ্ঠ হলেই বিস্মৃতি গ্রাস করে। আবার সমর সেন বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবির কাছে শুধু গর্ভ নয়, জীবনই কারাগার। শক্তির ‘জরাসন্ধ’ কবিতায় শিশু যেমন বলে, “তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকব/ বা অন্ধকার হবো।/ আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে॥” এ দৃষ্টিতে মানবজন্ম ভয়ঙ্কর বন্দিদশার সূচনা। না জন্মানো ‘অনারম্ভ সব যন্ত্রণার’, বলছেন অরিন্দমবাবু। মৃত্যু তা হলে মুক্তি।

হয়তো সজনে ডাঁটার অনুরাগীদের কথা ভেবেই, সব চাইতে বিতর্কিত প্রশ্নটি রয়েছে একেবারে প্রথম অধ্যায়ে। মস্তিষ্ক, চেতনা, আমিত্ববোধ— আলাদা না কি অভিন্ন? ‘মস্তিষ্কই আমি’, এ দাবি কি মানা যায়? স্নায়ুবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব, মনের দর্শন, এ সব পরতে পরতে খুলে ধরে লেখক বলছেন, ঠিক যেমন বইয়ের বিদ্যা-বিজ্ঞানকে কাগজ-আঠা-সুতোয় পর্যবসিত করা চলে না, তেমনই মগজ-স্নায়ু-রক্ত দিয়ে চেতনা তৈরি হলেও, আমার প্রেম বা কল্পনাকে মগজে পর্যবসিত করা চলে না। মস্তিষ্ক আর চেতনা, এই দুইয়ের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বসহিষ্ণু’ সম্পর্ককে বোঝাতে অরিন্দমবাবুর উদ্ভাবন ‘চিন্ময় মাংস’ শব্দবন্ধের।

যে অসুস্থ দেহকে নিয়ে এই আলোচনা শুরু, তা নিয়েও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অসুখজনিত ব্যথার অনুভূতি হয় কেবল রোগীর, অথচ, অসুখের কারণ ও প্রতিকার জানেন কেবল ডাক্তার। মাঝে রয়েছেন সেবাকর্মী, যিনি বার বার ‘কেমন লাগছে’ প্রশ্ন করে জেনে নেন অনুভূতি-নির্ভর বর্ণনা। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে ডাক্তার ফের চিকিৎসা নির্ধারণ করেন। অসুখের জ্ঞানতত্ত্ব (এপিস্টেমোলজি) তাই সেবা-পরিচর্যার নৈতিকতার (এথিকস) সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। নৈতিকতা শুধু নিরাময়ে নয়, রোগীর ডাকে সাড়া দেওয়াতে— ‘শুশ্রূষা’ মানেই তো শোনার ইচ্ছা। লেখক বলছেন, “অসুখ যেন শরীরের একটা ডাক, একটা চাহিদা, একটা দাবি।... অসুখের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার শারীরিক-সামাজিক অন্য নির্ভরতা, ক্ষত-যোগ্যতা, দরদ-উৎকণ্ঠার দরকারের জানান দেয়। রোগীর শিয়রে চুপ করে বসে থাকা কমলালেবুটিরও যেন সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার একটা দায়িত্ব জন্মে যায়।”

দেহের এই দাবি মানলে বলা যায় যে, আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীকে একা ফেলে রাখা শুধু ক্লেশকর নয়, অনৈতিক। বিচ্ছিন্নতাই এক অ-সুখ। ‘ব্যাধি-বিবেক’ অধ্যায়ের শেষে অরিন্দমবাবুর কবিতার স্তবক, “অসুখে দিই আওয়াজহীন ডাক/ বন্ধু রহো রহো আমার সাথে/ অসুখে কত একলা লাগে জানো?/ ছোঁয়াচ ভয়ে হাত রাখো না হাতে?” স্বরচিত আর অনূদিত, দু’রকম কবিতাই রয়েছে এই বইয়ে। গদ্যের পরিপূরক, আবার স্বতন্ত্রও বটে।

ভাল থাকা কী, কাকে বলে অসুখ, পরিচর্যা বা নিরাময়কে কী ভাবে দেখব, তার অনুসন্ধানকে বলা চলে ‘ব্যাধির দর্শন’। দর্শনচর্চার একটি নতুন আঙ্গিক। গত কয়েক বছর ধরে অরিন্দমবাবু নানা নিবন্ধ ও বক্তৃতায় অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টি থেকে মানবদেহ নিয়ে বিচার করেছেন। এ দেহ ঘর, না কি খাঁচা, চির-আশ্রয় না কি ক্ষণিকের বিশ্রামস্থল, তার বিচিত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হাত, পা, কান আর মাথা, প্রতিটি নিয়ে রয়েছে এক একটি অধ্যায়। পড়তে পড়তে বিস্ময়, কৌতুক, তর্কস্পৃহা, অনুধ্যান, নানা পর্দা দুলে যায় পাঠকচিত্তে। তবে এ সব সাঁটে বলার বিষয় নয়, কোনও কোনওটা আরও বিশদে বলা দাবি করে। একটা অধ্যায় তো প্রায় ক্লাসনোটের মতো! প্রকাশনাতেও তাড়াহুড়ো ছিল, আন্দাজ হয় ছাপার ভুল আর আধা-খেঁচড়া অনুবাদ দেখে। উঁচু দরের লেখা উঁচু মাপের সম্পাদনাও দাবি করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Arindam Chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE