Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

সারস্বত সাধকের সৃষ্টি

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৫৫
Share: Save:

প্রবন্ধসংগ্রহ/ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস
সম্পাদক: সরস্বতী মিশ্র
৭০০.০০
অক্ষর প্রকাশনী

আজকাল সবাই খুব বাঙালি-বাঙালি করে। বাঙালির রসগোল্লা, রবীন্দ্রনাথ থেকে দুর্গাপুজো, সম্প্রীতি ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব বাঙালিপ্রেম যদি অন্তঃসারশূন্য আত্ম-অহমিকা না হয়ে প্রকৃত আত্মবিশ্বাস হত, বাঙালি স্বর্ণাক্ষরে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের নাম বাঁধিয়ে রাখত। আধুনিক বাঙালি ভাবে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাঙ্গালা ভাষার অভিধান সংকলন করেছিলেন এবং বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী নামে একটা বই লিখেছিলেন। সবাই যখন আজকাল হ্যাপি নিউ ইয়ার মানায়, কেন কী সেটাই নাকি কৃষ্টি, জ্ঞানেন্দ্রমোহনের কথা খুব মনে পড়ে। তাঁর অভিধানে বাংলায় গৃহীত আরবি-ফার্সি থেকে দেশজ এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দের ছড়াছড়ি। ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’য় (১৩০৮) ইলাহাবাদবাসী জ্ঞানেন্দ্রমোহন এই সব বাংলা বাগধারায় চোখের মাথা খাওয়া, গতরের মাথা খাওয়ার উল্লেখ করেছিলেন, ‘‘সত্যই কিছু চক্ষের কর্ণের বা গতরের এক-একটী মাথা নাই, যাহা মাঝে মাঝে খাইতে শুনা যায়।’’ ওই সরস লেখাটিও এই গ্রন্থে পঞ্চাশেরও বেশি অগ্রন্থিত প্রবন্ধের মধ্যে সঙ্কলিত।

এই বইয়ে আলিগড়ের ‘হাজী ওয়ারিস আলী শাহ্‌ এবং ওয়ার্সী সম্প্রদায়’ নিয়ে একটি নিবন্ধ আছে। হাজি সাহেব মুসলমান শিষ্যদের হিন্দুর দীক্ষামন্ত্র দিতেন, আর হিন্দুদের কলমা দিতেন। তাঁর দীক্ষার ফলে মুসলমান ফকির ও হিন্দু সন্ন্যাসী একই পাত্রে খেতেন। বাহরাইচের ‘গাজী মিঞা’ নিবন্ধটিও এই সঙ্কলনে রয়েছে, ‘‘যে দেশে চারিজন ব্রাহ্মণের জন্য পাঁচটি চুলার প্রয়োজন হয়’’, সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গাজি মিঞার সমাধিতে চুম্বন করে। হাল আমলে ইতিহাসবিদ শাহিদ আমিন এই গাজি মিঞা নিয়ে আস্ত বই লিখেছেন। বিনয় ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী প্রমুখ সংস্কৃতি-গবেষকের পূর্বসূরি হিসেবেও জ্ঞানেন্দ্রমোহনের স্থান নির্দেশ করছে এই বই।

কিন্তু তাঁর সব থেকে বড় কাজ বিস্মৃতপ্রায় বাঙালিদের তুলে ধরায়। বাগবাজারে কাশী মিত্রের ঘাট যাঁর নামে, সেই কাশীশ্বর মিত্রের উত্তরসূরি প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্র। তিনিই রুড়কি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বাঙালি ছাত্র। জ্ঞানেন্দ্রমোহন জানান, বাগবাজারে নন্দলাল বসুর বাড়ি থেকে ‘মাহেশের রথ’ নির্মাণ সবই এই বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের কীর্তি। শোনপুরের হরিহরছত্রের মেলার কালীমন্দিরটি তৈরি করে দেন গয়ার বাঙালি দেওয়ান রামসুন্দর মিত্র। পটনায় প্রথম পাকা বাড়িটিও তাঁর। দেওঘরে রাজনারায়ণ বসু থাকতেন, অনেকেই জানে। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রবাবু আরও আগের কথা জানান, বর্ধমানের প্রসন্নকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় দেওঘরে এসে একটি মণিহারি দোকান খুলেছিলেন। সেটাই ওই এলাকায় বাঙালির প্রথম দোকান।

শুধুই বাঙালি প্রকৌশলী বা ব্যবসায়ী নন। বাঙালির পঠনরুচিও এই সারস্বত সাধকের দৃষ্টি এড়ায় না। ‘বঙ্গের বাহিরে বঙ্গসাহিত্য’ প্রবন্ধে লখনউ, শিমলা, নৈনিতালে বাঙালির ক্লাব, লাইব্রেরির কথা বলতে বলতে চলে আসেন কানপুরে। সেখানে ৪০ জন পাঠক ১১৩৮টি উপন্যাস ও নাটক পড়তে নিয়েছিলেন। ২৬টি ইতিহাস ও ৭খানি বিজ্ঞানপুস্তক। লেখক জানান, এই পাঠরুচিতে প্রবাসী বাঙালি মাতৃভাষা হয়তো ভুলে যাবেন না, কিন্তু সাহিত্যচর্চার অমৃত ফলবে না। অতঃপর এই সঙ্কলন কেন জরুরি, তা নিয়ে বাক্যব্যয় বৃথা। বইয়ের শেষে সংযোজিত হয়েছে প্রয়াণলেখ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়-সহ নানা জনের স্মৃতিচারণ, সংক্ষিপ্ত জীবনী ও রচনাপঞ্জি।

দেশের বাড়ি সম্পাদক: সুশীল সাহা ৪০০.০০ খড়ি প্রকাশনী

‘‘এই একটা শব্দ বুঝি উঠেই গেল বাংলাভাষা থেকে: বাড়ি যাওয়া। সে আবার কী কথা, উঠে গেল মানে? বাড়ি কি কেউ যায় না নাকি এখন? অবশ্যই তা যায়, আর কথাটা তাই আছেও নিশ্চয় বেঁচে। কিন্তু হারিয়ে গেছে তার ভিতরকার বিশেষ একটা মানে।... বুঝে বা না-বুঝে, সে ছিল নিজেকে একবার ছুঁয়ে দেখবার জন্য যাওয়া, সেই ছিল আমাদের— বাঙালদের— বাড়ি যাওয়া।’’ লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ (‘বাড়ি যাওয়ার দিন’)। আবার নবনীতা দেবসেন তাঁর ‘দেশের বাড়িটা কোথায়?’ লেখায় জানাচ্ছেন ছোট বেলার দুঃখের কথা, ‘‘দেশই নেই আমার! শুধু স্বদেশ আছে।... স্বদেশটা যেন ভালনাম, আর দেশ হল ডাকনাম। সেই ডাকনামটা আমার থাকবে না কেন?’’ পরে বিদেশে পড়তে গিয়ে ‘দেশ’ বুঝেছেন, আবার বিয়ের পর শান্তিনিকেতনের ‘প্রতীচী’ হয়ে ওঠে তাঁর ‘সত্যিকারের দেশের বাড়ি’। এ পার বাংলা ও পার বাংলা মিলিয়ে কত কত গ্রাম শহর— খুলনার ধূলিহর, ঢাকার আরমানিটোলা কি গেণ্ডারিয়া, ত্রিপুরার গোপাইরবাগ, যশোরের নরেন্দ্রপুর, রানাঘাট, পাবনার হরিপুর, সিলেটের জিন্দাবাজার, বরিশালের বাণারিপাড়া, জলপাইগুড়ি— দেশের বাড়িগুলি আজ ধূসর স্মৃতি। জ্ঞানদানন্দিনী থেকে প্রমথ চৌধুরী, রানী চন্দ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তপন রায়চৌধুরী, অশোক মিত্র, জয় গোস্বামী, তপন সিংহ, মনোজ মিত্র, কবীর চৌধুরী, পবিত্র সরকার— এমন পঁচিশ জনের স্মৃতি এই বইয়ে, ‘ছেড়ে আসা মাটির টান ধরানো এক অপরূপ পাঁচালী’। স্মৃতিতে লগ্ন আরও কত মানুষ, যেন এক কল্পজগতের বাসিন্দা তাঁরা। সে স্মৃতি ছেড়ে আসার কথা মণীন্দ্র গুপ্তের আশ্চর্য গদ্যে— ‘‘কিন্তু আজ জানি, ওই যাওয়াটা ছিল ঠিক মৃত্যুর মতো। মৃত্যুকালে কেউ কি বোঝে, এই যে চলে যাচ্ছে, আর ফিরবে না! তাকে বারবার সবাই বলেছে, আবার জন্মাবি, আবার ফিরে আসবি। এই বাড়ি ঘর নদী নক্ষত্র সব তো রইল তোর।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Books Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE