Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কেবল পড়ার নয়, দেখারও

এ বই নির্মাণের মূল গায়েন পরিমল রায়, তবে দোহাররাও কম যান না। পরিমল রায় অবশ্য গায়েন-দোহার ভেদে নারাজ। তিন নির্মাতার নাম হাইফেন সংযুক্ত, এক লাইনে সহাবস্থিত।

যুগলবন্দি: যতীন্দ্রকুমার সেন (বাঁ দিকে, পরিমল গোস্বামীর তোলা) ও রাজশেখর বসু

যুগলবন্দি: যতীন্দ্রকুমার সেন (বাঁ দিকে, পরিমল গোস্বামীর তোলা) ও রাজশেখর বসু

বিশ্বজিৎ রায় 
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:৫৫
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ পড়ে লিখেছিলেন, ‘বইখানি চরিত্র চিত্রশালা।’ পরশুরামের ‘গড্ডলিকা’ নামে সুপরিচিত বইখানি যে রবীন্দ্র-সমালোচনায় ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ নামেই অভিহিত হয়েছিল এবং ঠিকই হয়েছিল, সে-কথা পাঠকদের কাছে নিবেদন করার জন্য পরিমল রায়, কাজী অনির্বাণ ও দীপংকর বসু রাজশেখর-পরশুরামের পাণ্ডুলিপি, আঁকাপত্র ও আরও অনেক কিছু নিয়ে সুদৃশ্য অ্যালবামকল্প একটি গ্রন্থ নির্মাণ করেছেন। গড্‌ডলিকা-র সমালোচনা-সঙ্কলন, পরশুরাম বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা, রাজশেখর পরিকল্পিত বিজ্ঞাপন, তাঁর ব্যবহার্য দ্রব্যের চিত্র, পারিবারিক ছবি— এমন নানা রকমারি জিনিস এতে মিলবে। কেউ ভাবতেই পারেন পরশুরামের সাহিত্য-পাঠের জন্য এ এক প্রয়োজনীয় নথিখানা। তাঁর সাহিত্য পাঠে এই মুদ্রিত নথিখানাটি যেমন কাজে লাগবে তেমনই কাজে লাগবে ব্যক্তি পরশুরামের ‘সাংস্কৃতিক অনুশীলন’ অনুধাবন করতে।

এ বই নির্মাণের মূল গায়েন পরিমল রায়, তবে দোহাররাও কম যান না। পরিমল রায় অবশ্য গায়েন-দোহার ভেদে নারাজ। তিন নির্মাতার নাম হাইফেন সংযুক্ত, এক লাইনে সহাবস্থিত। পরিমল রায় তাঁর পরশুরামের লেখাপত্র ও ব্যক্তিজীবন বিষয়ক তথ্যনিষ্ঠ সংক্ষিপ্ত অথচ জরুরি লেখাটিতে দাবি করেছেন, গড্‌ডলিকা বইটির প্রচ্ছদে বর্ণলিপি আর চিত্রলিপি দুইয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। ‘‘বর্ণলিপিতে প্রকাশিত গড্‌ডলিকা এবং তারই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে চিত্রলিপিতে বিচিত্রিত মানুষের ঢল— প্রবাহ শব্দটির দ্যোতক।’’ তাই রবীন্দ্রনাথ এই বইকে ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ নামে ঠিকই অভিহিত করেছিলেন। কথাটা মানা যায় আবার যায়ও না, কারণ বইয়ের প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্রে কেবল বর্ণলিপি ব্যবহৃত এবং তা ‘প্রবাহ’হীন ‘গড্‌ডলিকা’। তবে স্বীকার করতেই হবে পরশুরামের বই কেবল পড়ার নয় দেখারও। পাঠকরা যাতে ঠিকমতো ‘চরিত্র চিত্রশালা’ দেখতে পান সে দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং লেখক। পরশুরাম যে ভাবে প্রকাশের জন্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি নির্মাণ করতেন তা আর কোনও আধুনিক লেখক করতেন বা করেন কি না বলা কঠিন। তাঁর হাতের লেখাটি স্পষ্ট, গোটা গোটা। ত্রয়ী সম্পাদিত এই বইটির আগেই বাঙালি পাঠক দীপংকর বসুর সৌজন্যে তাঁর ‘দাদু’র (আসলে মায়ের দাদু) হাতের লেখার নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। রাজশেখর তাঁর দৌহিত্রী-পুত্রের জন্য হাতে লিখে বই তৈরি করে দিয়েছিলেন। এক সময় বাঙালি-পরিবারে হাতে লেখা পত্রিকার চল ছিল। পরিবারের স্বজনদের জন্য সুন্দর হাতের লেখায় সাময়িকপত্র প্রকাশিত হত। অমুদ্রিত সেই পত্র সবাই চেটেপুটে পড়তেন।

রাজশেখর তাঁর পাণ্ডুলিপিতে যেখানে শব্দ কাটতেন সেখানে কাটার চিহ্ন বড় সযত্ন। রবীন্দ্রনাথের মতো কাটাকুটিকে তিনি ছবিতে রূপান্তরিত করতেন না। তবে নিজের বইয়ের জন্য ছবির খসড়া আঁকতেন। দীপংকর বসু আলোচ্য বইয়ে যে রচনাটি লিখেছেন তাতে জানিয়েছেন, পরশুরামের গ্রন্থের অলঙ্করণ শিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেনকে পরশুরাম খসড়া ছবি এঁকে দিতেন। সেই খসড়া ছবি সামনে রেখে যতীন্দ্র তাঁর অলঙ্করণ নির্মাণ করতেন। ‘বসুধারা’ পত্রিকায় একদা প্রকাশিত ‘কলাকুশলী পরশুরাম’ লেখাটি পড়লে বোঝা যাবে যতীন্দ্রের আঁকায় পরশুরামের খসড়া রেখা কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল— যতীন সেন যেন কেবলই দাগা বুলিয়েছেন। নিজেই সেকথা জানাচ্ছেন যতীন, ‘‘যেমন তাঁর ছিল যান্ত্রিক বুদ্ধি তেমনই ছিল চিত্রবিদ্যায় অপরূপ দক্ষতা। ... চরিত্রগুলির চিত্ররূপ... তিনি স্কেচ করে ও লিখে আমাকে জানিয়েছিলেন সেসব আমি জনসাধারণকে উপহার দিচ্ছি।’ (‘বসুধারা’, আষাঢ় ১৩৬৭)। এই অ্যালবামকল্প বইটিতে পাঠক পরশুরামের খসড়া আঁকা আর যতীন্দ্রের একাধিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা গ্রন্থে প্রকাশিত আঁকার বহুরূপ দেখতে পাবেন। পরশুরাম কেবল শব্দে ছবি আঁকতেন না, রেখাতেও ছবি আঁকতেন। তাই পাণ্ডুলিপি ও ছবির খসড়া যেন তাঁর ছবি-দেখা মনের রেখা-লেখার সমবায়। সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে যে ভাবে মনের ছবিকে নিজের খেরোর খাতায় ফুটিয়ে তুলতেন এও যেন তেমন। কেবল পার্থক্য এই পরশুরাম গ্রন্থ-নির্মাণ-কুশলী আর সত্যজিৎ চলচ্চিত্র-নির্মাণ-কুশলী। দুজনের কাজের মাধ্যম আলাদা, তবে মনে মিল ছিল।

গড্ডলিকা-প্রবাহ/ পরশুরাম বিচিত্রিত: যতীন্দ্রকুমার সেন চিত্রাঙ্কিত
১৫০০.০০
আইএমএইচ (পরি: বিংশ শতাব্দী)

শুধু গ্রন্থ নির্মাণে নয় যতীন্দ্রকুমারের সহায়তায় রাজশেখর বসু বেঙ্গল কেমিক্যালের জন্য ওষুধের রঙিন বিজ্ঞাপন সৃষ্টিতেও মন দিয়েছিলেন। পাইরেক্স এই ওষুধটির বিজ্ঞাপনী বাক্য ‘আর জ্বর হয় না’। ওপরে এক ঢাকি সদানন্দে ঢাক বাজাচ্ছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের চন্দন-সাবানের বাক্সটি নজর টানে। নৃত্য-বিভঙ্গরত আনন্দময় রমণী শরীর আর চপল হরিণীদের ছবি শোভিত বাক্স। সুবাসিত চন্দনের ব্যবহার প্রসাধন কার্যে বহু দিন ধরেই চলে আসছে। তাই বাক্সের রমণী শরীরগুলি আধুনিকাদের নয়– আশ্রমরমণীরাও তো হরিণনয়না, তাঁদের তপোবনের স্মৃতি-সুবাস যেন বেঙ্গল কেমিক্যাল আধুনিকদের কাছে নিবেদন করছে।

এর থেকে আবার কেউ পরশুরামকে হালের অতীতকৌশলী পুঁজিবাদী-ধর্মব্যবসায়ী বলে ভাববেন না। সব ব্যাদে আছে এমন নির্বিচার অপবিজ্ঞানবাদী ছিলেন না তিনি। বিরিঞ্চিবাবার ধর্মব্যবসা তিনিই ফাঁস করেছিলেন, পরে সেই ‘মহাপুরুষ’কে ছবিতে জনপ্রিয় করেন সত্যজিৎ। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের যুক্তিবাদী, নিয়মতান্ত্রিক, সুদর্শন, শ্রীময় পরিসর গড়ে তুলতে রাজশেখর সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই বইয়ের গোড়ার দিকে রয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মূল্যায়ন ‘রাজশেখর বসু’। অচিন্ত্যকুমার কল্লোল-যুগের লেখক। যৌবনের উৎসাহে কল্লোলের লেখকেরা নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে, শহরের বাইরে প্রান্তবাসী মানুষের জীবনে অন্য এক অপ্রাতিষ্ঠানিক রূপের অনুসন্ধান করেছিলেন। রাজশেখর বসু কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছিলেন না। পরশুরামের গল্পের রায়বাহাদুর স্বয়ম্বর সভান্তে নিজের চির-পুরাতন চির-নতুন গৃহিণীকেই পুনশ্চ মাল্য অর্পণ করেছিলেন। তবে জীবনের উৎকেন্দ্রিক সমস্যাগুলিকে রাজশেখর ও পরশুরাম কেউই অস্বীকার করেননি। সহোদর মনোবিজ্ঞানী গিরীন্দ্রশেখরের সঙ্গে রাজশেখরের ভাব-বিনিময় স্বাভাবিক। প্রেমচক্রের বিচিত্র গতি, পুরুষের নারী-শরীর লাভ, যৌনতা না আহার্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, মহিলা কবির কল্পিত পুরুষের প্রতি অতিশারীরিক প্রেমের কবিতা— সবই পরশুরামের লেখার বিষয়। তবে পরশুরাম নবীন-যুবাদের মতো সেই প্রেম-কল্লোলে ডুবে যাননি। তাঁর দৃষ্টি তটস্থ, নিরাসক্ত। সেই নিরাসক্তি থেকেই তিনি ঈশ্বর মানেন না, তাঁর প্রয়াণ যে সজ্ঞানে হবেন না তা বোঝেন। তাই নির্দেশ দেন, ‘সজ্ঞানে গঙ্গাপ্রাপ্তি’ যেন তাঁর ক্ষেত্রে লেখা না হয়। আশি অতিক্রম করেছিলেন তিনি। মানুষ দীর্ঘজীবী হতেই পারেন, চিরজীবী নন। আশি উত্তীর্ণ মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। তাই বলে গিয়েছিলেন, ‘পত্রের ইতি’তে ‘ভাগ্যহীন’ না লিখতে। তাঁর প্রয়াণের পর আদ্যশ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্রে ‘বিনীত’ লেখা হয়েছিল। অচিন্ত্যকুমার যখন রাজশেখর সম্বন্ধে এই সব কথা লিখছেন তখন কল্লোলের কোলাহল অতীত স্মৃতি। অচিন্ত্যকুমারেরাও বোঝেন যুক্তিবাদী, শ্রীময় বাঙালিজীবন শ্রদ্ধা করার মতো।

রাজশেখরের এই নিয়মতান্ত্রিক যুক্তিবাদী জীবনযাত্রার মডেলটি যে উনিশ শতকেই কোনও কোনও বাঙালি চিন্তক গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন তা বুঝতে পারি, তিনি তাঁর হাতে লেখা না-ছাপা ‘শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা’র ভূমিকায় লিখেছিলেন যে কোনও বিদ্যার দুই শ্রেণি— তত্ত্ববিষয়ক ও ব্যবহারবিষয়ক। তাঁর জীবনের ব্যবহারিক দিকের নানা-চিহ্ন অ্যালবামকল্প এই বইয়ের পাতায়-পাতায় ফুটে উঠেছে। মনে হয় অতীতসর্বস্ব, হিন্দুত্ববাদের এক রকম জগঝম্পের কাছে আজ যখন একদল মেরুদণ্ডহীন বাঙালি গড্‌ডলিকা প্রবাহবৎ আত্মসমর্পণ করছেন, তখন পরশুরামের সুদৃঢ়-ব্যবহারিক জীবন আমাদের বিকল্প আদর্শ হতে পারে।

জীবন থেকে আবার লেখায় ফিরি। এই অ্যালবাম-গ্রন্থের শেষের দিকে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের ‘ভূশণ্ডীর মাঠ যাত্রা’-র লিখিত খসড়ার প্রতিলিপি। অবনীন্দ্রনাথের যাত্রার অবলম্বন পরশুরামের গল্প ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’। তাঁরা একে অপরের গুণগ্রাহী। অবনীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে রাজশেখর বলেছিলেন, ‘‘... তাঁর সাহিত্যরচনায় নিজের চারিত্রিক স্পর্শ এমন করে রেখে গেছেন যে পড়লেই তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করা যায়।’’ সম্পাদকত্রয়ীকে ধন্যবাদ জানাই— তাঁদের পরিশ্রমের ফলেই একালের পাঠক রাজশেখর-পরশুরামের সান্নিধ্যও এই বইয়ের মাধ্যমে অনুভব করতে পারলেন। সেই সান্নিধ্য যদি তাঁদের যুক্তিনিষ্ঠ, অপবিজ্ঞানবিরোধী, সুশৃঙ্খল, কর্মোদ্যমী বাঙালি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তবেই বাংলা আর বাঙালির মঙ্গল হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE