Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

প্রশ্ন তোলার কোনও লোক নেই

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আড়াই লক্ষ টাকা অনুদানের আবেদন করেছিল গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গলের কাছে। সরকার জানাল, টাকা চাইলে মানতে হবে শর্ত। সেগুলো এমনই যে, উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ তা বাতিলের সুপারিশ করলেন সিনেটে। বক্তৃতায় বললেন, ‘যদি কেউ এক হাতে দাসত্ব আর অন্য হাতে টাকা দিতে চায়, সে প্রস্তাব আমি অবজ্ঞা করি।’

অবলুপ্ত: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউস। ১৮৭২ সালে নির্মিত এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ১৯৬০-এ ভেঙে ফেলা হয়।

অবলুপ্ত: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউস। ১৮৭২ সালে নির্মিত এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ১৯৬০-এ ভেঙে ফেলা হয়।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বিল্ডিং ইউনিভার্সিটিজ় দ্যাট ম্যাটার/ হোয়্যার আর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউশনস গোয়িং রং?

পঙ্কজ চন্দ্র

১১৫০.০০

ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান

পরাধীন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় কি বেশি স্বাধীন ছিল? কয়েকটি নজির দেখা যাক।

১৯২২ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আড়াই লক্ষ টাকা অনুদানের আবেদন করেছিল গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গলের কাছে। সরকার জানাল, টাকা চাইলে মানতে হবে শর্ত। সেগুলো এমনই যে, উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ তা বাতিলের সুপারিশ করলেন সিনেটে। বক্তৃতায় বললেন, ‘যদি কেউ এক হাতে দাসত্ব আর অন্য হাতে টাকা দিতে চায়, সে প্রস্তাব আমি অবজ্ঞা করি।’

কিংবা ধরা যাক সেই ঘটনা, যা দিয়ে পঙ্কজ চন্দ্র তাঁর বই শুরু করেছেন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গাঁধী আমন্ত্রিত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারি কর্তাদের সামনেই গাঁধী ছাত্রদের কলেজ বয়কট করার আহ্বান জানান। তা হয়তো খুব স্বস্তির হয়নি, কিন্তু তা নিয়ে জলঘোলাও হয়নি।

আর আজ? আমন্ত্রিত বক্তা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে উপাচার্যের চেয়ারে টান পড়বে। লেখক বলছেন, আজ এক আমলা ফোন তুলে ‘শোকজ’ করার ভয় দেখাতে পারে উপাচার্যকে। কেন এই পরিবর্তন? ভারতে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কী, কেমন হওয়া চাই উচ্চ শিক্ষার প্রশাসন, তা নিয়েই এই বই। লেখক আইআইএম বেঙ্গালুরুর ডিরেক্টর ছিলেন, পরে আমদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ‘যশপাল কমিটি’-র সদস্যও ছিলেন। এমন লোক এত স্পষ্টভাষী হতে পারেন, এ হল প্রথম বিস্ময়।

কতটা স্পষ্ট? পঙ্কজ চন্দ্র বলছেন, ‘ভারতে উচ্চ শিক্ষার নিয়ন্ত্রক নেই। যা আছে, তা হল জেলখানার ওয়ার্ডেন।’ বিদ্যাচর্চা সেখানেই উৎকর্ষ লাভ করে যেখানে শিক্ষক-গবেষকরা স্বাধীন ভাবে পাঠ্য, পাঠক্রম, মূল্যায়ন, ঠিক করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয় না, অভিযোগ তাঁর। আজ সব রাজ্যের সব প্রতিষ্ঠানকে এক নিয়ম-নিগড়ে বাঁধার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। পঙ্কজ চন্দ্র ‘ইউনিফর্মিটি’-র এই ধারণার প্রতিই হাড়ে-চটা। বলছেন, ওতে চিন্তা সংকীর্ণ হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইচ্ছা কমে, বৈচিত্রের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়ে। সরকারি নির্দেশ নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলা উচিত নিজস্ব সংস্কৃতির অলিখিত নিয়মে। স্বাতন্ত্রই উৎকর্ষের প্রধান শর্ত।

দ্বিতীয় বিস্ময়, লেখক শিক্ষার সেই দিকটার উপর জোর দিয়েছেন, যা প্রায় সব আলোচনায় বাদ পড়ে। তা হল, জানা-শেখার আনন্দ। ছাত্রেরা পড়তে চায় না। কেন চাইবে? ক্লাস কতটা আকর্ষণীয়? শিক্ষকদের সঙ্গে কতটুকু কথাবার্তা হয়? কতটা কৌতূহল তৈরি হয় পাঠ্যবিষয়ে? ‘ভাল শিক্ষা’ কেমন, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি উদ্ধৃত করছেন হ্যারি পটারের গল্প। তার বন্ধু হারমিয়নি মনে প্রশ্ন এলেই ছোটে হগওয়ার্টসের লাইব্রেরিতে। পড়ুয়াদের মনে প্রশ্ন জাগাবে স্কুল, উত্তর জোগাবে স্কুলের লাইব্রেরি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তার ছাত্রদের চিন্তার স্বাধীনতা তখনই দিতে পারে, যখন তার নিজের সেই স্বাধীনতা থাকে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড মেডেল-জয়ী গণিতবিদ মঞ্জুল ভার্গব বলেছেন, সংস্কৃত আর তবলা শিখতে পারায় গণিতে উদ্ভাবনশক্তি বেড়েছে তাঁর। নিজের পাঠক্রম যে নিজে তৈরি করতে পারে না, সেই প্রতিষ্ঠান কী শিক্ষা দেবে?

উচ্চ শিক্ষার দুর্নীতি নিয়ে যেমন খোলাখুলি আলোচনা করেছে এই বই, তারও জুড়ি মেলা ভার। পরীক্ষক যদি ভুলে-ভরা গবেষণাপত্রে পাশ নম্বর দিতে রাজি না হন, রিসার্চ গাইড ফোন করে তাঁকে বলেন, ‘আপনি জানিয়ে দিন আপনার সময় নেই থিসিস দেখার।’ কিন্তু এহ বাহ্য। বিশ্ববিদ্যালয় নীতিভ্রষ্ট, কারণ তা আর জাতীয় প্রতিষ্ঠান নেই। অধিকাংশই স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে। নিয়োগ হয় আশপাশ থেকে। এ এক মস্ত ব্যর্থতা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অন্যতম কাজ, দ্বাররক্ষা। ছাত্রভর্তি বা শিক্ষক নিয়োগে মেধার দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় যদি শিথিলতা থাকে, তবে উচ্চ শিক্ষার মান কমবেই। সরকারি নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক সংকীর্ণতায় সে কাজটা যে হচ্ছে না, নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে তা দেখিয়েছেন লেখক।

এ আক্ষেপ অনেকেরই। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অভিজিৎ দাশগুপ্ত সম্প্রতি (আবাপ, ২৩-৫-১৮) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে একই প্রতিষ্ঠানের একই বিভাগের তিন জন ‘এক্সপার্ট’ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। এ হয়তো আইনবিরুদ্ধ নয়, কিন্তু নীতিবিরুদ্ধ।

আপত্তি কেবল এই নয় যে, দুর্নীতির সুযোগে কিছু আগাছা ঢুকে পড়ছে। আসল সঙ্কট এই যে, যাঁরা আত্মপ্রত্যয়ী নন, তাঁরা নিজের কাজের সমালোচনা এড়ান। অথচ অন্যের মূল্যায়নে ভরসা করতে না পারলে নিজের জ্ঞানচর্চায় উন্নতি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগ তখনই পাঠদানে উৎকৃষ্ট হয়, যখন শিক্ষকদের কাজের মান কাছাকাছি হয়, তারতম্য কমে। মধ্যমেধার লোক নেওয়ার সমস্যা এইখানে।

কলেজ শিক্ষকদের গবেষণা করা আবশ্যক কিনা, বিতর্ক আছে। পঙ্কজ চন্দ্র বলছেন, আবশ্যক। কারণ ছাত্রদের একেবারে সাম্প্রতিক ধারণা জানানো চাই, আর নিজে গবেষণা না করলে অন্যের গবেষণা পড়ার অভ্যাস চলে যায়। নিজের আগ্রহের বিষয়ে জানা-বোঝা নিয়মিত ‘আপডেট’ না করলে ছাত্রদের কী করে জড়িয়ে নেওয়া যাবে জ্ঞানের সন্ধানে? আর নতুন জ্ঞানের সন্ধানই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ।

সে কথাটা কি সমাজ সত্যিই গ্রাহ্য করে? সুকান্ত চৌধুরী আক্ষেপ করছেন, ‘উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থকরী বিদ্যার প্রশিক্ষণ, ব্যাপকতর চিন্তা-গবেষণা নয়— জ্ঞানতন্ত্র (নলেজ অর্ডার) নয়, জ্ঞানাশ্রয়ী অর্থনীতি (নলেজ ইকনমি)।’ (আবাপ, ৭-৪-১৮)। এশিয়ার অন্যান্য দেশ যখন গবেষণায় এত বিনিয়োগ করছে, সাফল্যও পাচ্ছে, তখন ভারত কেন জগৎসভায় ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে পঙ্কজ চন্দ্রও সেই কথাই বলছেন। এখানে লোকে মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পড়ানো এবং ডিগ্রি দেওয়া। তাই শিক্ষকেরা উচ্চ মানের গবেষণা না করলেও কিছু এসে যায় না সরকারি আমলাদের, যারা নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কি কর্পোরেট সংস্থা, যে একটা বিভাগ করবে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’, আর দৈনন্দিন কাজ সারবে অন্যরা? ‘একজন শিক্ষক নানা দায়িত্বে কাজ করতে পারেন, কিন্তু সত্যের সন্ধান, নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ থাকতে হবে সব কাজের মধ্যস্থলে।’

পঙ্কজ চন্দ্রের কলম সাবলীল, তীক্ষ্ণ কিন্তু সরস। বইটি ঠিক ‘অ্যাকাডেমিক টেক্সট’ নয়, বরং উচ্চ শিক্ষার প্রশাসনে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া চিন্তার গ্রন্থন। গোটা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্র্যাকটিস, শিক্ষাতত্ত্বের নানা বিতর্ক থেকে পাওয়া ধারণার প্রেক্ষিতে ভারতকে বিচার করছেন। এ দেশে উচ্চ শিক্ষার ইতিহাসের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়। আজ ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী, দেশের সমস্যার নিরসনে উচ্চ শিক্ষার ভূমিকা কোথায়, জাতির অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোথায় তার অবস্থান, এ সব প্রশ্নের সঙ্গে তিনি প্রশাসনের খুঁটিনাটি সমস্যার সমাধানকে জুড়েছেন।

এই আত্মচেতনা, এই দায়বোধ থেকেই একদিন সরকারের অসম্মানজনক শর্ত ফিরিয়ে দিয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাংলা কী বলবে? ভারত কী বলবে? ভবিষ্যৎ কী বলবে?’ আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে এ প্রশ্ন তোলার লোক নেই, তাই এমন বই আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE