Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Review

চেনা ছবিকে গভীর অচেনা করে তোলে

যে কবিতা থেকে বইয়ের নাম নেওয়া, তাতে: ‘‘নখের আগায় রহস্য চুনদাগ/ প্রথম বিনুনির মতো কৌশলময়— / জর্দা বসন্তের থেকে শ্রীমান পাখির মতো উড়ে গেছে।’’ বইয়ের নাম ‘শ্রীমান পাখি’ হলেও মন্দ হত না। 

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

কবি অগ্নি রায় এমন এক মেজাজ গড়ে তুলেছেন তাঁর সাম্প্রতিক জর্দা বসন্ত (সিগনেট প্রেস, ১০০.০০) বইয়ে, যা তরতরে, সপ্রতিভ, একই সঙ্গে অনন্ত দরদে সিক্ত। কবি চান, যে প্রৌঢ় সংস্কৃত শিক্ষক ‘গোধূলি রঙের নস্যি’ নেন আর জানালার বাইরে তাকিয়ে বাইফোকালে প্রমাদ গোনেন ‘মেঘমেদুরম’, তাঁর রাতের ঘুমহীন বিছানায় নেমে আসুক অভিশপ্ত যক্ষের পাঠানো দু’-এক টুকরো মেঘ, সঙ্গে আনুক আরও এক বছর এক্সটেনশনের স্বপ্ন। ছাত্রের নিলডাউনের ক্ষত, আর নিজের বেঞ্চিতে নিজের জুতোর ছাপ ফেলে দাঁড়িয়ে ওঠার অপমানের তুলনাও করেন। বই জুড়ে আশ্চর্য উপমা। খোলা ছাতারা যেন একই ওয়ার্ডে পর পর শুয়ে থাকা প্রৌঢ় আত্মীয়-বিরহিত রোগী। ‘‘...তেল চুপচুপে মুড়ির উপরে একফালি শৈশব হয়ে বসে আছে চিরকালীন নারকোল’’। আর অটোর ‘‘চালকের হিসির বেগ দক্ষিণ এশিয়ার সূর্যের মতনই অকপট সারল্যময়।’’ ‘‘টিনএজার সচিনের মতো সম্ভাবনাময় একটি সকাল তৈরি হচ্ছে বারান্দার বাইশ গজে।’’ মৌরিগন্ধ, লাভাযত্ন, কদম্ব-গান, সন্ধ্যাস্টেশন, ধুলোপথযান, হ্যালু-বর্ষার মতো দুরন্ত জোড়শব্দ অনায়াসে তৈরি হয়, আর পরিশ্রমী দৃষ্টিতে চার পাশ থেকে সংগৃহীত তুখড় ডিটেলে মিশে যায়। কবি এমন স্নেহের চাদর বিছিয়ে দেন, একটা সন্ধ্যায় ক্লাবের ক্যারমবোর্ডের ওপর ঝুলন্ত বাল্‌বের আলোয়, পাশে দাঁড় করানো অতীত চ্যাম্পিয়নের ক্রাচ ফেরত পায় বিগত প্রতিভার স্পর্ধা। ‘‘যেন সে কদম্ব! যেন মুরলী!’’ আবার চমকে দিয়ে, দাঁতের অসুস্থ নার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, ‘‘এমনই এন্তেকাল যে প্রতিবেশী দেশের হাওয়া এলেও শিরশির করে!’’ যে কবিতা থেকে বইয়ের নাম নেওয়া, তাতে: ‘‘নখের আগায় রহস্য চুনদাগ/ প্রথম বিনুনির মতো কৌশলময়— / জর্দা বসন্তের থেকে শ্রীমান পাখির মতো উড়ে গেছে।’’ বইয়ের নাম ‘শ্রীমান পাখি’ হলেও মন্দ হত না।

‘‘সমস্যা জর্জরিত ভারে মানুষের মস্তক আজ নিম্নগামী। আকাশচুম্বী বহুতল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ আমাদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।’’ পত্রিকার মুখবন্ধে লিখছেন সম্পাদক তন্ময় ভট্টাচার্য। তিনি আরও লিখছেন, ‘‘অথচ মাথা উঁচু করে ওপরে তাকালেই যে সীমাহীন আকাশ অপার সৌন্দর্যের ডালি ছড়িয়ে রেখেছে, প্রকৃতির কত লীলাখেলা সবসময় সেখানে চলেছে, সেদিকে আমরা খুব একটা তাকাই না।’’ প্রায় তিনশো পৃষ্ঠার ‘ঋদ্ধি’ পত্রিকার পাতায় পাতায় সেই ওপরে তাকাবার অপূর্ব বন্দোবস্ত করেছেন তিনি। এ বারের সংখ্যার বিষয় হয়েছে ‘গ্রহ-তারা’। পত্রিকার সামান্য পরিসরে অসামান্য ভাবে পাঁচটি বিভাগে এ কালের বিশিষ্ট লেখকরা তুলে এনেছেন মহাকাশ এবং সেই সম্পর্কিত নানাবিধ তথ্যাদি। এই বইটিতে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ব্রহ্মাণ্ড, কৃষ্ণগহ্বর, ধূমকেতু, আকাশদেখা, ক্যালেন্ডার, টেলিস্কোপ, গান-সাহিত্য ও ধাঁধায় মহাকাশ ইত্যাকার নানাবিধ কথা। পত্রিকাটি সমৃদ্ধ হয়েছে দীপক কুমার দাঁ কৃত জ্যোতির্বিজ্ঞান-মহাকাশ বিষয়ক বাংলা বইয়ের তালিকার সংযোজনে। খুবই আকর্ষক বিষয়বস্তু।

ক্ষতের সকালে হেম (বার্তা প্রকাশন, ৭০.০০) রিম্পির পদ্য-গদ্যের বই। ‘বর্ষাতিহীন’ আর ‘বিষণ্ণ বারান্দা’ দুই ভাগে বিভক্ত বইটিতে নিত্যদিনের মনকেমন প্রধান সুর। তবে সেই মনকেমনের মধ্যে দৃষ্টি আটকে যায়নি, সহজ অনুভব পাঠকের মনকে সম্প্রসারিত করেছে। পাড়ার দর্জির দোকানে জামার মাপ ভুল করা কারিগরের কথা বলতে বলতে মেয়েটি ছেলেটির কথা ভাবে। তার মনে হয়, ‘এক একটা দর্জির দোকান আসলে দুঃখ সেলাই করার কারখানা।’ কাপড় শুকোতে দেওয়া ছাদ, অবাধ্য শুকনো শাড়ির ওড়াউড়ি ছায়ার জায়গা বদল করে। লিখেছেন রিম্পি ‘আমি জানি, ছায়া না হোক, ছায়ার ধারণার ভিতর এক একটা ছাদ নিরিবিলি বেঁচে থাকতে পারে।’ উচ্ছ্বাস নয়, বিষণ্ণ-সংযম প্রতি দিনের চেনা ছবিকে গভীর অচেনা করে তুলেছে।

পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বয়ে আসা নদীর প্রবাহ চা-বাগান ও ফসলি খেতের বিস্তৃত তরাই-ডুয়ার্সের চরাচরে, জনগোষ্ঠীরও স্বকীয় জীবনধারা গড়ে উঠেছে। এই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক-প্রশাসনিক রূপরেখায় আছে দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার অঞ্চলভিত্তিক নানা জনজাতির বসতি। নৃতাত্ত্বিক গড়ন, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, আচার-অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ, নৃত্যগীত, কারুশিল্প ইত্যাদি নানা বিষয় মিলেমিশে স্বতন্ত্র যে সব জীবনযাপন। মধ্য ভারত, ছোটনাগপুর-সহ পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, বৈগা, বীরহোড়, বীরজিয়া ইত্যাদি অভিবাসী জনজাতির বসতি গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলে। আবার মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠীভুক্ত মেচ, রাভা, গারো, লেপচা, টোটো-র মতো জনজাতিও অনেকাংশে উত্তর-পূর্ব ভারত-সহ বর্তমান বাংলাদেশের ভূসীমা থেকে এখানে এসে বসতি করেছে। সময়ের পথ ধরে এদের দীর্ঘ পরিক্রমণের ইতিহাসও জনজাতি চর্চার অন্যতম বিষয়। চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও জীবন-জীবিকার সুস্থিত খোঁজে আস্তে আস্তে এই চৌহদ্দি অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠল। কেমন জীবনধারা তাঁদের এই সময়কালে? ইতিহাসের পথ, পাল্টে যাওয়া ধারা, অস্তিত্বের ঐতিহ্য রূপে এ সব জনজাতিকে কয়েক দশক যাবৎ নিবিড় ভাবে নিরীক্ষণ করছেন লেখক কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য। ট্রাইবাল বেঙ্গল: দ্য লাইফ ইন দ্য সাব-হিমালয়ান টেরাই-ডুয়ার্স (নিয়োগী বুকস, ১৪৯৫.০০)— সেই সব তথ্য সন্ধানে নৃতাত্ত্বিক বিষয়বৈশিষ্ট্য নিয়েই অনুভবী পরিচয়ের এক মনোগ্রাহী আলেখ্য এই বই। মুদ্রণ সৌকর্যে, আলোকচিত্রের সহযোগে তা সুচারু ও সুবিন্যস্ত। বাংলায় তফসিলি তালিকাভুক্ত যে ৪০টি জনজাতির উল্লেখ আছে, সে সবের অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত সংখ্যাগত হিসেবেও নানা অসঙ্গতি রয়ে গিয়েছে। ‘হো’ জনগোষ্ঠী ‘মুন্ডা’-র সঙ্গে মিশে গিয়েছে অনেকাংশে— কিন্তু ‘কোল’ যে সেই সংস্কৃতির অংশ তা পরিসংখ্যানে নেই। আবার ‘ম্রু’ বাস্তবে সন্ধান না থেকেও তালিকায় আছে। লেখকের বর্ণনায় প্রথমেই উল্লিখিত ‘ধিমাল’ বৈশিষ্ট্যের নিরিখে নিশ্চিত ভাবেই জনজাতির অন্তর্ভুক্ত, অথচ তালিকাভুক্ত নয়। আবার বাংলার অন্যতম আদিম জনজাতি হিসেবে ‘টোটো’-র এই তালিকায় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ডুকপা, শেরপা, ইয়েলমো, কাগাতে জনজাতির সঙ্গে একত্রে ‘ভুটিয়া’-র মধ্যে তারা অন্তর্ভুক্ত। এই টোটোদের একমাত্র বসতি টোটোপাড়ায় যে টোটোরাও সংখ্যালঘু নেপালি জনগোষ্ঠীর কাছে! জনজাতির জমি অধিকার আইন কোথায়? জনজাতির এই সংক্ষিপ্ত পরিচয় বর্ণনায় অবশ্য এমন গুরুত্বপূর্ণ নানা সমস্যা, অসঙ্গতি আর আক্ষেপের কথাও উঠে এসেছে লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ বয়ানে।

তোষলা দেবীর কাছে স্বামী পুত্র নিয়ে সুখে সংসার করা থেকে সন্তান লাভ, রোগ ব্যাধি নিরাময় থেকে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া থেকে মানব প্রজনন শক্তি বৃদ্ধি— সবের জন্য মেয়েদের ব্রত পালনের পরম্পরা দীর্ঘ দিনের। বাঙালি নারীর এই মেয়েলি ব্রতগুলিকে প্রবীণ গবেষক প্রদ্যোতকুমার মাইতি তিনটি অধ্যায়ের মাধ্যমে এক মলাটে এনেছেন ব্রতানুষ্ঠান ও বাংলার নারীসমাজ-এ (প্রভা প্রকাশনী, ২০০.০০)। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে নীহাররঞ্জন রায়— সকলেই এই সব ব্রতের প্রাক্ বৈদিক উৎসের কথা লিখেছেন। লেখক ঠিকই বলেছেন, যে কালে স্ত্রীজাতির শিক্ষার দরজা বন্ধ ছিল তখন এই সব ব্রতই তাঁদের জীবন গঠন করত। ধর্মমঙ্গল-এ লাউসেন যে ‘‘স্বামী বিনা সংসারে নারীর নাহি গতি’’ লিখেছিলেন তারই তো বাস্তব অনুসরণ দেখা যায় ‘পূর্ণিপুকুর’ ব্রতের ছড়ায়— ‘‘পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে, মরণ হয় যেন গঙ্গাজলে।’’-র মতো ছড়ার লাইনগুলোতে। এক সময়ে আঞ্চলিক ইতিহাসের বইগুলিতে স্থানীয় ব্রত বা পরবের কথা যত্ন সহকারে ঠাঁই পেত, গৌরীহর মিত্রের বীরভূমের ইতিহাস-এর কথা মনে পড়ে যায় এই প্রসঙ্গে। এই সব হারিয়ে যাওয়া ব্রত ও ছড়াতে সমাজ ইতিহাসের গবেষক অনেক রসদ পাবেন। যেমন, মধ্য যুগে ফারসির কদর কেমন ছিল তা বেশ বোঝা যায় ওই— ‘‘আর্শী আর্শী আর্শী— আমার স্বামী পড়ুক ফার্সী।’’-র মতো প্রবাদে। ব্রতগুলোয় প্রতিফলিত হয়েছে বহু বিবাহ থেকে বৈধব্য যন্ত্রণা পর্যন্ত। একাধিক ব্রতে ফুটে উঠেছে সতীনের বন্ধ্যত্ব এমনকি মৃত্যুকামনা পর্যন্ত। মূর্খ স্বামীর অভিশাপ মেয়েরা বোধ হয় চির কালই অনুভব করতেন। তাই তো সেঁজুতি ব্রতের ব্রতিনীদের মুখে শুনতে পাওয়া যায় ‘‘কখন না পড়ি যেন মূর্খের হাতে’’-র মতো ছড়া। ভাল হত এর সঙ্গে ব্রতগুলোর গরিমা আগের মতো না থাকার যে আক্ষেপের কথা লেখক জানিয়েছেন তার একটা পূর্বাপর আলোচনা থাকলে। ‘পল্লীবৈচিত্র’-তে দীনেন্দ্রকুমার রায় যেমন ‘নবান্ন’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন— ‘‘আজকাল ইংরাজী-শিক্ষার বিস্তারে আমাদের উৎসবানুরাগ অনেক পরিমাণে শিথিল হইয়া আসিয়াছে।’’ এই ধরনের একটা অনুসন্ধানধর্মী আলোচনা খুব প্রয়োজন। সুখের কথা আধুনিকতা বা সোশ্যাল মিডিয়ার এই গড্ডলিকা প্রবাহের মধ্যে আজও ভাদু বা টুসুর মতো কয়েকটা ব্রত/ পরব রাঢ়বঙ্গে বেশ ভাল রকমই টের পাওয়া যায়। আলোচ্য বইয়ে বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ নজরে আসে। নিজের অবসরের তারিখ হিসেবে শুরুতেই যে লেখক ১৯৩৬ বলেছেন সেটা আসলে ওঁর জন্মের বছর। চোদ্দো নম্বর পৃষ্ঠায় সপ্তম অধ্যায়ের যে উল্লেখ লেখক করেছেন বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া গেল না। এ দু’-চারটি দিক বাদ দিলে মেয়েদের জগৎ নিয়ে রীতিমতো ক্ষেত্র সমীক্ষা করে এই ধরনের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে তুলে আনার কাজ নিঃসন্দেহে লেখকের উদ্যমের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE