Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

আসল খবরটা ঠিক কোথায়

আসল খবর জেনেও প্রকাশ করতে পারেন না সাংবাদিক, গণতন্ত্রে এ এক চিরকেলে বিপদ। এখন যোগ হয়েছে নতুন আপদ, ‘আসল ব্যাপার’ না জেনেই অনর্গল শব্দ উদ্গীরণ, আর ‘খবর’ বলে সেই রাবিশ পরিবেশন।

প্রশ্নবাণ: প্রচারে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি প্রিয়ঙ্কা বঢরা। বারাণসী, ২০১৯। ছবি: এএফপি

প্রশ্নবাণ: প্রচারে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি প্রিয়ঙ্কা বঢরা। বারাণসী, ২০১৯। ছবি: এএফপি

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

বাসে-ট্রেনে এতক্ষণ যিনি দিব্যি খোলা মনে খোশগল্প করছিলেন, তাঁর চেহারা নিমেষে বদলে যায় যদি টের পান যে সামনে-বসা ব্যক্তিটি সাংবাদিক। ভুরুতে কৌতূহল, চোখে ষড়যন্ত্র, বকের মতো গলা এগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘তা হলে ব্যাপারটা কী বুঝলেন?’ কাগজ-টিভিকে পাত্তা দিতে তিনি নারাজ। ‘আসল খবরটা কী?’

আসল খবর জেনেও প্রকাশ করতে পারেন না সাংবাদিক, গণতন্ত্রে এ এক চিরকেলে বিপদ। এখন যোগ হয়েছে নতুন আপদ, ‘আসল ব্যাপার’ না জেনেই অনর্গল শব্দ উদ্গীরণ, আর ‘খবর’ বলে সেই রাবিশ পরিবেশন। রুচির শর্মার বইটি হওয়ার কথা ছিল নির্বাচন-উন্মুখ ভারতের খবর। কিন্তু এর ‘আসল ব্যাপার’ যা বোঝা যায় তা হল, এ দেশে কেমন করে নির্বাচনের খবর করা হয়।

বড় দলের বড় নেতাদের মতো, বড় মিডিয়ার বড় সাংবাদিকরাও নির্বাচন এলে গ্রাম-মফস্সলে যান। তবু সেই সুযোগে যদি হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তদের ঘরে ঢুকে সুখ-দুঃখের গল্প হয়, মন্দ কি? রুচির শর্মাদের সে ফুরসৎ মেলে না। তাঁদের বাস কিংবা গাড়ির কনভয় আগাম ছকে বাঁধা। কোন নেতার সভা দেখে, কার সঙ্গে ডিনার করে রাতে কোথায় থাকা হবে (অবশ্যই এলাকার সেরা হোটেলে), সব ফিট করা। লালগড়ের ‘বেঙ্গল রিৎজ়’ হোটেলে জলের টানাটানি, শুনে তখনই কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন অনেকে। আইপিএল চলছিল, ঘর মেলেনি। পরদিন শাহরুখের পাশে বসে ম্যাচ দেখে কষ্ট ভুলেছিলেন।

জবোনমিক্স/ ইন্ডিয়াজ় এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস অ্যান্ড হোয়াট দ্য ফিউচার হোল্ডস
গৌতম দাস
৫৯৯.০০
অ্যাশেত ইন্ডিয়া

রুচিরের বইটিকে বলা চলে ‘নির্বাচনী পর্যটন।’ জায়গায় জায়গায় থেমে ‘সাধারণ মানুষ’ ডেকে প্রশ্ন, এ বার কাকে ভোট দিচ্ছেন? তা থেকে উন্নয়নের আন্দাজ করা যায় না, তাই ‘সিগন্যাল’ খোঁজেন। যেমন, হাইওয়েতে কত জোরে গাড়ি ছোটানো যায়, বা রেস্তোরাঁয় কী খাবার মেলে। ভাগলপুরের হোটেলে অলিভ অয়েল-সহ স্প্যাগেটি পেয়ে সাংবাদিকরা টের পেলেন, নীতীশ কুমার বদল এনেছেন বিহারে।

দ্য ভার্ডিক্ট/ ডিকোডিং ইন্ডিয়াজ় ইলেকশনস
প্রণয় রায় ও দোরাব আর সোপারিওয়ালা
৫৯৯.০০
পেঙ্গুইন ভিন্টেজ

এই বই পড়ে লাভ নেতাদের অন্তরঙ্গ ছবি। মায়াবতী হাউসকোট গায়ে সাংবাদিকদের শোবার ঘরে বসিয়ে ‘কোলগেট করে আসি’ বলে চলে যান কলঘরে। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার রাজপ্রাসাদের ডাইনিং রুমে ঘুরপাক খায় মডেল ট্রেন, তার সাতটা কামরায় রুপো, স্ফটিকের পাত্রে পানীয়। লালুর প্রিয় রসিকতা —নয় ছেলেমেয়ের নাম বলতে বলতে, যেন ভুলে গিয়েছেন এমন ভাব করে স্ত্রী রাবড়ির দিকে তাকানো।

ডেমোক্র্যাসি অন দ্য রোড/ আ টোয়েন্টি-ফাইভ ইয়ার জার্নি থ্রু ইন্ডিয়া
রুচির শর্মা
৬৯৯.০০
পেঙ্গুইন অ্যালেন লেন

তবে এ বই হাতে মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইলে একটু ঝুঁকি আছে। গোটা কতক অচেনা লোক গাড়ি থেকে নেমে লালগড়ের চাষিকে যদি প্রশ্ন করে ‘আপনার সমস্যা কী’ (সালটা ২০১১) সে বেচারি যে মন্দ রাস্তা নিয়ে নালিশ করবে, মাওবাদী প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। তার মানে কি সে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না? রুচিরের এক প্রবীণ সফরসঙ্গী এই ঝুঁকিটা বোঝেন। প্রণয় রায় প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা করতে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের এক গ্রামের দলিত মহল্লায়। ‘কাকে ভোট দেবেন?’ সমস্বরে উত্তর, ‘বিজেপিকে।’ সাধারণত সমীক্ষকরা এটুকু নোট করেই হাঁটা দেন। সে দিন তাঁরা বসে গল্প করলেন মিনিট পঁচিশ। শেষে গ্রামের লোকেরা বললেন, ‘ভোট মায়াবতীকেই দেব। আপনারা উঁচু জাত, তাই বিজেপি বলেছিলাম।’

ভার্ডিক্ট/ ডিকোডিং ইন্ডিয়াজ় ইলেকশনস সমীক্ষকের লেখা বই, সাংবাদিকের নয়। দুই লেখক অকপট, ভোটদাতার মত সমীক্ষায় বাদ পড়ে যেতে চায় দলিত, মহিলা, অতি-দরিদ্র, সংখ্যালঘুরা (ভোটের খবরেও কি তাই নয়?)। কখনও দূরত্ব, কখনও ফিল্ড-কর্মীর প্রশিক্ষণের ফাঁক, কখনও ভাষা, সংস্কৃতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বহু সংস্থার সমীক্ষার পদ্ধতি অতি রদ্দি। তা বলে পূর্বাভাস কি ফালতু? লেখকদের মতে, কোন দল জিতবে তা মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা পঁচাত্তর শতাংশ। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোট বাদ দিলে (যে বার সব সমীক্ষা উড়িয়ে প্রথম ইউপিএ সরকার এল) ‘স্ট্রাইক রেট’ ৯৭ শতাংশ।

অমনি গলা বাড়াবে প্রশ্ন, ‘তা হলে এ বার কী বুঝছেন?’ কিছু ক্লু মিলবে বইতে। যেমন, ভোটের হার বেশি হলে কংগ্রেসের লাভ, কম হলে বিজেপি-র। সম্ভাব্য কারণ, বিজেপি সংগঠিত, তার সমর্থক সে ঠিক নিয়ে আসে। কংগ্রেস ঢিলেঢালা, তার ভরসা সমর্থকের উৎসাহ। আবার, মহিলাদের মধ্যে বরাবর বিজেপির সমর্থন কম। তাঁরা বেশি সংখ্যায় ভোট দিলে বিজেপির শঙ্কা বাড়বে। দুঃখের কথা, এ বছর দু’কোটিরও বেশি মহিলা ভোটারের নাম তোলা হয়নি তালিকায়। ২০১৪ সালে বাদ পড়েছিলেন আড়াই কোটি মেয়ে।

প্রণয়ের দাবি, এ বার ভোটের নির্ণায়ক হবেন গ্রামের মহিলারা। তাঁরা এখন পুরুষের সমান সংখ্যায় ভোট দিচ্ছেন, শহুরে মেয়েদের চেয়েও বেশি। এ দিকে আবার শোনা যাচ্ছে, গত এক বছরে এক কোটিরও বেশি ভারতীয় কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই নাকি গ্রামের মেয়ে। তা হলে বিজেপির কী হবে?

কী হবে মোদী-রাহুল, মায়াবতী-মমতার, এ প্রশ্নে যতই উত্তেজনা চলকে পড়ুক, বিস্বাদ সরের মতো জমছে বিষাদের আচ্ছাদন। এত কর্মহীনতা, এত ছেলেমেয়ের অনশন চাকরির জন্য। কী হবে এদের? কোন নীতিতে, কোন মন্ত্রে এত লোকের কাজ জোটানো যাবে? সাংবাদিক গৌতম দাস এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ট্রেনযাত্রায়। দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল যোজনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উনষাট জন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে ওড়িশা থেকে তামিলনাড়ুতে চলেছেন তিনিও। তিরুপুরের কাপড়ের কারখানায় কাজ করতে চলেছে ওরা। তাদের আশা-আশঙ্কায় দুলতে দুলতে, চলন্ত জানলার ফ্রেমে বিশ্ব দেখার মতো, পাঠক দেখতে পান নিয়োগ-সঙ্কটের ফ্রেমে ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, পরিবারকে। জবোনমিক্স বইটি সেই যাত্রা।

বই শুরু হচ্ছে সংসদে মোদীর দাবি দিয়ে— বছরে এক কোটি কাজ তৈরি হচ্ছে। গৌতম নানা পরিসংখ্যান, নানা পরিস্থিতি, নানা গল্প ও অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করছেন সেই দাবিকে। নীতির প্রার্থিত সাফল্য কী ছিল, আর সত্যি কী ফল হল। ভুবনেশ্বর বা উদয়পুরের যে সব সংস্থা ট্রেনিং দিয়ে ভিন রাজ্যে কাজে পাঠাচ্ছে ছেলেমেয়েদের, তারা স্বীকার করছে যে ক’দিন পরেই তিন জনে এক জন ফিরে আসছে ঘরে। ট্রেনিং নিয়েও মেলে অদক্ষ মজুরের কাজ, মজুরি মাসে ছ’-সাত হাজার টাকা। কাজের সময় অতি-দীর্ঘ, থাকা বস্তিতে। কে এ ভাবে বাঁচতে চায়?

যাঁরা কাজ চাইছেন, যাঁরা কর্মী খুঁজছেন, যাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, নীতিপ্রণেতা, বাণিজ্যিক সংস্থা, শিল্পপতি, পরামর্শদাতা, মন্ত্রী-আমলা, শ্রমিক নেতা, প্রতিটি ক্ষেত্রে লাগসই কিছু মানুষ বেছে তাঁদের কথা শুনেছেন গৌতম, পড়েছেন রিপোর্ট, ঘুরেছেন কারখানা, ট্রেনিং সেন্টার, হস্টেল। নিয়োগ বাড়াতে কী হারে আর্থিক বৃদ্ধি চাই, কেমন শিল্প, কেমন প্রশিক্ষণ দরকার, আর কী হচ্ছে, মিলিয়ে দেখেছেন।

কর্মহীনতা যদি সত্যিই এই নির্বাচনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়, তা হলে ‘আসল খবর’ দিয়েছেন গৌতম। জটিলকে প্রাঞ্জল করেছেন। নাগরিকের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দিয়ে রাষ্ট্রের বিচার করেছেন। এই তো সাংবাদিকের কাজ। মানুষকে যিনি স্পর্শ করে আছেন, তাঁর কাছে নির্বাচনের খবর বলে আলাদা কিছু হয় না। নির্বাচন এলে তখন যে সব নেতা, যে সব সাংবাদিক মানুষের খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাঁরা গণতন্ত্রের জঞ্জাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Books Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE