Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

অন্য চেহারায় ধরা দেয় উপত্যকা

পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা বলছেন, ‘‘যুদ্ধে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি না। যুদ্ধে আরও মায়ের কোল খালি হবে। সরকারের উচিত সমাধানের পথ খোঁজা, তবে যুদ্ধের মাধ্যমে নয়।’’

চিরন্তন: দাদু-নাতির লুকোচুরি খেলা। শ্রীনগর বোটানিক্যাল গার্ডেন। ছবি: ইরফান নবি, বই থেকে

চিরন্তন: দাদু-নাতির লুকোচুরি খেলা। শ্রীনগর বোটানিক্যাল গার্ডেন। ছবি: ইরফান নবি, বই থেকে

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৮
Share: Save:

কাশ্মীরের পুলওয়ামা থেকে হাওড়ার বাউড়িয়ার রাজবংশীপাড়ার দূরত্ব কতটা? পুলওয়ামার বধ্যভূমি থেকে যে যুদ্ধ রক্তবীজের মতো ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশের মহল্লায় মহল্লায়... ঘরে ঘরে... আকাশ-বাতাস-প্রান্তর হয়ে সেঁধিয়ে গেল মানুষগুলোর অন্তরে, সেই যুদ্ধই যেন হোঁচট খেল বাউড়িয়াতে, এক গৃহবধূর সামনে এসে!

পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা বলছেন, ‘‘যুদ্ধে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি না। যুদ্ধে আরও মায়ের কোল খালি হবে। সরকারের উচিত সমাধানের পথ খোঁজা, তবে যুদ্ধের মাধ্যমে নয়।’’

ডেভিড দেবদাসের বইটি হাতে নিয়ে মিতার কথাগুলো বড় বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে। সাংবাদিক দেবদাস ত্রিশ বছরেরও বেশি কাশ্মীর ‘কভার’ করেছেন। বহু দিন কাশ্মীরে থেকেছেন, বারে বারে সেখানে গিয়েছেন। শুধু সাংবাদিকই নন, তিনি এক অর্থে ইতিহাসবেত্তাও বটে। কাশ্মীর সমস্যার মূল খোঁজার জন্য শুধুমাত্র ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের উপরে নির্ভর করেননি দেবদাস, বরং নজর দিয়েছেন মানবজমিনের গভীরে। বুঝতে চেয়েছেন তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা। এ জন্য বেশ কিছু দিন ধরে কাশ্মীরের ৬-৭ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সমীক্ষা চালিয়েছেন তিনি ও তাঁর টিম। সমীক্ষা চলেছে উপত্যকার ৬০টিরও বেশি স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

গোটা দুনিয়ায় একটি পরিচিত ছবি: নিরাপত্তা রক্ষীদের দিকে তাক করে পাথর ছুড়ছে মুখে রুমাল বাঁধা একদল যুবক ও কিশোর। রুমালের আড়াল থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে তাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ। তাদের ঠিক উল্টো দিকে ঢাল, লাঠি ও রাইফেল হাতে রক্ষীর দল, আর তাদেরও পিছনে গোটা দেশ। সে দেশ ফুঁসছে, বলছে, ওদের জ্বালিয়ে দাও, রাইফেলে যত গুলি আছে সব উজাড় করে ফুঁড়ে দাও ওদের দেহ... ওরা সবাই জঙ্গি! পুলওয়ামার পিছনে ওদের সবার হাত আছে! কেউ জানতে ইচ্ছুক নয়, কেন দেশের এক ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’-র একদল যুবক-যুবতী ইনস্যাস এবং একে ৪৭-এর সামনে বার বার এসে দাঁড়াচ্ছে? সাংবাদিকতা ছাড়াও নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ফেলো দেবদাস তারই উৎসের খোঁজে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা চালিয়েছেন।

দ্য জেনারেশন অব রেজ ইন কাশ্মীর
ডেভিড দেবদাস
৪৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

২০১৭ পর্যন্ত, কাশ্মীরের বর্তমান যুব সমাজের দুই-তৃতীয়াংশের জন্ম হয়েছে আশির দশকের শেষ ভাগে, কাশ্মীরে উগ্রপন্থার বাড়বাড়ন্তের পরে। তারা কিন্তু মৃত্যুমিছিল আর ক্ষয়িষ্ণু উপত্যকা দেখতে দেখতেই বড় হয়েছে। এক দিকে জঙ্গিদের তৎপরতা, অন্য দিকে রাষ্ট্রশক্তির লাল চোখ দেখে তারা অভ্যস্ত এবং স্বভাবতই স্বাভাবিক জীবনযাপনে আর অভ্যস্ত নয় তারা। এই যুব সমাজের দিকেই সব থেকে বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন দেবদাস।

অ্যালিয়োরিং কাশ্মীর/ দি ইনার স্পিরিট
ইরফান নবি ও নীলশ্রী বিশ্বাস
১৯৯৫.০০
নিয়োগী বুকস

দেবদাসের বই বলতে চায়, উপত্যকার এখনকার যুবসমাজের এই বিক্ষোভ ও বিদ্বেষকে আগের জঙ্গিপনার ধারাবাহিকতা বলে ভাবলে ভুল করা হবে। কারণ, এর প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছে। বাইরের অনেক কিছুই প্রভাব ফেলছে কাশ্মীরি যুবমানসে। ভারত সরকার যতই চেষ্টা করুক, অধুনা ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ কী ভাবে প্রভাব ফেলেছে কাশ্মীরের যুব সমাজে, তারই সবিস্তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেবদাস। তিনি দেখিয়েছেন, ২০০২-এ উপত্যকায় মোবাইল কানেকশনের (সরকারি সংস্থার পরিষেবা) অনুমতি দেওয়ার পরে যেখানে এর সংখ্যা ছিল মেরেকেটে হাজারখানেক, সেখানে ২০০৪-এ একটি বেসরকারি সংস্থা আসার পরে সে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তা বেড়ে হয় ৭০ হাজারেরও বেশি। ২০০৭-এর মধ্যে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১০ লক্ষ। ইতিমধ্যে আরও বেসরকারি সংস্থা সেখানে পরিষেবা দিতে শুরু করেছে।

আমেরিকা ২০০৩-এ ইরাকে ঢোকে। তারও অনেক আগে থেকে আমেরিকার ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র প্রচার চলছিল। দেবদাস বলছেন, মুসলিম দেশগুলিতে মার্কিন আধিপত্য নিয়ে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন আর এসএমএসের মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে উপত্যকায়।

ইতিমধ্যেই সেনাকর্তা হুমকি দিয়েছেন, বন্দুক হাতে নিলেই নিকেশ করে দেওয়া হবে। সন্তানদের ঠিক পথে ফেরাতে কাশ্মীরের মায়েদের উপর বড় দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি। গোটা বার্তায় কোথাও কাশ্মীরের যুবসমাজের বক্তব্য শোনার দায় নেই। কারণ, ‘নেশন’ তা শুনতে চায় না। ‘নেশন’ চায় বদলা নিতে। একটা গোটা রাজ্যের সবাই জঙ্গি? দেবদাস প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন বিচার-বিশ্লেষণ-তথ্য আর যুক্তির পথে থাকতে।

বড় জরুরি একটা কাজ করেছেন ডেভিড। ভীষণ জরুরি!

আরও একটি অসামান্য কাজ করেছেন নীলশ্রী বিশ্বাস এবং ইরফান নবি, তাঁদের বইয়ে। এত হানাহানি আর বিদ্বেষের মধ্যে উঠে এসেছে এক ভিন্ন কাশ্মীর, সেখানকার মানুষজন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মনন আর অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। এক কথায়, ইরফান নবির লেন্সে ধরা পড়া কাশ্মীর, সঙ্গে নীলশ্রীর অসাধারণ আখ্যান। এই গ্রন্থ উৎসর্গ করা হয়েছে ‘কাশ্মীর, তার মানুষজন ও যাঁরা কাশ্মীরকে ভালবাসেন’ তাঁদেরকে। জানা নেই, তীব্র ঘৃণা ছড়ানোর এই মরসুমে তেমন মানুষ কি আদৌ পাওয়া যাবে? কে জানে!

বিশ্বখ্যাত ফরাসি ফটোগ্রাফার কার্তিয়ে ব্রেসঁ সাদা-কালোয় কাশ্মীরের যে জীবন ফ্রেমবন্দি করে গিয়েছেন, তা অনন্য। সেটা ১৯৪০-এর দশকের কথা। অবশ্যই সেই পটভূমি আলাদা। সন্ত্রাসবাদ আর প্রতিরোধ-প্রতিবাদের ছায়া গ্রাস করেনি সে কাশ্মীরকে। কিন্তু যে-কালের পটভূমিকায় ইরফান ও নীলশ্রী কাশ্মীরকে ধরেছেন, তা প্রকৃত অর্থেই মন ভাল করে দেয়। প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক নবি কাশ্মীরের মানুষ। চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, কাশ্মীরকে চেনেন অন্তরাত্মা দিয়ে। নীলশ্রী আদতে কলকাতার, পরে তাঁর কাজের জায়গা হয় মুম্বই। নীলশ্রী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক।

কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে এই বইটিকে। স্থান ও প্রকৃতি, স্থাপত্য, ধর্মীয় স্থান, কাশ্মীরি হস্তশিল্প, কারুকাজ ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উপর সাদা-কালো ও রঙিন, অসাধারণ সব ফ্রেম উপহার দিয়েছেন ইরফান। নানা ভাবে জর্জরিত, বিষণ্ণ উপত্যকার বাইরের জীবনের উপর যে ভাবে আলো ফেলেছে নবির লেন্স তা কার্যত বিরল। ভূমিকায় নীলশ্রী লিখেছেন, তাঁর পড়ার টেবিলের উপরের দেওয়ালে একটা কাঠের বক টাঙানো থাকত, উড়ন্ত ভঙ্গিমার সেই বকটি কাশ্মীর থেকে উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর এক আত্মীয়া। সেই ছেলেবেলা থেকে কাশ্মীরের সঙ্গে নীলশ্রীরও আত্মীয়তার শুরু। তার পরে বহু বার কাশ্মীরে যাওয়া, পেশা ও নেশাগত কারণে। তাঁর অসামান্য ঝরঝরে লেখায় সত্যিই অন্য চেহারায় ধরা দেয় উপত্যকা।

মন ভাল আর খারাপ করা এই বই এ রকম অস্থির, রক্তাক্ত সময়কে পেছনে ফেলে দেওয়ার দলিলও বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Books Review Kashmir Pulwama Terror Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE