Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

কথোপকথনে বিকল্পের দিশা

শঙ্খ ঘোষের সাম্প্রতিক বই দু’টি বাক্‌-সংস্কৃতির জরুরি বিকল্প এক রূপের মুখোমুখি করে আমাদের। 

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ১৭:৪৬
Share: Save:

বাঙালির বাক্‌-সংস্কৃতির চেহারা নানা সময়ে নানা রকম ছিল। প্রাগাধুনিক কথকতার জগৎ উনিশ শতকীয় নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতার দাপটে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল, পৃষ্ঠপোষণার চরিত্রও বদলে যায়। মুদ্রণ-সংস্কৃতির উৎপাদক ও উপভোক্তা নব্য ভদ্রলোকেরা উনিশ শতকে বাক্‌-বৈদগ্ধ্যের আর একটি পরিসর গড়ে তোলেন। কথকতার বদলে মুখ্য হয়ে উঠল বক্তৃতা— গড়ে উঠল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বক্তৃতামঞ্চ। জাতি জাগানিয়া, পাব্‌লিক ‘খ্যাপানিয়া’ সেই বক্তৃতা মঞ্চের নানা রূপ-রূপান্তর এখন একুশ শতকেও চোখে পড়ে। চিৎকার প্রসারের জন্য, উচ্চকিত অভিনয়ের গমক বিস্তারের জন্য এখন বৈদ্যুতিন-মাধ্যম কত কিছু বরাদ্দ করেছে। ঘরে ঘরে সন্ধেবেলা চৌকো-বাক্স আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কথার জোর যার, মুলুকও যেন তার। তবে এর বাইরে কথার কি আর কোনও রূপ হয় না? শঙ্খ ঘোষের সাম্প্রতিক বই দু’টি বাক্‌-সংস্কৃতির জরুরি বিকল্প এক রূপের মুখোমুখি করে আমাদের।

প্রাজ্ঞ এই কবির ‘আঙুলের অপারগতা’ তাঁকে খানিক কলমচ্যুত করেছে, কিন্তু বাক্‌হারা তো করেনি। সাহায্য নিচ্ছেন তাই শ্রুতিলিখনের, কখনও বা লেখার বদলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সাক্ষাৎকার। নিজেই জানিয়েছেন তিনি, ‘‘মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবার সামনে কথা বলব, একটা সময় পর্যন্ত এটা আমি ভাবতেই পারতাম না।’’ তবু তাঁকে দিতে হয়েছে মৌখিক ভাষণ, নব্বইয়ের দশকে কখনও কখনও লিখিত ভাষণও পড়েছেন। যে হেতু মঞ্চ-বক্তৃতা সম্বন্ধে একরকম বিরক্তি ছিল মনে, সে হেতু তাঁর মৌখিক ও লিখিত ভাষণে বিনীত অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর কানে আসে। শ্রোতাদের সঙ্গে নিজের দূরত্ব ঘোচাবার জন্যই তাঁর আমিহারা হওয়ার সাধনা, মঞ্চের উচ্চতায় ডগমগ যে আমি তাকে শান্ত-শমিত করে আমিহারা কণ্ঠটি যেন প্রতি মুহূর্তে সামনের শ্রোতাদের সহযোগী সখা হয়ে উঠতে চায়। তবে যেটা বলার তা স্পষ্ট করে বলা চাই। আমি নেই, আবার আছেও। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’র সন্দীপ পলিটিক্যাল বক্তৃতায় দলচরদের মাতিয়ে তুলত, নেশার কুহকে রাঙিয়ে তুলত। আর নিখিলেশ কথা বলত নিচু স্বরে, কান পাতলে বোঝা যেত স্পষ্ট কথাই বলছে সে। তার পরিকল্পনা দেশ ও সমাজ সম্বন্ধে সুস্থির। নিখিলেশের এই বাক্‌ সাধনা যা রবীন্দ্রনাথেরই ব্যক্তিগত প্রয়াসের এক রকম প্রতিফলন তাই শঙ্খ ঘোষের বাক্‌-সংস্কৃতির আদর্শ। এই দুই বইতে তাঁর যে কণ্ঠস্বর সাক্ষাৎকারে, শ্রুতিলিখনে, মৌখিক ও লিখিত বক্তৃতায়, চিঠিপত্রে ধরা পড়েছে তা বিনত, স্পষ্ট ও অপরের কথা শোনার জন্য অপেক্ষমান। শুধু কথা নয়, এক রকম কথোপকথনের সম্ভাবনা তৈরি করে এই বই দুটি। একমাত্রিক চিৎকারের, কথা যার মুলুক তার সংস্কৃতির বিকল্প এই কথোপকথন এ দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজন।

বস্তুতপক্ষে এই বই দু’টি নানা কথা ও নানা মতের প্রকাশক্ষম গণতন্ত্রের আদর্শেই ভরসা রাখে। সেই ভরসার কথা ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অমর্ত্য সেনের মতো বাঙালির ভাবনার বিশ্লেষণে। কখনও কখনও আসে অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেনের কথা। বেশ খানিকটা অংশে কথোপকথন অগ্রসর হয়েছে জয়দেব বসুকে কেন্দ্র করে— জয়দেব জানতে চান ‘কেন তার পার্টি থেকে এত দূরবর্তী’ মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর শঙ্খবাবুকে চিঠিতে লিখেছিলেন জয়দেব, ‘‘সি পি আই (এম) ভয়ংকর দল। মৃত শত্রুও তার কাছে সহনীয় নয়।’’ তবু দল সম্বন্ধে বিমুখ হতে পারেননি জয়দেব। আর তাঁর মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষ জানেন ও মানেন কোনও কিছুই ‘সর্বশেষ অবলম্বন’ নয়। এ-কথাটা তিনি খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরই আরেক ছাত্রকে। ছাত্র প্রত্যয় বলেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ এখনও আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ অবলম্বন।’’ শঙ্খবাবুর মনে হয়েছে, ‘‘সর্বশেষ কথাটা হয়তো আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, কেননা তাতে একটা বন্ধন তৈরি হয়।’’ রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসেন তিনি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কোনও মৌলবাদ গড়ে তুলতে তিনি নারাজ। ‘‘মার্কস হতে পারেন, বা যে কেউ, আমার খুব বড়ো অবলম্বন। কিন্তু সর্বশেষ কথাটার মধ্যে একটা মৌলবাদের ভয় থেকে যায়।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কী ভাবে ঠেকানো যাবে মৌলবাদকে? এ বই দু’টিতে নানা উপায়ের কথা আছে। মৌলবাদকে প্রতিহত করার জন্য চাই সাংস্কৃতিক পরম্পরার নতুন নির্মাণ। রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে পড়া যেতে পারে। ১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্র যখন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ করলেন তখন বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে একটা বড় প্রতিবাদ হয়েছিল— ‘‘এর মধ্যে দিয়ে একটা কম্যুনিজমের প্রচার হচ্ছে, যা নাটকটায় নেই।’’ শম্ভু মিত্র বিশ্বভারতীর গুরুজনদের নাটক দেখতে আহ্বান করেছিলেন। ‘আয় রে ভাই, লড়াই-এ চল’ এ আহ্বান রবীন্দ্রনাথের নাটকে ছিল, তবে সে ডাক তো মোলায়েম করে দেওয়া যায় না। আর সে ডাক বলিষ্ঠ বিপ্লবমুখী হয়ে উঠলে যদি কেউ বলেন এ রবীন্দ্রনাথে নেই তা কিন্তু মানা যাবে না। মানলে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে গড়ে ওঠা মৌলবাদকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে।

লেখা যখন হয় না
শঙ্খ ঘোষ
২৪৯.০০, পত্রভারতী

স্কৃতিক পরম্পরার নতুন নির্মাণের পাশাপাশি মৌলবাদকে প্রতিহত করার জন্য যে কোনও ঘটনাকে বিচার করতে হবে নানা দিক থেকে। শঙ্খ ঘোষ বাংলাদেশে অ-মুসলমান (মূলত হিন্দু) মানুষদের উপর যে অত্যাচার হয়েছে তার সূত্রে লেখেন, ‘‘গত অক্টোবর (২০০১-এর) থেকে কমাস জুড়ে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে কথা বলাও আমাদের দায়িত্ব ছিল। সে-দায়িত্ব ঠিক সময়ে পালন করি না বলে মাঝামাঝি-মনের মানুষেরা চলে যান একেবারে উলটো শিবিরে, ভয়ের সম্ভাবনা আরো বাড়তে থাকে।’’ সেকুলার পন্থার ধুয়ো তুলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের কথা ভেবে অন্য দেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দুর্দশাকে গুরুত্ব না দিলে যে সেই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে মৌলবাদ, তা আজ খুবই টের পাওয়া যাচ্ছে। ধর্মান্ধরা তো নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে চমৎকার কাজে লাগান— ও দিকে ‘খ’ গোষ্ঠী ‘ক’ গোষ্ঠীকে মারছে বলে এ দিকে চাই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া! ‘ক’-রা এ দিকে ‘খ’-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। অথচ ও দিকে এবং এ দিকে ‘ক’ ‘খ’ উভয় পক্ষেই আছেন প্রতিবাদী মানুষ— গ্লানির প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে তাঁরা নেমে পড়েছেন কাজে।

না সে কাজ বক্তৃতা দেওয়া বা মিছিল করা নয়। বক্তৃতা আর মিছিলে ভরসা নেই নাগরিক পরিসরের প্রতিনিধি শঙ্খ ঘোষের। সাবির আর শুভাশিস দুই তরুণের উপর তাঁর অঢেল ভরসা। ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ নামের নিরন্তর এক উদ্যোগে বিশ্বাস করেন তিনি। অন্ধকার ভারতবর্ষে আমরা পরস্পরকে চিনি না, এই ছিল রবীন্দ্রনাথের খেদ। সেই খেদ দূর করার জন্য মোমিনপুর, খিদিরপুর, পার্ক সার্কাস, আসানসোলে ছড়িয়ে পড়ছে সাবিরদের উদ্যোগ। প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নিয়মিত মেলামেশার আয়োজন করা হচ্ছে— কারা কী খান, কী পরেন, কী উৎসব করেন তা জানা চাই। ইংরেজ আমলে একটা লব্জ ছিল, ইংরেজরা আমাদের করাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ইংরেজরা করাতে পারছে কী করে! তার মানে ভেতরে আছে, আছে বলেই বাইরের অনুঘটক কাজ করতে পারছে। এত দিন পরেও সে বিদ্বেষ মেটেনি বলে বাইরের অনুঘটক সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির পালে হাওয়া লাগাতে পারে। মিছিল-মিটিং করে নয়, তরুণ শুভাশিস অহর্নিশ এই দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য কাজ করেন। ছোট শহরে, গ্রামে গ্রামে ঘরোয়া পরিসরে ছোট ছোট আলোচনা, কথোপকথনের আয়োজন করেন তিনি। যোগ তৈরি হয় মানুষে-মানুষে।

মুখের কথা সভায়
শঙ্খ ঘোষ
২৫০.০০, পাঠক

এই যে কাজ, এই কাজের মধ্যে সমাজ আর ব্যক্তির সামঞ্জস্য থাকা চাই। মিটিং মিছিলে ব্যক্তি যায় মুছে, রাজনৈতিক সমাজই হয়ে ওঠে প্রখর। শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনাতেই আসলে দুটো তল পরস্পর স্পৃষ্ট হয়ে আছে। একদিকে, সমাজকে সে ছুঁয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে একেবারে সেই আমির কাছে সে পৌঁছে যাচ্ছে।’’ মিটিং-মিছিলে এই নিজের আমি যেন হারিয়ে যায়, ছোট ছোট মেলামেশার নিত্য দিনের পরিসরে আমি আর সমাজে, ব্যক্তি আর দলে ছোঁয়াছুঁয়ি বজায় থাকে। ব্যক্তিকে একেবারে মেরে ফেলে দলকে বা কাল্পনিক দেশকে বড় করে তোলার মধ্যে আত্মহননের নেশা পূর্ণ হয়, উপলব্ধির কলস শূন্যই থাকে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। পদাতিক সুভাষ কেমন করে ফকির হয়ে উঠলেন তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। ‘‘পদাতিকের পাশে থাকে তার দলবল, একলা নয় সে। ফকির চলে একা।’’ পদাতিক যুদ্ধজয়ের সংকল্পে দীপ্র। কিন্তু যুদ্ধ যদি সে না-জেতে? দলবল তখন চলে যায়। দলবল যেত না, যদি সমূহের মৌতাতে বুঁদ হয়ে না থেকে ব্যক্তির উপলব্ধিতে স্থিত থাকত তারা। সুভাষকে দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, ইনাম পেয়ে জাহান্নমে যাওয়া কবি বলে একদা রাজনীতির দলচরেরা প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ সুভাষকে তারা বিচার করে ভালবাসেনি। দলের কবি বলে মেনেছিল মাত্র। বিচারহীন মান্যতাকে গণতন্ত্র বলে না। বহুস্বরী বিচারশীল গণতন্ত্রের কথা, প্রশ্নশীল ভারতীয়ত্বের কথাই এই বই দু’টিতে ফিরে ফিরে আসে। গণতন্ত্র তো ফকিরের আলখাল্লার মতোই— নানা তাপ্পি নানা ফের-ফারে ভরা আমার এ দেশের বহুমাত্রিক বসনখানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Book Shankha Ghosh Book Review Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE