একদিন তো জোর বেঁচে গেলাম। যাচ্ছিলাম পি সি পাণ্ডের সঙ্গে দেখা করতে। বাংলোর গেটের কাছে পৌঁছে দেখি, একজন ছোটখাট পুলিশ অফিসার বেরিয়ে আসছে। এই অফিসারটা আমাকে রানা আইয়ুব বলেই চিনত। ভাগ্যিস সেদিন আমার চুলগুলো পরিপাটি বাঁধা ছিল, সাধারণত সেগুলো বেসামাল উড়তে থাকে। আর, আমার মুখটাও প্রায় অর্ধেক বাঁদনায় ঢাকা ছিল। আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাণ্ডে গেট পর্যন্ত এসেছিল। এদিকে তো আমার কপাল বেয়ে ঘাম, দেহের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। পাণ্ডে আমার অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ঠিক আছ তো, মৈথিলী?’ জবাব দিলাম, ঠিক আছি। এক মিনিট আগেই ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়ার টালমাটাল ভাবটা তখনও কাটেনি।’ যে কোনও তদন্তমূলক সাংবাদিকের জীবন-ই বিপদসংকুল; সে তদন্ত যদি হয় গুজরাত নামক এক ভারতীয় রাজ্যে, এবং সাংবাদিকটি যদি হন ধর্ম-পরিচয়ে মুসলমান এক নারী, আর সেই সঙ্গে তদন্তের বিষয় যদি হয় গুজরাতে ২০০২-এর গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, তা হলে কতটা বিপদের আশঙ্কা নিয়ে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। এক দিন বা এক সপ্তাহ নয়, রানা আইয়ুব এই বিপদের ভয়কে সঙ্গী করে কাটিয়েছেন পাক্কা আটটা মাস। ধরা পড়লে কী হত, সেটা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়— ধর্ষণ, জেল, গাদাখানেক মিথ্যা মামলা, এমনকী খুন হয়ে যাওয়াটাও ‘স্বাভাবিক’ বলে গণ্য হত। ‘স্বাভাবিক’, কেননা, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, যিনি আজ আক্ষরিক অর্থেই ভারতের সম্রাট, তাঁর কাছে ক্ষমতা সুনিশ্চিত করার জন্য সব কিছুই রাজধর্ম। এমনই এক স্বভাব-শাসকের রাজ্যে পরিচয় গোপন রেখে, পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে, বারংবার আস্তানা বদল করে ‘স্বাভাবিক’ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রানা-র আট মাস ধরে সংগৃহীত অভিজ্ঞতার ফসল তাঁর বই, গুজরাট ফাইলস। আশ্চর্য, এমন যার বাস্তব ভিত্তি, সে বইয়ের কোনও প্রকাশক জুটল না, নিজেকেই নিজের বই প্রকাশ করতে হল।
অথবা হয়তো, আশ্চর্য, নয়; তিনি যে কাগজের প্রতিনিধি হয়ে কাজটা করেছিলেন, এক সময় দেশে উথালপাথাল সাংবাদিকতার প্রচলন করা সেই তেহেলকা-ই তো তাঁর নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো ছাপতে ভয় পেল: রানা যে দিন মোদীর সঙ্গে দেখা করেন, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, এবং নিয়মমাফিক সেই খবর নিজের অফিসে জানান, সে দিনই সন্ধ্যায় তিনি অফিস থেকে একটা ফোন পান, ‘রানা, দিল্লি ফিরে এসো’। অফিসে তাঁকে তরুণ তেজপাল জানান, ‘বঙ্গারু লক্ষ্মণের স্টিং-এর পর ওরা তেহেলকা-র অফিস বন্ধ করে দেয়, এখন মোদী হতে চলেছেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, তাঁর গায়ে হাত দিলে আমরা শেষ।’ সুতরাং, যে তাড়না থেকে রানা আট মাস ধরে মৈথিলী ত্যাগী নামে উত্তরপ্রদেশের এক কায়স্থ বাড়ির মেয়ে হিসাবে নিজেকে সাজিয়ে, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট কনজারভেটরি থেকে গুজরাতের উন্নয়ন মডেল নিয়ে তথ্যচিত্র বানাবার গপ্পো তৈরি করে, সে রাজ্যের তাবড় তাবড় পুলিশকর্তা, আমলা, জননেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, এক চুল এদিক ওদিক হলেই সাক্ষাৎ শমনের পরোয়া না করেই, সেই সৎ সাংবাদিকসুলভ দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সংগৃহীত তথ্যগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে নিজেই নিজের বইটা ছেপেছেন।
বিপুল তথ্যসম্ভার, গুজরাতে গণ-নিধনের সময় রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্তমানে বিজেপি-র সভাপতি অমিত শাহের হাড়-হিম-করা ভূমিকা, শাসকদের শীর্ষ স্তরে পুলিশ অফিসার থেকে সহকর্মী পর্যন্ত বিভিন্ন লোককে ব্যবহার করে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার নির্বিকল্প নির্মোহ, কুকর্মসাধনে দলিত অফিসারদের পরিচিতিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগানো এবং কার্যোদ্ধার হয়ে গেলে তাঁদের নাম পর্যন্ত ভুলে যাওয়া, মোদীর নাম শোনামাত্র পুলিশ ও আমলাদের মুখাবয়ব নীরক্ত ধবল হয়ে ওঠার মতো নানান সাক্ষ্যের সমাহার এই বইতে। কী ভাবে একটা রাজ্য অনুক্ষণ সন্ত্রাসের ঘনান্ধকারে শাসিত হচ্ছিল, প্রতি ছত্রে তার ভয়ংকর বর্ণনা।
অবশ্য, বলতেই হয় যে, বইটা বই হয়ে ওঠা থেকে খানিক দূরেই থেমে গিয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলোকে যে ভাবে গুছিয়ে, সম্পাদনা করে একটা বর্ণনা গড়ে তুললে বইটা তুলনায় আগ্রহোদ্দীপক হতে পারত, রানা যে সেটা করেননি, তার একটা কারণ সম্ভবত তাঁর এই কাজের তাড়নার মধ্যেই নিহিত: যারা খুনি, ধর্ষক, যারা ক্ষমতার জন্য নৈতিকতার শেষবিন্দুটুকুও বিসর্জন দিতে পারে, তাদের চেহারাটা যত দ্রুত সম্ভব মানুষের সামনে তুলে ধরা, সে কাজটা যথার্থ শৈল্পিক হয়ে উঠল কি না সে চিন্তা না করেই। দেশ যখন এক মহা দুশ্চিন্তার শিকার, তখন, রচনাশৈলী নিয়ে ভাবতে বসাটা বিলাসিতা, অন্তত, রানার মতো সাংবাদিকের কাছে, যে সাংবাদিক জানেন কী ভাবে ভুয়ো সংঘর্ষের নামে সোহরাবুদ্দিন, ইশরত জাহানদের খুন করা হয়েছিল, যিনি জানেন, কী ভাবে গুজরাতেরই মন্ত্রী হরেন পাণ্ড্যকে খুন করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছিল তৎকালীন গুজরাতের শাসকরা, এবং যিনি নিজে হারিয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে, যে বন্ধু ‘দেশদ্রোহী’দের হয়ে আইনি লড়াই লড়বার অপরাধে খুন হন।
যা দেখব তাই লিখব, এটা যেমন ঠিক, তেমনই এটাও ঠিক যে দেখবার একটা প্রপীড়িত অভিজ্ঞতা লাগে। রানা সেটা মূল্য দিয়ে অর্জন করেছেন বলেই তাঁর লেখা এত প্রত্যক্ষ। আর এ মুহূর্তে, উপস্থাপনের সৌকর্য নয়, বিবস্ত্র রাজাকে ল্যাংটা বলাটাই লেখকের দায়। বইয়ের মুখবন্ধে বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণন যথার্থ বলেছেন, ‘রানা যে ভাবে সত্যকে দেখেছেন সেটাকে সে ভাবেই উদ্ঘাটিত করার জন্য তাঁকে বারংবার সেলাম জানানো দরকার’। তদন্তমূলক সাংবাদিকের কাছ থেকে যা প্রত্যাশিত, রানা তাঁর বইতে তার চেয়ে কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশি দিয়েছেন।
গুজরাত ফাইলস: অ্যানাটমি অব আ কাভার আপ। রানা আইয়ুব। ২৯৫.০০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy