Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

সিনেমার নাম ঠিক করে দিলেন নেতাজি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে ছবি তৈরি করেছিলেন জাপানি পরিচালক ইয়াসুজিরো ওজু। নেহরু ও পটেলের চেষ্টায় ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল— ‘নেতাজী সুভাষ’। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ককে নিয়ে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। আন্তর্জাতিক সিনেমা সাম্রাজ্যের অন্যতম সম্রাট— ‘লেট স্প্রিং’, ‘আর্লি সামার’, ‘টোকিয়ো স্টোরি’-খ্যাত ওজুই বটে। জাপানের সামরিক প্রচারচিত্রের অঙ্গ হিসেবে ছবিটা তৈরির বরাত পেয়েছিলেন তিনি।

অতীত: আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সিনেমার বিজ্ঞাপন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৪৮

অতীত: আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সিনেমার বিজ্ঞাপন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৪৮

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪৪। সিঙ্গাপুরের সংবাদপত্র ‘সিওনান শিমবুন’-এ একটা খবর বেরোল। তাতে লেখা, আগামী মঙ্গলবার ক্যাথে বিল্ডিং-এর মাথার ওপরে তিন দফায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়তে দেখা যাবে। কেউ যেন বিভ্রান্ত না হন। একটি ছবির শুটিং-এর জন্য যুদ্ধ-পূর্ব সিঙ্গাপুর দেখানো দরকার। শুটিংয়ের প্রয়োজনেই পতাকা উড়বে। দু’দিন পরের কাগজ আবার জানাল, খারাপ আবহাওয়ার জন্য মঙ্গলবার নয়, শুটিং শুরু হচ্ছে বুধবার থেকে। কী সে ছবি? ‘অন টু দিল্লি’! বিষয়, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে ভারতের মুক্তি সংগ্রাম। ছবিটি পরিচালনা করছেন জাপানি চিত্রপরিচালক ইয়াসুজিরো ওজু!

আন্তর্জাতিক সিনেমা সাম্রাজ্যের অন্যতম সম্রাট— ‘লেট স্প্রিং’, ‘আর্লি সামার’, ‘টোকিয়ো স্টোরি’-খ্যাত ওজুই বটে। জাপানের সামরিক প্রচারচিত্রের অঙ্গ হিসেবে ছবিটা তৈরির বরাত পেয়েছিলেন তিনি। অভিনয়ে প্রবাসী ভারতীয়রাই ছিলেন। যুদ্ধে জাপানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরে, ওজুর দাবি, সে ছবি তিনি নষ্ট করে ফেলেন। ফলে এ নিয়ে তেমন আলোচনা আর হয়নি। এ রকম একটা ছবি যে হচ্ছিল, ডোনাল্ড রিচি বা উচেয়ং চু-এর ওজু-জীবনীতে তার উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালেও জাপানি ভাষায় ওজুকে নিয়ে নোবোরি শিগেকি-র যে বই বেরিয়েছে, সেখানেও আছে। সর্বত্রই ওজুর বয়ানকে সূত্র ধরে লেখা হয়েছে, ছবিটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত নথি বলছে, ছবিটা নষ্ট হয়নি। সে ছবি ভারতেই ফিরে এসেছিল। প্রায় অনালোকিত সেই ইতিহাস অনেকাংশে উদ্ধার করতে পেরেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। চমকপ্রদ সেই কাহিনিতে ওজুর সঙ্গে এক সূত্রে গাঁথা সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু এবং বল্লভভাই পটেল। আইএনএ, ভারতের স্বাধীনতার লড়াই এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতের নানা পরত নিহিত তার মধ্যে।

ওজুর ছবি যে জীবিত, সেই তথ্যটি খুঁজে বার করার কৃতিত্ব সিঙ্গাপুরের চলচ্চিত্র গবেষক এবং ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট তো হান পিং (Toh Hun Ping)-এর। সিঙ্গাপুরের আর্কাইভে পুরনো সংবাদপত্র ঘেঁটে হান পিং সম্প্রতি দেখতে পান, ওজুর তোলা ছবি প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে গচ্ছিত ছিল। ১৯৪৬ সালে সিঙ্গাপুর ও মালয় সফররত নেহরুর হাতে সেটি তুলে দেওয়া হয়। এ তথ্য হান পিং আনন্দবাজারকেই জানিয়েছেন সর্বপ্রথম। সিঙ্গাপুরের নথির হদিসও তিনি দিয়েছেন। তবে নেহরুর হাতে যাওয়ার পর ছবিটির কী হল, হান পিং-ও জানতেন না সবটা। কারণ, তার জন্য ভারতীয় নথি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ভারতের নথি বলছে, সে ছবি ভারতে শুধু আসেইনি, বল্লভভাই পটেলের উদ্যোগে ছবিটি সম্পূর্ণ হয়। পূর্ণাঙ্গ ছবিটি ‘নেতাজী সুভাষ’ নামে ১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি, অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের প্রথম নেতাজি জয়ন্তীতে মুক্তি পায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সে ছবির বিজ্ঞাপনে (কখনও ‘সুভাস’, কখনও ‘সুভাষ’ বানানে) লেখা, ‘আজাদ হিন্দ সরকার প্রযোজিত এবং বল্লভভাই পটেল পুনঃপ্রযোজিত’। সুতরাং এ ছবিই যে ওজুর আরব্ধ ছবি, তা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

অথচ জাপানি ফিল্ম পত্রিকায় ওজু কিন্তু নিজে বলেছিলেন, ছবি এবং ছবির চিত্রনাট্য তিনি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। এও বলেছিলেন, ‘‘ছবিটা আমার উপযুক্ত ছিল না। আমি ওটা বানাতেও খুব উৎসাহী ছিলাম না।’’ মূলত কর্তৃপক্ষের হুকুমই তামিল করছিলেন তিনি। কিন্তু ছবি তো দেখাই যাচ্ছে, নষ্ট হয়নি! ওজু কি তবে ইচ্ছে করেই সত্য গোপন করেছিলেন? যুদ্ধশেষের দিনগুলোয় ‘অক্ষশক্তির প্রচারচিত্র’ জমিয়ে রাখাটা তাঁর পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারত। ছবিটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে চাউর করে দিয়ে তিনি কি গোপনে কারও হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন ফিল্মটা? স্পষ্ট নয় সে সব।

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে এমনিতে সিনেমার যোগাযোগ অনেক দিনের। জনমনে প্রভাব বিস্তার করার কাজে চলচ্চিত্র যে অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, বিশ-তিরিশের দশক থেকেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বও তা উপলব্ধি করছিলেন। সিনেমা-করিয়েদের মধ্যেও সেন্সর বাঁচিয়ে ছবিতে দেশপ্রেম ও সামাজিক আন্দোলনের বার্তা দেওয়ার ঝোঁক ছিল। সুভাষচন্দ্রও সিনেমার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিলেন না। ইউরোপে থাকাকালীন সময় পেলেই সিনেমা দেখতে যেতেন। কলকাতায় ‘বম্বে টকিজ’-এর ছবির প্রিমিয়ারে হাজির হওয়া, লাহৌরে স্টুডিয়ো উদ্বোধন, এ সবে ‘না’ করতেন না। ১৯৩৯-এ ফরিদপুরে চলচ্চিত্র সম্মেলনের সময়ে তিনিই কংগ্রেস কর্মী কালীশ মুখোপাধ্যায়কে ‘রূপমঞ্চ’ পত্রিকা প্রকাশের পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সিনেমা সর্বত্রই প্রচারের খুব বড় হাতিয়ার হয়ে উঠল। সব পক্ষই তেড়েফুঁড়ে নামল তাকে কাজে লাগাতে। তারই মধ্যে ১৯৪১-এ সুভাষের মহানিষ্ক্রমণ। প্রথমে জার্মানি, পরে জাপানের সঙ্গে মিত্রতা এবং ১৯৪৩-এর জুলাইয়ে সিঙ্গাপুরে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ। তার আগেই ১৯৪২-এ সিঙ্গাপুর এবং মায়ানমার অর্থাৎ সাবেক বর্মার দখল ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে জাপান। সিঙ্গাপুরের নাম তখন সিওনান।

এর মধ্যে ওজু এসে পড়লেন কী ভাবে? জাপানি পরিচালকদের অনেককেই তখন টেনে নেওয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনীতে। ওজুও সেই দলে ছিলেন। যুদ্ধের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যদিও আরও পুরনো। ১৯২৪-২৫ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধেও তাঁকে দু’বছর (১৯৩৭-১৯৩৯) রণক্ষেত্রে কাটাতে হয়। ফিরে সবে কিছু দিন সিনেমার কাজে মন দিয়েছেন, ‘দেয়ার ওয়জ় এ ফাদার (১৯৪২)’ ছবিটা শেষ করেছেন, ফের যুদ্ধে ডাক। না বলার জো নেই। তবে এ বার সেনাবাহিনী নয়, জাপান সরকার ওজু-কে বহাল করল সামরিক প্রচারধর্মী চিত্রপরিচালনার কাজে।

নোবোরি শিগেকি-র বইয়ে ‘সিঙ্গাপুরে ওজু’ নামে যে পরিচ্ছেদ রয়েছে, সেটা গুগল-অনুবাদে পড়ে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ১৯৩৯ সাল থেকেই জাপানে আগাম সেন্সরশিপের ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। মানে, চিত্রনাট্য লেখার পরে তা সেন্সরের ছাড়পত্র পেলে তবে শুটিং হবে। যুদ্ধের বাজারে তখন ফিল্ম স্টকের টানাটানি। সুতরাং ছবি যা তৈরি হবে, তা যাতে জাপানের সরকারি নীতির প্রচারে কাজে লাগে, সেটা বিশেষ ভাবে দেখা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে তিনটি বড় স্টুডিয়োকে বেছে নেওয়া হল, যারা জাপানের রণসাফল্যের ছবি তুলবে। একটি স্টুডিয়োকে দেওয়া হল সিঙ্গাপুরের যুদ্ধ নিয়ে ছবি তৈরির ভার, আর একটি স্টুডিয়ো পেল ফিলিপিন্সের বরাত। আর শোচিকু স্টুডিয়ো, যেখানে ওজু কাজ করতেন, তার ওপরে ন্যস্ত হল বর্মা ফ্রন্টের কাহিনিচিত্র তৈরির দায়িত্ব। ওজুই তার ভার পেলেন। দু’জন চিত্রনাট্যকারকে সঙ্গে নিয়ে চিত্রনাট্যও লিখে ফেললেন। কিন্তু

সে ছবি হয়নি শেষ পর্যন্ত। তার বদলে ওজুকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সিঙ্গাপুরে। পৌঁছনোর দিন দশেক বাদে চলে এলেন ক্যামেরাম্যান ইউহারু আতসুতা। ওঁদের বলা হল, জাপানি কর্তৃপক্ষ চাইছেন, আইএনএ নিয়ে একটা ছবি হোক। এটা ১৯৪৩-এর জুন মাসের কথা। ওই সময়েই টোকিয়োতে জেনারেল তোজো-র সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বৈঠক হয়েছে। জুলাইয়ের গোড়ায় সুভাষচন্দ্র নিজে সিঙ্গাপুর পৌঁছে আইএনএ-র দায়িত্বভার নেন।

চলচ্চিত্র গবেষক পিটার বি হাই এবং নোবোরি শিগেকি দুজনেই জানিয়েছেন, সুভাষের সঙ্গে অন্তত এক বার সরাসরি কথা হয়েছিল ওজুর। ওঁরা একসঙ্গে বসেই ঠিক করেন, বর্মা হয়ে আইএনএ-র ভারতে পৌঁছনোর কাহিনি চিত্রায়িত করা হবে। ছবির নাম ‘অন টু দিল্লি’ সুভাষই ঠিক করে দেন। ঠিক কবে ওঁদের এই আলোচনা হল, সেই তারিখটা অবশ্য পরিষ্কার নয়। তবে সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটার ভবনই ছিল মূল কর্মকেন্দ্র। সেখানেই সুভাষ তাঁর প্রথম জনসভা করেন। ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাও হল ক্যাথে থিয়েটারে। ওই বাড়িতেই আজাদ হিন্দ সরকারের বেতারকেন্দ্র এবং একাধিক দফতরের কার্যালয়। ওই বাড়ির ছ’তলাতেই ওজুর অফিসঘর। আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব প্রেস ও প্রচারবিভাগ তো ছিলই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দেওয়া হত নিয়মিত। সরকারের রাম সিংহ ঠাকুরীর নেতৃত্বে আইএনএ অর্কেস্ট্রার কথা সকলেরই জানা।

সিওনান শিমবুন-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৪ সালের ১ মে আজাদ হিন্দ সংবাদপত্রের উদ্যোগে ‘অন টু দিল্লি’ নামে একটি নাটকের অভিনয় হচ্ছে সিওনান কোকাইডো প্রেক্ষাগৃহে। এমনকি যুদ্ধের একেবারে অন্তিম লগ্ন— ১৯৪৫-এর ১৪ অগস্টও লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনভিত্তিক একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন ঝাঁসির রানি বাহিনীর মেয়েরা। সুভাষচন্দ্রের সে দিন শরীরটা জুত নেই। দাঁত তোলা হয়েছে। ওই অবস্থাতেই তিনি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন (সুগত বসুর বই ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ় অপোনেন্ট’ দ্রষ্টব্য)।

ওজুর ছবি কী ভাবে এগোচ্ছিল? খুব বেশি তথ্য মেলেনি। মূল শুটিং শুরু করতে ১৯৪৪-এর ডিসেম্বর গড়িয়ে গেল কেন? আন্দাজ করা যেতে পারে, খেপে খেপে কাজ হচ্ছিল হয়তো। হয়তো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াও কিছু কিছু শুটিং স্বাধীন ভাবে করছিলেন ওজু। কারণ শিগেকি লিখেছেন, তিনি প্রথম কিছু দিন সেনা ব্যারাক, সেনা প্রশিক্ষণের ছবি তুলছিলেন। ব্রিটিশ বন্দিদের কাজে লাগিয়ে ১৯৪২-পূর্ব সিঙ্গাপুরের ছবি দেখাতে ব্রিটিশ সেনার টহলের দৃশ্যও তোলা হয়। আর ওজুর জীবনীকারেরা প্রায় সকলে এক বাক্যে এ-ও লিখছেন যে, ওজু সিঙ্গাপুরের সময়টা অনেকটাই কাটাচ্ছিলেন নিজের মতো করে। বই পড়ে, টেনিস খেলে, দেদার সিনেমা দেখে। ১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে শুটিং থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট— ইম্ফল অভিযান ব্যর্থ হওয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মাটিতে অন্তত জাপান আর যুদ্ধ চালাতে আগ্রহী নয়, এটা স্পষ্ট হওয়ার পরেও ছবির কাজ পুরোদমে চলছিল। তার কারণ সম্ভবত এই যে, সুভাষচন্দ্র তথা আইএনএ-র মনোবলে তখনও চিড় ধরেনি। ১৯৪৪-এর ডিসেম্বরেও সুভাষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাইপেই, সায়গন আর সিঙ্গাপুর থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যাবে।

অবস্থা বদলাতে শুরু করল ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারি থেকে। ১০ ফেব্রুয়ারি বর্মার মিয়াং-এ আইএনএ হাসপাতালে বোমা ফেলল আমেরিকা। ২৬ তারিখের মধ্যে ব্রিটিশ বাহিনীও এগিয়ে এল অনেকটাই। এপ্রিলে বন্দি হলেন প্রেম সেহগল, মে মাসে শাহনওয়াজ খান আর গুরবক্স সিং ধিলোঁ। কিন্তু আইএনএ-র তৃতীয় গেরিলা ডিভিশন প্রস্তুত মালয়ে। সুভাষচন্দ্র ব্যাঙ্কক হয়ে মালয়ে এলেন। সেখান থেকে ফের সিঙ্গাপুর। ৪ জুলাই-এর বার্ষিকীতে সেখানে বিরাট অনুষ্ঠান হল। সুভাষের তখনও ধারণা, আরও একটা বছর সময় তিনি পাবেন। যুদ্ধের গতি বদলে দেওয়া যাবে। কিন্তু তা আর হল না। নাগাসাকিতে পরমাণু হামলার পরের দিন, অর্থাৎ ১০ অগস্ট সোভিয়েট রাশিয়ার বাহিনী জাপানে ঢুকে গেল। ১১ তারিখ কুয়ালা লামপুরে বসে সুভাষ খবর পেলেন, জাপান আত্মসমর্পণ করবে। ১২ তারিখই সিঙ্গাপুর ফিরলেন তিনি। ঝাঁসি বাহিনীর মেয়েদের নিরাপদে বাড়ি ফেরানোই তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা তখন।

ওজুর শুটিং সম্ভবত আরও খানিক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শিগেকি-র লেখা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে, জাপানের জয়ের আশা নিভে আসছে বোঝামাত্র ওজু শুটিং বন্ধ করেন। তখনও জাপান থেকে ইউনিটের আর একটা টিম আসা বাকি। ওজু ক্যামেরাম্যান আতসুতাকে বললেন, ‘‘টেলিগ্রাম করে ওদের আসতে বারণ করে দাও।’’ কিন্তু সে টেলিগ্রাম পৌঁছনোর আগেই জাপান থেকে জাহাজ ছেড়ে দেয়। আতসুতা পরে বলেছিলেন, ‘‘ওজুকে অত রেগে যেতে আর কখনও দেখিনি! চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোমার আক্কেলটা কী? এখন যদি মাঝসমুদ্রে জাহাজটা ওরা ডুবিয়ে দেয়, কী হবে ভেবেছ?’’ জাহাজ অবশ্য এসে পৌঁছয় নিরাপদেই। তবে জাপান থেকে সিঙ্গাপুর আসা ওটাই শেষ জাহাজ বিশ্বযুদ্ধে।

গোটা ইউনিট মজুত, কিন্তু কোনও কাজ নেই। ক্যাথে বিল্ডিং-এই ছিল হলিউডি ছবি ‘সিজ়’ করার দফতর। আতসুতা স্ক্রিনিং রুমটা সামলাতেন। ওজুরা লুকিয়ে সেখানে প্রচুর ছবি দেখতে থাকলেন। কেউ তদারকি করতে এলে বলা হত, প্রোজেক্টর পরীক্ষা করা হচ্ছে। ‘সিটিজেন কেন’, ‘স্টেজকোচ’, ‘হাউ গ্রিন ওয়জ় মাই ভ্যালি’, ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’, ‘গ্রেপস অব র‌্যাথ’, ‘উদারিং হাইটস’, এই সময়েই ওজুর এই সব ছবি দেখা। একই সঙ্গে কিছু দিন তিনি সামরিক সংবাদ সংস্থার কাজেও যুক্ত ছিলেন।

১৫ অগস্ট আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল জাপান। সে দিনই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুর ছাড়লেন। ১৭ সকালে ব্যাঙ্কক, সেখান থেকে সায়গন। সায়গন থেকে বিকেলে আবার উড়ান। ১৮ তারিখ সকালে তাইহোকুতে থামা হল। সরকারি বয়ান অনুযায়ী, দুপুর দু’টো নাগাদ তাইহোকু থেকে ফের ওড়ার পরেই দুর্ঘটনা। ১৭ তারিখেও ভারতীয়দের উদ্দেশে নেতাজির বার্তা ছিল, ‘‘এই ব্যর্থতা সাময়িক। দিল্লি পৌঁছনোর অনেক রাস্তা আছে।’’ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বদলে গেল সব কিছু।

সেপ্টেম্বরে সিঙ্গাপুর এবং মালয়ে অস্ত্র সমর্পণ করল জাপান। দ্বীপগুলির দখল তখনকার মতো আবার গেল ব্রিটেনের হাতে। ওজু ও তাঁর পুরো টিমকে কিছু দিন অসামরিক ডিটেনশন শিবিরে থাকতে হল। সিঙ্গাপুরেই জুরং শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। সেখানে প্রায় ছ’হাজার জাপানির আশ্রয় তখন। প্রথম কিছু দিন ওজু রবারের খেতে কাজ করতেন, পরে ওখানেই একটা খবরের কাগজে যোগ দেন। ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি জাপানে ফেরেন। সে দেশ তখন মার্কিন ‘অকুপেশন’-এ।

ভারতের ভাগ্যাকাশেও ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন। নেতাজি জীবিত না মৃত, তাই নিয়ে নানা জনের নানা জল্পনা। আইএনএ সদস্যদের বিচারকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলন। ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে কংগ্রেস কর্মসমিতির বৈঠকে ঠিক হল, নেহরু শীঘ্রই কংগ্রেসের প্রতিনিধি হয়ে বর্মা, সিঙ্গাপুর ও মালয় যাবেন। সেখানকার অগণিত ভারতীয় অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছেন। তাঁদের অবস্থা খতিয়ে দেখা, তাঁদের সাহায্য করাই হবে কংগ্রেসের লক্ষ্য। সে জন্য ‘আইএনএ এনকোয়ারি অ্যান্ড রিলিফ কমিটি’ নামে আলাদা একটি কমিটি গড়া হল। কমিটির চেয়ারম্যান হলেন বল্লভভাই পটেল। ১৯৪৬-এর ১৮-২১ মার্চ সিঙ্গাপুর ও মালয় সফরে গেলেন নেহরু। ২১ মার্চের আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হল, ‘‘রয়টারের বিশেষ সংবাদদাতা জানাইতেছেন, পণ্ডিত নেহরুর সিঙ্গাপুরে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সিঙ্গাপুরে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। গত কল্য অধিক রাত্রি পর্যন্ত সহস্র সহস্র মালয়ী, ভারতীয় নরনারী আফলেফী হোটেলের বহির্ভাগে সমবেত হয়। পণ্ডিত নেহরু এই স্থান হইতে জনতার উদ্দেশে সংক্ষেপে বক্তৃতা করেন। অদ্য প্রাতঃকালে তিনি পুনরায় এক বৃহৎ জনমণ্ডলীর নিকট দর্শন দেন।...সিঙ্গাপুরের পত্রিকাসমূহে তাঁর আগমন সংবাদ চিত্রসহ ফলাও করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।’’

সিঙ্গাপুরের আর্কাইভ এবং সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলছে, এই সফরেই নেহরুর হাতে আসে ওজুর অসমাপ্ত, অসম্পাদিত ছবি। নেহরু ভারতে ফেরার পরে ছবিটি শেষ করার দায়িত্ব নেন বল্লভভাই পটেল। ১৯৪৬-এর ৯ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরের ‘ইন্ডিয়ান ডেইলি মেল’ কাগজে রয়টার-এর খবর— ‘‘সর্দার পটেলকে এ বার ফিল্ম প্রযোজকের ভূমিকায় দেখা যাবে। নেতাজি সুভাষ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির কাজে হাত দিয়েছেন তিনি। পটেলের হয়ে প্রযোজনার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন নাথলাল পারেখ।’’ নাথলালকে উদ্ধৃত করেই সেখানে জানানো হচ্ছে, ‘‘এ ছবির অনেকটা সিঙ্গাপুরে ‘অন টু দিল্লি’ নামে তোলা হয়েছিল। নেহরুর সাম্প্রতিক সফরে সেই অসমাপ্ত ছবি তাঁর হাতে তুলে দেন মালয়ের এক ভারতীয় স্বাধীনতা-যোদ্ধা। ২১ অক্টোবর নেতাজির আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের তৃতীয় বার্ষিকীতে ছবিটি সম্পূর্ণ করে ভারতে মুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’

কে এই নাথলাল? মুম্বইয়ের কংগ্রেস নেতা। বনেদি হিরে-ব্যবসায়ী। অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। নাথলাল একাধারে বল্লভভাই পটেল এবং নেতাজির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বল্লভভাইয়ের দাদা বিঠলভাই যখন ইউরোপে অন্তিম শয্যায় (১৯৩৩), তখন সুভাষচন্দ্র ইউরোপে। তিনিই বিঠলভাইয়ের দেখাশোনা করছিলেন। নাথলাল খবর পেয়ে ছুটে যান। কিন্তু বিঠলভাইকে বাঁচানো যায়নি। বিঠলভাই সুভাষকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। নিজের সঞ্চিত অর্থের একটা বড় অংশ তিনি দেশের কাজে খরচ করার জন্য সুভাষকে দিয়ে গিয়েছিলেন। নাথলাল নিজে সে কথা লিখেওছেন। তবে পরে সেই উইল নিয়ে সুভাষের সঙ্গে বল্লভভাইয়ের মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল। কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও দু’জনের বিশেষ হৃদ্যতা ছিল না। তবে নাথলালের সঙ্গে সুভাষের সম্পর্ক তাতে কোনও ভাবে চিড় খায়নি। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নাথলাল প্রায়ই ইউরোপ, বিশেষত অ্যান্টয়র্পে যেতেন। সেখানে তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন সুভাষ। আইএনএ-পর্বেও সুভাষের দূত নাথলালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাইহোকু-অধ্যায়ের পরে বল্লভভাই-ও আইএনএ সদস্যদের পুনর্বাসন, সুভাষের স্ত্রী-কন্যার খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। চিত্রপ্রযোজক হওয়ার সিদ্ধান্তও ওই সময়েরই। তবে ১৯৪৬-এর অক্টোবর নয়, নাথলালের তদারকিতে ছবি শেষ হতে আরও কিছুটা সময় লেগে গেল।

ছবিটা দেখার সুযোগ বর্তমান প্রতিবেদকের হয়নি। সেটা এখন কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছে, তা-ও অজানা। তবে ছবিতে কী ছিল, সে সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে ৯ মার্চ ১৯৪৭-এর আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। সেখানে লেখা হচ্ছে, ‘‘সর্দার বল্লভভাই পটেলের প্রযোজনায় নির্মিত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু নামে একটি ৮ হাজার ফিট দীর্ঘ ফিল্ম অদ্য প্রাতে (৫ মার্চ) পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পটেল ও কেন্দ্রীয় পরিষদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে প্রদর্শিত হয়। হরিপুরা কংগ্রেস হইতে আরম্ভ করিয়া নেতাজীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হইয়াছে। ত্রিপুরী কংগ্রেসের ঘটনাবলী, ভারতবর্ষ হইতে নেতাজীর অন্তর্ধান, বার্লিনে অবস্থান, সিঙ্গাপুরে নেতাজীর পৌঁছানর দৃশ্য, কর্নেল ভোঁসলে এবং রাসবিহারী বসু কর্তৃক সম্বর্ধনা, ভারতীয়দের বিরাট সভা, আজাদ হিন্দ ফৌজের কুচকাওয়াজ, সাংহাই, টোকিও ও আন্দামানে নেতাজীর গমন, ইম্ফলে কর্মোদ্যম প্রভৃতি এই চলচ্চিত্রে সুন্দর ভাবে দেখান হইয়াছে। উক্ত ফিল্মের অধিকাংশ দৃশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গ্রহণ করা হয় এবং ভারতে সম্পাদিত হয়। চিত্র নির্মাণ কার্যের অধিকাংশই শ্রীযুত নাথলাল পারেখ পরিচালনা করিয়াছেন।’’ এর পর কলকাতায় ১৯৪৮-এর ৯ জানুয়ারি বীণা সিনেমা হলে ছবিটা সাংবাদিক ও বিশিষ্ট জনেদের দেখানো হয়। ‘যুগান্তর’ ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে লেখে, ‘‘হরিপুরা, ত্রিপুরী কংগ্রেস থেকে শুরু করে নেতাজির বিশ্বময় চাঞ্চল্যকর অভিযানকে কেন্দ্র করে চিত্রটি গ্রথিত হয়েছে। এই জাতীয় ডকুমেন্টারি আমাদের দেশে নেই বললেও চলে। নেতাজি যখন ঘোষণা করলেন, দিল্লি চলো, বা তুম হমকো খুন দো, ম্যায় তুমহে আজাদি দুঙ্গা, সেই সময় চক্ষু সত্যই অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। যাঁরা নেতাজির মুখের কথা শুনতে চান, ছবিখানি তাঁদের সকল দিক দিয়েই তৃপ্তি দেবে। (দ্র. ‘সোনার দাগ’, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ)।’’

১৯৪৮-এর ২৩ জানুয়ারি। স্বাধীনতার পরের প্রথম জন্মজয়ন্তীতে কলকাতা নেতাজিময়। আগের বছর অরোরা ‘জয়তু নেতাজী’ নামে একটি তথ্যচিত্র দেখিয়েছিল। এ বার মুক্তি পেল ‘সিপাহী কা সপনা’, ‘মুক্তির অভিযান’। ‘জয়তু নেতাজী’ও দেখানো হল ফের। মেগাফোন-কলম্বিয়া-হিন্দুস্তান রেকর্ডস বার করল আইএনএ-র গানের রেকর্ড। সেনোলা থেকে বেরোল নেতাজিকে নিয়ে শ্রুতিনাটক। শ্রী সিনেমা হলে কলকাতার মেয়র সুধীর রায়চৌধুরীর উদ্যোগে মঞ্চস্থ হল নাটক ‘২৩শে জানুয়ারি’। রাম সিংহ ঠাকুরী তাতে যোগ দিলেন। আর এ সবের সঙ্গেই ১৪টি চিত্রগৃহে মুক্তি পেল ‘নেতাজী সুভাষ’। আইএনএ-র মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খান এবং মেয়র সুধীরবাবু এ ছবির উদ্বোধন করেন। প্রথম সপ্তাহের প্রথম ও শেষ প্রদর্শনীর বিক্রীত অর্থ আজাদ হিন্দ ফৌজের শহিদদের দুঃস্থ পরিবারের সাহায্যার্থে দেওয়া হয়।

ওজু সম্ভবত এ সবের কিছুই জেনে যাননি। তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে আজও ‘অন টু দিল্লি’ একটি অসমাপ্ত এবং বিলুপ্ত ছবি হয়েই থেকে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Yasujiro Ozu Subhas Chandra Bose
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE