Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দানবের বয়স ২০০

১৮১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল মেরি শেলির উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’। বইটা নিয়ে চর্চা আজও, কিন্তু স্রষ্টাকে নিয়ে? ১৮১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল মেরি শেলির উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’। বইটা নিয়ে চর্চা আজও, কিন্তু স্রষ্টাকে নিয়ে?

সৃষ্টি: ১৯৩১-এর হলিউড-ছবির কুখ্যাত দানব।

সৃষ্টি: ১৯৩১-এর হলিউড-ছবির কুখ্যাত দানব।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

চলচ্চিত্র-দুনিয়ায় একটা কথা চালু আছে, প্রথম ছবি তাও করে ফেলা যায়, দ্বিতীয় ছবি বানাতে পারলে কি না, সেটাই আসল কথা। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। প্রথম বই লিখে ফেললাম, প্রকাশিত হল, রমরমিয়ে চললও হয়তো। কিন্তু একই সাফল্য, একই কীর্তি পুনরাবৃত্তি হল কি না, আসল পরীক্ষা তাতেই। নইলে লোকে ‘ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার’ বা ‘ওয়ান বুক অথর’ বলে দেগে দেয়।

মেরি শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ও কি তাই? একক, একমাত্র একটি কীর্তি? দু’শো বছর আগে জানুয়ারিতেই বেরিয়েছিল যুগান্তকারী সেই উপন্যাস, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও তাঁর ব্যর্থ সৃষ্টির কাহিনি। ১৮১৬ সালের গ্রীষ্মে জেনেভা লেকের ধারে এক ঝড়জলওলা রাতে মোমের আলোয় সবাই মিলে জার্মান ভূতের গল্প পড়া, সেখানেই ঠিক হল, প্রত্যেকেই একটা করে ভূতের গল্প লিখবে। দিন যায়, মেরির মাথায় কোনও প্লট আসে না। মাসখানেক পর, জুনের এক বিনিদ্র মধ্যরাতে সত্যিই ভূত চাপল মাথায়। ‘দেখলাম, বিবর্ণ মুখের তরুণ ছাত্রটি হাঁটু গেড়ে বসে আছে তার সৃষ্টির পাশে। দেখলাম, আকারে মানুষের মতো কিন্তু কুৎসিত এক প্রেত পড়ে আছে, আর কী এক আশ্চর্য শক্তির জোরে তার দেহে দেখা যাচ্ছে প্রাণের স্পন্দন, জেগে উঠছে সে...’ ডায়েরিতে লিখেছিলেন মেরি। এক বছর ধরে লেখা হল সেই গল্প, বেরল তারও এক বছর পর। বাকিটা ইতিহাস।

দু’শো বছর পর আজও মেরির লেখা বই জন্ম দিচ্ছে একের পর এক ডিসকোর্স। পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠক্রমে নেই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন! নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নারীবাদী, ইকো-ক্রিটিক, সাইকোঅ্যানালিস্ট— সব তত্ত্ব, সব ভাবনার অনুঘটক এই ‘হরর স্টোরি’। আর কাহিনির মূলে যেহেতু এক তরুণ ‘বিজ্ঞানী’র নতুন প্রাণ সৃষ্টির অ-সাধারণ কীর্তি, তাই স্বাভাবিক ভাবেই উপন্যাসে সমালোচকরা খুঁজে পেয়েছেন উনিশ শতকের গণিত ও অ্যালকেমি চর্চা, সমসাময়িক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভাবনা।

মনে রাখতে হবে, আঠারো বছরের মেরি যখন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন লিখছেন, তখনও ইংল্যান্ডে ‘সায়েন্টিস্ট’ শব্দটারই চল হয়নি। প্রাকৃতিক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপারস্যাপার পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করতেন যাঁরা, তাঁদের বলা হত ‘ন্যাচরাল ফিলসফার’। সে কালের দুই র‌্যাডিকাল দার্শনিক, উইলিয়াম গডউইন আর মেরি উলস্টোনক্রাফ্ট-এর মেয়ে মেরি বাড়ি বসেই বিস্তর পড়াশোনা করেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন পিতৃবন্ধু, রসায়নবিদ হামফ্রি ডেভি-কে, নিজের ডায়েরিতে নোট নিচ্ছেন লুইগি গ্যালভানির আবিষ্কার— মৃতদেহের স্নায়ুর ভিতর দিয়ে কী করে তড়িৎ-স্রোত পাঠানো যায়— সেই গ্যালভানিজম নিয়ে। ১৮১৮-তে প্রকাশিত বইয়ের আরও দু’টো সংস্করণ বেরিয়েছিল পরে, তার একটায় মেরি রীতিমত জোর দিয়ে ব্যবহার করেছেন ‘ইলেকট্রিসিটি’-র, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের জোড়াতালি দিয়ে বানানো মানুষের শব জ্যান্ত হয় সেই বিদ্যুৎ-চমকেই। পুরো বিশ শতক জুড়ে হলিউড একের পর এক ছবি বানিয়েছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিয়ে, আর একুশ শতকের তীক্ষ্ণধী বিজ্ঞান মেরির বইয়ে খুঁজে পাচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স-এর সুপ্ত বীজ!

মেরি শেলি

সুন্দরী অষ্টাদশীর প্রথম বইয়েই যখন এত কিছু, মনে হতে পারে, নিশ্চয়ই হইচই পড়ে গিয়েছিল লেখককে নিয়ে! আদৌ নয়। দু’শো বছর আগে প্রকাশিত সেই বইয়ে লেখকের কোনও নামই ছিল না! মেরির স্বামী, বিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলি ভূমিকাটা লিখেছিলেন। তাতে সবাই মনে করেছিল, গোটা বইটাই বুঝি শেলিরই লেখা! অনেকে ভেবেছিল, এ নির্ঘাত সুপণ্ডিত উইলিয়াম গডউইনের লেখা! সে কালে মেয়েরা হয় না-নামে বা বেনামে (আসলে পুরুষের ছদ্মনামে) লিখতেন। ব্রন্টি-বোনেরা যেমন, আরও পরে জর্জ এলিয়ট (আসল নাম মেরি অ্যান ইভান্স) যেমন। তাঁরা সবাই বিখ্যাত হলেন, মেরি রয়ে গেলেন আড়ালে— বিখ্যাত বাবা, সেলেব্রিটি স্বামীর ইমেজে ঢাকা। সবাই মনে করল, এত ভাল বই ওই মেয়ে লিখবে কি, ওঁরাই কেউ লিখে দিয়েছেন। অন্তত না লিখে দিক, ঘষেমেজে ঝকঝকে করে দিয়েছে তো নির্ঘাত! কারও বক্তব্য শুনলে আবার আকাশ থেকে পড়তে হয়। তাদের বক্তব্য, মেরি যদি লিখেও থাকে, কী আর নতুন কথা লিখেছে, শেক্‌সপিয়র তো কবেই টেমপেস্ট নাটকে দনু-মনুর সংকর ক্যালিবানকে রেফারেন্স হিসেবে রেখেই গিয়েছেন!

সুতরাং, লেখা টুবুটুবু রসগোল্লা, আর লেখক গোল্লা। আরও ভয়ংকর: শুরু হল ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটনা, বিদ্রুপ-সমালোচনার বান। ১৮১৬ সালে যখন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন মগজে, মেরি তখনও মেরি গডউইন, মেরি শেলি হননি। মেয়ে জন্মেই মা’কে খেয়েছে (জন্মের এগারো দিনের মাথায় মা মারা যান), এ বার বাবার মুখে চুনকালি মাখিয়ে পালিয়েছে বিখ্যাত কবির সঙ্গে, যে শুধু বিবাহিতই নয়, সন্তানের পিতাও।

এর পর যেমন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছেপে বেরবে, তেমনই মেরির জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাবে নানান ঘটনা: পার্সির স্ত্রী হ্যারিয়েটের আত্মহত্যা, আগের পক্ষের সন্তানদের কাস্টডি পাওয়া নিয়ে কোর্টকাছারি, শেলির সঙ্গে বিয়ে, মেরির নিজের দুই সন্তানের জন্ম ও মৃত্যু, নৌকাডুবিতে শেলির মৃত্যু। পঁচিশ না পেরোতেই বিধবা, সন্তানহারা এক মেয়ে ফিরে আসবে উত্তর লন্ডনের ছোট্ট এক পাড়ায়, দিন কাটাবে একলা, বন্ধুহীন। সম্বল শুধু নিজের লেখালিখি, স্বামীর বিপুল কবিতা সম্পাদনা, আর একমাত্র জীবিত সন্তান পার্সি ফ্লোরেন্স শেলি-কে মানুষ করা। মেরির শ্বশুরমশাই, স্যর টিমোথি শেলি পিছনে পড়েছিলেন পুত্রবধূর, মেরি যাতে পার্সির জীবনী না বের করতে পারেন। ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন ফ্লোরেন্সকেও, মেরি ছাড়েননি। বরং প্রাণপণে চেষ্টা করে গিয়েছেন যাতে ফ্লোরেন্স ভাগ পায় তার পৈতৃক সম্পত্তির, তা আদায় করেও ছেড়েছেন। সমাজের চোখে ভ্রষ্টা, একঘরে যুবতী এই সব কিছুর মধ্যেও লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, বিখ্যাত মানুষদের জীবনচরিত; ‘দ্য লাস্ট ম্যান’, ‘ফকনার’ নামে আরও উপন্যাস। ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় তাঁর লিখিত-সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা কুড়িরও বেশি!

‘আমি যদি ভালবাসার উদ্রেক না-ই করতে পারি, তা হলে ভয়েরই কারণ হব’— ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ভাগ্যবিড়ম্বিত দানব ডুকরে উঠে বলেছিল। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের স্রষ্টা ভালবাসা পাননি, কিন্তু ভয়ও দেখাননি পৃথিবীকে। নিজে প্রচারের আলো চাননি, বরং একটা বই রেখে গেছেন, যেটা আলো দেখাচ্ছে আজও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE