Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কেবিন নাম্বার একচল্লিশে ঈশ্বর আমি

রা স্তাটা পার হতে গিয়েও পারলাম না। ফুটপাতে আমার পিছনে একটা বড় ভিড়, সবাই পেরোবে রাস্তা, তার একটা চাপ বাড়ছিল কিছু ক্ষণ ধরেই। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেরিয়ে যাবে জেব্রা ক্রসিং-এর ওপর দিয়ে। দূর থেকে হুড়মুড় করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে আসা গাড়ি, বাসগুলো আমাদের শত্রু হিসেবেই দেখছে, জানি। এক বার রাস্তায় লোক নেমে গেলে তাদের ব্রেক কষতেই হবে দাঁতে দাঁত চেপে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য গরম পিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে গরগর করে।

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রা স্তাটা পার হতে গিয়েও পারলাম না। ফুটপাতে আমার পিছনে একটা বড় ভিড়, সবাই পেরোবে রাস্তা, তার একটা চাপ বাড়ছিল কিছু ক্ষণ ধরেই। সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেরিয়ে যাবে জেব্রা ক্রসিং-এর ওপর দিয়ে। দূর থেকে হুড়মুড় করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে আসা গাড়ি, বাসগুলো আমাদের শত্রু হিসেবেই দেখছে, জানি। এক বার রাস্তায় লোক নেমে গেলে তাদের ব্রেক কষতেই হবে দাঁতে দাঁত চেপে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য গরম পিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে গরগর করে। সামনে দিয়ে লোক যাবে আসবে রাস্তার দখল নিয়ে। নির্বিকার মুখে। পুলিশ বা ট্র্যাফিক সিগনালের কথা শুনতে কেউই রাজি নয়। রাস্তায় হাঁটা লোকরাও জানে কত দূরে গাড়ির ঝাঁক দেখলে নিয়ম না মেনেই পায়ের থাবাটা মেরে দেওয়া যায় দলবদ্ধ ভাবে। হলও তাই। সিগনাল হওয়ার আগেই বুঝতে পারলাম আমার পিছনের অধৈর্য জনতা মুহূর্তের মধ্যে আমার সামনে, ও-পার থেকেও এসে গেছে ব্যস্ত হানাদাররা। স্প্লিট সেকেন্ড ডিসিশনে হেরে যাওয়া গাড়ির দল থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে আর্তনাদ করে, তাদের পিছনে বাকিরা কান ফাটিয়ে দিচ্ছে হর্ন বাজিয়ে, কারণ সিগনাল এখনও ওদের জন্য সবুজ। এই ভয়ংকর, কান ফাটানো, শরীর জ্বালানো, রোদে গলা অবস্থায় একটা মেসেজ এল। তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম সেটা দেখতে। আসলে অন্যদের মতো রাস্তা পেরিয়ে আমার কোনও বড় লাভ হত না, সে ভাবে কোথাও যাওয়ার ছিল না, তাই, ‘আমি কেবিন নাম্বার একচল্লিশে, এক্ষুনি আয়, দরকার আছে’ মেসেজটা দেখলাম কোনও মতে। কিন্তু তত ক্ষণে আমি রাস্তার একেবারে মাঝখানেই চলে এসেছি। এক পাশে সমস্বরে ভীষণ আওয়াজ হতেই বুঝলাম ইঞ্জিনে রক্তের জোয়ার এসে গেছে সবার। দৌড়ে ও-পারে পৌঁছনোর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম আগুনের হলকার মতো গালাগাল ছিটকে গেল আমার পিছনে, যে দিকে আমার কোনও চোখ নেই।

ছবি: শুভময় মিত্র

অন্য পারে পৌঁছে, ভিড়ের মধ্যেই একটু ছায়ামত জায়গায় আবার দেখলাম মেসেজটা, কে জানে কার। নাম্বার চিনি না। চেনা কেউ হবে। তুই বলছে, বন্ধু হতে পারে। ধরেই নিয়েছে আমি বুঝতে পারছি। অথচ তা নয়। কী করি? আমার ব্যালান্স নেই বিশেষ, তাও ওই নম্বরে ফোন করলাম। বাজল, কেটে গেল। আবার। আবার কাটল। তার পর আবার মেসেজ এল, হাসপাতালের নাম। সঙ্গে আর একটা লাইন, ‘ফোন করিস না, এখানে ফোন অ্যালাউড নয়, লুকিয়ে মেসেজ করছি। ইডিয়ট।’ শেষ শব্দটা দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। এত আন্তরিক ভাবে কে আর গালাগাল দেয়। তা ছাড়া হাসপাতাল থেকে যাকে ডেকে পাঠানো হয়, তার একটা গুরুত্ব আছে। এই যে চার পাশে এত লোক বেকার ব্যস্ততার মুখোশ পরে ঘেমেনেয়ে একশা হচ্ছে, আমি তো এখন তাদের থেকে একেবারেই আলাদা। বিকেল হবে একটু পরে, ঝাঁ ঝাঁ রোদ প্রতিশোধ নিয়েই চলেছে। দেখে হাসি পেল। সবার সঙ্গে সবার শত্রুতা, সবার মনে প্রতিশোধের আগুন, একমাত্র আমার মনটা তরমুজের মতো ঠান্ডা, শিরায় শিরায় বইছে মিষ্টি, লাল রক্ত। ভেবেই ভাল লাগল।

মেসেজটা কে পাঠিয়েছে জানা দরকার, সেটা মেসেজ করেই জানা যায়। কিন্তু করলাম না। করলে আবার টাকা কাটবে, এক্ষুনি রিচার্জ করার টাকাও নেই বিশেষ। তা ছাড়া গেলে তো দেখতেই পাব কে। চার পাশের ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচির মধ্যেই আমি নিজের খোলে ঢুকে পড়তে পারি, শামুকের মতো, অভ্যেস আছে। আর একটা মেসেজ এল, ‘অ্যাঞ্জিয়ো করা যাবে না, মাল্টিপল ব্লক আছে, বাইপাস করবে।’ তার পরেই আবার ‘কোনও মানে হয় না, আমাকে এখান থেকে বের কর আগে।’ নাম করা দামি হাসপাতালে আজেবাজে লোক ভর্তি হয় না। হলেও দুম করে বেরিয়ে আসতে পারে না। কেন অবুঝপনা। আর কেনই বা আমাকে ডেকে পাঠানো সেটা বুঝতে না পারলেও টের পেলাম, এই মুহূর্তে আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ লোক। আবার ভাল লাগল, মনটা, শরীরটা এসি হয়ে গেল। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে এসিতে থাকব। সরাসরি কোনও বাস যায় না, ট্যাক্সি নেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না, হাঁটতেই শুরু করলাম। খুব দূরে তো নয়।

বলা উচিত নয়, তাই মনে মনে ভাবলাম, এই হাসপাতালটা খুবই সুন্দর, সাজানো, কোথাও অন্ধকার নেই, মাঝে মধ্যে এমনি ঘুরতে আসতেও তো পারে লোকে। শুধু ভিক্টোরিয়া বা কালীঘাটে যায় কেন? লবিতে ঘুরঘুর করতে তো ভালই লাগে। কত রকম লোক বসে আছে, ঘোরাঘুরি করছে। কেউ কেউ উদ্বিগ্ন, শূন্য দৃষ্টি, সে তো সব জায়গাতেই দেখা যায়। একটু কাঠ কাঠ হলেও রিসেপশনের দিদিরা, লিফটম্যান সবাই খুবই ভদ্র, শান্ত। মনেই হয় না যে ধাঁ করে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘অ্যাই এখানে কী চাই?’ করলে, আমি যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে এসেছি, সেটা বলাও যাবে না। একটা অন্যায় আবদার, কে করছে এখনও জানি না, প্র্যাকটিকাল জোকও হতে পারে। আমাকে নিয়ে মশকরা করছে। আসলে কেউ নেই এখানে। নিজের অফিসে বসে মিচকে হাসি মুখে নিয়ে বদমাইশির মেসেজ করে ঠকাচ্ছে আমাকে। মুখে মনিটরের নীল আলো পড়ে তাকে দেখাচ্ছে শয়তানের মতো। কিন্তু ঠকানো যায় না আমাকে, আমার তো হারানোর কিছুই নেই। আমার এমন একটা জিনিস আছে, যা আর কারুর নেই। অঢেল সময়, তা ছাড়া পৌঁছেও গেছি আমি। বসেছি সোফায় আরাম করে। ‘এলি?’ এই মেসেজটা এসে গেছে। জানতাম আসবে। আমার কাছে ভিজিটার্স পাস নেই, তাই কী করে যাব, সেটাও ভাবতে লাগলাম। এমনি যাওয়া যায় না এখানে। কী মনে হল, পাশের সাধারণ চেহারার ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ করায় তিনি তাঁরটা দিলেন, বললেন, ‘ঘুরে এসো বাবা, আমার কেউ তো আসেনি এখনও।’

লটারির টিকিট পাওয়ার আনন্দ নিয়ে ঢুকে পড়লাম লিফটে। আশ্চর্য এই যান বুদ্ধ-মন্দিরের মতো। নিঃশব্দে উত্তরণ ঘটায়, নিয়ে চলে যে ডাকছে তার কাছে। সাক্ষাৎ শেষে ফিরিয়ে দেয় যেখান থেকে শুরু, সেখানেই। দরজা খুলে গেল, করিডোর, আইসিইউ। আমার পীড়িত মানুষটা নিজে পারেনি, ডেকেছে আমাকে, এসেছি তাই হেঁটে, পরে লিফটে। ঈশ্বর আমি। সামনের দরজার ও-পারেই পর পর কেবিন। নার্সটা যাওয়া আসা করছে। কেউ আমাকে নিয়ে মাথাও দিচ্ছে না। চার পাশটা স্পেসশিপের মতো, যন্ত্রপাতির ছড়াছড়ি। আসলে সবাই ভাসছি মহাশূন্যে। নিমীলিত আলো, মার্জিত ঠান্ডা। জন্ম মৃত্যু অবান্তর। শুধু যাওয়া আসা। মাঝখানে বিশ্রাম, কেবিনে। টের পেলাম, এ বারে মাথার মধ্যে সবুজ এলইডি দপদপ, জ্বলছে, নিভছে। দরজাতেই মেসেজ এল আবার। ‘আমি জানি তুই আসবি।’ তার পরেই আবার, ‘সব খুলে ফেলেছি আমি। তাড়াতাড়ি কর। এই একটাই চান্স আমার।’ দাঁড়াতেই হল। কী বলছেটা কী? আমি কিন্তু আন্দাজ করতে পারছি কে রয়েছে ভিতরে। এই রকম উদ্ভট বুদ্ধি, অসহিষ্ণুতা এক জনেরই ছিল। যোগাযোগ হত না বিশেষ, কিন্তু বুঝতে পারতাম আছে, দেশে বা অন্য কোথাও। ফিজিক্সের পাকা মাথা, নিজের জীবনে অসংলগ্ন, টলোমলো। ফেঁসেছে অনেক বার, নানা কারণে। আবার মেসেজ, ‘আমার জামা পরে তুই চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়বি। তোরটা পরে আমি বেরিয়ে যাব। ন্যাশনাল লাইব্রেরির গেটে এক জনের সঙ্গে এক বার দেখা করেই চলে আসব। জরুরি।’

আমি নিশ্চিত জানি যে আমার মুখে একটা হাসি খেলে গেল। আমি হাত রাখলাম কেবিনের দরজার নব-এ।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhomoy mitra hospital mobile bus kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE