Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস: পর্ব ২৪

স্বাধীনতা তুমি...

উঠোনের এক দিকে পর পর কয়েকটা শৌচাগার। অন্য দিকে প্রশস্ত বারান্দার এক প্রান্তে রান্নাঘর, আসলামভাইয়ের রাজত্ব।সরলা কুণ্ডুর অলঙ্ঘনীয় অনুশাসন অনুযায়ী এ বাড়ির কোনও ভাড়াটেই রাত একটার পরে ঘরে কোনও বহিরাগতকে রাখতে পারে না।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

উঠোনের এক দিকে পর পর কয়েকটা শৌচাগার। অন্য দিকে প্রশস্ত বারান্দার এক প্রান্তে রান্নাঘর, আসলামভাইয়ের রাজত্ব।

সরলা কুণ্ডুর অলঙ্ঘনীয় অনুশাসন অনুযায়ী এ বাড়ির কোনও ভাড়াটেই রাত একটার পরে ঘরে কোনও বহিরাগতকে রাখতে পারে না। এই নিয়ম নিয়ে মাঝেমধ্যে যে ঝামেলা হয় না তা নয়, তবে তেমন বেয়াড়া কোনও খরিদ্দার এলে সামাল দেয় ঝাঁটু, দুলাল আর চন্দন। তিন জনেরই পেটানো বলশালী চেহারা, আর এ তল্লাটে মস্তান বলে খ্যাতি আছে। শোনা যায় তারা নাকি এই ব্যবসা ছাড়াও সরলা কুণ্ডুর অন্য সব ব্যবসাতেও সাহায্য করে।

সকাল সাতটার মধ্যে সবাইকে উঠে পড়তে হয়। পরে দুপুরে ঘুমনো যেতে পারে। কিন্তু সাড়ে আটটার পর সকালের জলখাবার দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় একতলার কিচেনে। দুপুর দেড়টায় সবাই একসঙ্গে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে খায়। মাসিও থাকেন। সকলের সঙ্গে সেটাই তাঁর কথা বলার সময়।

‘কী রে কমলি, তোর ঘরে দু’দিন ধরে কোনও লোক নেই কেন? এটা কি তোর বাপের জমিদারি নাকি? বসে বসে আমি কাউকে দু’বেলা খাওয়াতে পারব না, বলে দিলুম,’ অথবা ‘শোন সুমি, তোর ঘরে যে মালটা বুধবার করে আসে, ওটাকে আর ঢুকতে দিবি না। বড্ড ঝামেলা করে মাল খেয়ে। একটা বেজে গেলেও বেরোতে চায় না, চেঁচামেচি করে। এই নিয়ে পর পর দু’বার ঝন্টুকে দিয়ে তাড়াতে হল। অত ঝামেলা পোষায় না বাপু...’

এ সব সময় চুপ থাকাই নিয়ম। মাসির মুখের উপর কথা বললে পরে তিনতলা থেকে তলব আসবে। অথবা ঘরে হানা দেবে ঝাঁটু বা চন্দন। বেধড়ক মারধোর করবে। অসহায় মেয়েগুলোকে মেরে এরা বেশ আনন্দ পায়। সেটা আবার উঁচু গলায় বলেও!

তাই মাসি যখন কথা বলেন, তখন সবার চোখ নিজের পাতের উপর। নীরবে খাবার পরিবেশন করে আসলামভাই। কারও বিরুদ্ধে কারও নালিশ থাকলে, মাসির কাছে তা পেশ করার এটাই সময়। সবচেয়ে বড় কথা, দুপুরের এই পঙ্‌ক্তিভোজে অকারণে কোনও মেয়ে অনুপস্থিত থাকলে, সে দিন তার বিকেলের জলখাবার এবং রাতের খাবারও বন্ধ। কারও সাধ্য নেই যে এই নিয়ম ভঙ্গ করে। পঙ্‌ক্তিভোজনে দেরি করে বসাটাও নিয়মবিরুদ্ধ। ঠিক দেড়টার সময় সবাই বসে গেলে আসলামভাইয়ের রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া-ওঠা ভাতের বিরাট গামলাটা ধরাধরি করে বার করে আনে দুলাল আর চন্দন। এক জন কেউ ঠিক সময় না এলে, সবাইকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। পাঁচ মিনিটের বেশি কারও দেরি হলে, তার ঘরে লোক যায়। সে দিন তার কপালে দুঃখ আছে।

সকাল দশটার পর থেকেই তাই একতলার শ্যাওলা-ধরা উঠোনটা মুখরিত হয়ে ওঠে। ওটা সকলের চান-বাথরুমের সময়। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে আসলামভাইয়ের গলা, ‘এ দুলাল, থোড়া ইধার আ... কাঁহাসে খরিদা ইয়ে গোস্ত?’

এ বাড়ির এই একটা ব্যাপার— খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য করেন না সরলা কুণ্ডু। রোজই মাছ বা মাংসের একটা পদ হয়, সঙ্গে ডাল, দু’তিন রকমের সবজি। কোনও কোনও রবিবার বিরিয়ানি।

অন্যান্য দিনের মতো আজও সকাল সকাল স্নান সেরে ফেলেছিল তুলসী। গৌরাঙ্গ যখন তার ঘরে উঁকি মেরেছে, তখন সে বেরনোর জন্য তৈরি। সাদা খোলের পাট-ভাঙা শাড়ি, চওড়া কমলা পাড়, ধার দিয়ে কালো সুতোর সূক্ষ্ম কাজ। কমলারঙা ব্লাউজের হাতা কনুই অবধি। বুকের উপর সরু সোনার লকেট। গৌরাঙ্গ যখন ঢুকল, তুলসী আয়নার সামনে টিপ পরছে।

‘আরিব্বাস, এ তো ঝক্কাস নামিয়েছিস। কোথায় যাচ্ছিস রে?’ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়েছে গৌরাঙ্গ। ‘ওটো ওটো, অ্যাকুন হবেনি কো। অ্যাকুন আমাদের বেরুতে হবে। সরকারি অফিসে যেতি হবে,’ বলে উঠেছিল তুলসী।

সত্যিই তাদের সরকারি অফিসে যাওয়ার কথা। তাই তো ও ভাবে সেজেছে তুলসী। মাসির হুকুম। ঠিকঠাক শাড়ি-জামা পরতে হবে। সাজে কোনও রকম উগ্রতা যেন না থাকে। তারা পাঁচ জন যাবে। কাকে কী পরতে হবে, সব বুঝিয়ে দিয়েছেন মাসি। একটুও এদিক-ওদিক হওয়া চলবে না। ঠিকঠাক সাজ হয়েছে কি না, বেরোবার আগে দেখে নেবেন মাসি। এ কথাও পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, তারা যেখানে যাচ্ছে সেখানে কারও মুখ খোলা চলবে না। কথা যা বলার, বলবেন মাসি নিজে আর মল্লিকাদি। সুনন্দদাও থাকবে সঙ্গে। সেও কথা বলবে প্রয়োজনে।

মল্লিকাদির পুরো নাম মল্লিকা মজুমদার। সুনন্দদার পদবী জানে না তুলসী। ওরা যেখানে চাকরি করে, সেটাকে কী বলে যেন বেশ, এনজিও না কী একটা। ওদের সংস্থার নাম ‘নারী’। ওরা প্রায়ই আসে এ বাড়িতে। মাসির সঙ্গে কথা বলে। এ বাড়ির চন্দনা, খুশি আর সুমি, মানে সুমিতা ‘নারী’র সকালের ক্লাসে যায় হপ্তায় দু’দিন। খুশি সামনের বছর মাধ্যমিকে বসবে।

আজ মল্লিকা আর সুনন্দদা ওদের নিয়ে যাবে সরকারের সমাজকল্যাণ দফতরে। সেখানে নাকি কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে— মাসি এবং তাঁর মতো আরও কয়েক জন মিলে ওদের নামে একটা সমবায় ব্যাঙ্ক খুলবেন। তাতে ওরা নিজেদের টাকা রাখতে পারবে। নিজেদের টাকা মানে, মাসির ভাড়া মিটিয়ে যে ক’টা টাকা পাবে, সেই টাকা। প্রথমে শুনে সন্দেহ হয়েছিল তুলসীর। হাতে যে ক’টা টাকা আসে, সেটাও বোধহয় মেরে দেওয়ার ধান্দা এটা। কিন্তু চন্দনা তাকে বুঝিয়েছে, তা নয়। এতে নাকি সত্যিই ব্যাঙ্কের মতো কাজ হবে। টাকা রাখা যাবে, তোলা যাবে। সেই টাকা ছোটখাটো ব্যবসাতেও খাটাতে পারবে তারা। এত ভাল ভাল কথা অবশ্য বিশ্বাস হয় না তুলসীর। সে তো ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল গ্রামে। মল্লিকাদির ইস্কুলে সেও যেতে চেয়েছিল লেখাপড়া শিখতে। দিল মাসি? ‘তোকে এখন পাঠাব না,’ বলে ভাগিয়ে দিল!

তবু মাসির কথা অমান্য করার উপায় নেই। একটু পরেই ডাক পড়বে উপরে। মাসি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন সকলের পোশাক। এর মধ্যে গৌরাঙ্গ এসে হাজির। লোকটাকে বেশ ভাল লাগে তুলসীর। অনেক দিন না দেখলে খুব মনে হয় ওর কথা। কিন্তু আজকের প্রস্তাব শুনে তুলসীর চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। একটা অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে হবে ঘরে?

‘না না, ও আমি কিচুতিই পারবুনি গো। তুমি অন্য কোতাও দেকো।’

‘দেখ তুলসী, আমার খুব বিপদ। তোকে কি এমনি বলছি? তিনটে দিন রাখ। তোকে তিনশো দেবো আমি। দিনে একশো করে।’

‘না না। মাসি জানতি পারলি খায়ে ফেলবে আমারে। তাড়ায়ে দিলি আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নিই গো...’

ওই এক দোষ তুলসীর। সে নিজেও জানে। কথায় কথায় চোখে জল এসে যায়!

‘থাক, থাক। আর কাঁদতে হবে না! মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। সাহায্য করবি না, তাই বল!’

‘ও রকম বলোনি গো। আমার কতাটা এক বার ভাবো। জানতি পারলি মাসি ছালচামড়া উঠি নেবে।’

‘আমি তো বলছি, কেউ...’ কথা শেষ হল না গৌরাঙ্গর। উপর থেকে ডাক এসে গেল। তড়িঘড়ি বেশবাস ঠিক করে নিল তুলসী। দুলাল উঁকি মেরে দেখে গেল, ঘরে বসে আছে গৌরাঙ্গ।

তিনতলায় তখন বাকি সবাই রেডি। তুলসীর ডাক পড়েছে সকলের শেষে। তার পরিপাটি সাজ দেখে হাসি ফুটল মাসির মুখে। ‘দেখ, দেখ তোরা, কেমন মিষ্টি করে সেজেছে মেয়েটা। দেখেই গলে যাবেন বড়সাহেব,’ থুতনি ধরে একটু আদর করল মাসি।

কথাটা খুব মিথ্যে বলেনি সরলা কুণ্ডু। জনকল্যাণ দফতরের যুগ্ম সচিব অলকেন্দুনাথ রায় সারা ক্ষণ যে চোরাগোপ্তা দৃষ্টি হেনে গেলেন তুলসীর দিকে, সেটা কারও চোখেই ধরা পড়তে বাকি থাকল না। মিটিংয়ের মধ্যেই চন্দনাদি সবার অলক্ষে একটা আলতো চিমটি কাটল তাকে! ভ্রুভঙ্গিমায় তাকে নীরবে ধমকাল তুলসী। অন্য দুজন অফিসার অবশ্য খুবই তৎপর হয়ে কথাবার্তা চালালেন। বিশেষ করে মহিলা অফিসারটিকে খুবই ভাল লাগল সকলের। সরকারের তরফে মূল কথাবার্তা চালালেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্যই।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Mystery Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE