Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস: পর্ব ৩১

স্বাধীনতা তুমি...

গৌরাঙ্গরও আজ মনটা ফুরফুরে। পকেটে অনেক টাকা। অনেক বললে কম বলা হয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা একসঙ্গে কবে দেখেছে সে? সামনে পিটার স্কটের বোতলটা খোলা। উলটো দিকের দোকান থেকে আনা কাবাবটা একেবারে তুখড়।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

হা রুর কথাই ঠিক। সদর থানায় গিয়ে তারা দেখল, ইস্টিশন থানার বড়বাবুও সেখানে বসে। বড়বাবুই কথা বললেন তাদের সঙ্গে।

‘‘দু’দিন রাজার হালে লক-আপে থাকবি। দু’বেলা খেতে পাবি। কোনও ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করিস না কিন্তু। স্বাধীনতা দিবসের ব্যাপারটা মিটে যাক, তোদের ছেড়ে দেওয়া হবে।’’

কথা শেষ করে বড়বাবু যেই উঠে দাঁড়াতে যাবে, ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা!

‘‘আমাদের যখন ইচ্ছে তখন এ ভাবে ধরে আনবেন?’’ রগচটা রতনলালটা উঠে দাঁড়িয়েছে।

‘‘কী! কী বললি?’’ সদর থানার বড়বাবু যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। দুই থানার দুজন বড়বাবু উপস্থিত, তাদের সামনে এই প্রশ্ন করছে একটা ট্রেনের ভিখিরি!

‘‘কী বললাম আবার কী? আমরা কী চুরি করিছি না ডাকাতি করিছি যে আমাদের লক-আপে পুরবেন? দেশে আইন নেই?’’

চিৎকার করছে রতনলাল। দু’চোখ জ্বলছে তার! সারা ঘরে সবাই স্তম্ভিত। শুধু মাথার উপরে পুরনো সিলিং ফ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

‘‘আইন দেখবি? এই দেখ আইন,’’ কথাটা এল একটি লম্বা-চওড়া সেপাইয়ের কাছ থেকে। পুলিশের খাকি উর্দি পরা। পায়ে ভারী বুট। সেই পায়ে ভয়ংকর জোরে একটা লাথি মারল রতনলালকে লক্ষ্য করে। রতনলালও যেন প্রস্তুতই ছিল। এক ঝটকায় সরে গেল। ভারী বুটের লাথিটা আছড়ে পড়ল রতনলালের পাশে বসে থাকা এক হাড়-জিরজিরে বুড়োর বুকের ঠিক মাঝখানে। গোঙানির মতো একটা শব্দ করে পড়ে গেল বুড়োটা। মুখে সাদা ফেনা। চোখ দুটো স্থির।

পর মুহূর্তেই তিন-চার জন পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল রতনলালের উপরে। মার খেয়ে ফুলে উঠল রতনলালের নাক-মুখ। তাকে আলাদা একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হল। বাকিদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল জেনারেল লক-আপে।

কিন্তু সমস্যা হল নিথর হয়ে পড়ে থাকা বৃদ্ধ ভিখিরিটাকে নিয়ে। লোকটি কে, কেউ জানে না। একটা ট্রেনে উঠে ভিক্ষে করতে করতে আসছিল। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ভিখিরি উচ্ছেদ অভিযানে অন্যদের সঙ্গে তাকেও নামিয়ে আনা হয়। সদর থানার ওসি নিরঞ্জন ঝা’র উপর একটু বিরক্তই হলেন অলকেশ। নিজের লোকেদের কন্ট্রোল করতে পারেন না ঠিকমত! একেই স্বাধীনতা দিবসের এত সব ঝামেলা! স্টেশন পরিষ্কার রাখো। স্টেশন চত্বর থেকে ভিখিরিদের সরিয়ে দাও। রোজ নিত্য নতুন ইনস্ট্রাকশন আসছে। তার উপর আর একটা বেওয়ারিশ লাশ!

আর একটা বেওয়ারিশ লাশ! কথাটা মাথায় আসামাত্রই বিদ্যুতের মতো একটা চিন্তা খেলে গেল অলকেশের মনে। হিজড়েটাকে যে বিশেষ ধরনের বন্দুক দিয়ে মারা হয়েছে, সেটা তো এখনও পাওয়া যায়নি। আছে শুধু সেই বুলেট। বুলেটটা সরিয়ে ফেলা তো কোনও ব্যাপার না। সমস্যা হল ডেডবডি নিয়ে। ডেডবডি যত ক্ষণ মর্গে পড়ে থাকবে, তত ক্ষণ একটা মাথাব্যথা। লাশটা এক বার হাপিশ করে দিকে পারলে কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া যাবে। এক বার স্বাধীনতা দিবসের ঝামেলাটা ভালয় ভালয় মিটে গেলেই হল।

‘‘নিরঞ্জনবাবু, এ তো মরে গেছে মনে হচ্ছে। বেওয়ারিশ বডি। বেশি ঝামেলা করে কাজ নেই, বুঝলেন! আমার উপর ছেড়ে দিন।’’

কথাটা শুনে নিরঞ্জন ঝা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। বেওয়ারিশ হোক আর যা-ই হোক, পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু— এক বার জানাজানি হয়ে গেলে বিস্তর ঝামেলা।

সেই রাতেই আর একটা মৃতদেহ চলে গেল হাসপাতালের মর্গে। সুনীত রাহা নামে যে তরুণ ডাক্তারটি সেখানকার আধিকারিক, তার সঙ্গে অলকেশের সম্পর্ক খুবই ভাল। অলকেশ তাঁকে ফোন করে বললেন, মর্গের ২৩৭ নম্বর ড্রয়ারে যে মৃতদেহটি রাখা ছিল, সেটি নিয়ে যাওয়ার জন্য মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। চলেও এসেছেন তাঁদের কয়েক জন। কিন্তু ইতিমধ্যে আর একটি বেওয়ারিশ মৃতদেহ ট্র্যাক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ছেলেটি আর কথা না বাড়িয়ে আগের মৃতদেহটি বার করে সে জায়গায় নতুন উদ্ধার করা এই লাশটি রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

বেলা পাঁচটায় ডিউটি শেষ করে ওঠার আগে সদর থানার ওসি নিরঞ্জন ঝা নির্দেশ দিয়ে গেলেন, বন্দি ভিখিরিদের যেন ঠিক সময়ে ভালমত খাবার দেওয়া হয়। এক দিনে আর ঝামেলা বাড়াতে চান না তিনি।

সারা দিনের উত্তেজনার পর রাতে ঝিমিয়ে পড়েছিল হরিমতি। তাকে ডেকে খাবার দিয়ে গেল থানার লোকেরা। অবাক হয়ে হরিমতি দেখল, তাদের সবার সামনেই ভাতের থালা। উপরে এক বাটি টলটলে ডাল। পাশে আবার একটা আধপোড়া রুটিও আছে।

স্বাধীনতা না জানি কী জিনিস! স্বাধীনতার জন্য এরা মানুষকে মেরেও ফেলে, আবার খেতেও দেয়!

ছেলেটা কী করছে এখন কে জানে! সন্তান আর স্বাধীনতার কথা ভাবতে ভাবতে ডালের বাটিতে চুমুক দিল হরিমতি।

১৬

দিনের আলো, দিনের অন্ধকার

‘‘তুই কী করলি তখন?’’

‘‘কী কল্লুম কী গো! ভয়ে তকোন আমার পেরান উড়ি গেছে। তকোন আর মাতার ঠিক আছে নাকি? যা করার আসলামভাই-ই তো কল্লে।’’

তুলসীর ঘরে বসেছিল গৌরাঙ্গ। খুব সুন্দর করে সেজেছে আজ তুলসী। হলদে তাঁতের শাড়ি। কপালে ছোট্ট কালো টিপ।

গৌরাঙ্গরও আজ মনটা ফুরফুরে। পকেটে অনেক টাকা। অনেক বললে কম বলা হয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা একসঙ্গে কবে দেখেছে সে? সামনে পিটার স্কটের বোতলটা খোলা। উলটো দিকের দোকান থেকে আনা কাবাবটা একেবারে তুখড়।

‘‘কী করল আসলামভাই?’’

‘‘কোথাত্থে এট্টা নোককে খপর দে নে এল। তারে ঢোকায় দিল আমার ঘরে। ঘরে ‘কাস্টমার’ থাকলি তো আর ঝাঁটুয়া ঘরে ঢুকবেনি।’’

ভাগ্য যেমন সব সময় সুপ্রসন্ন থাকে না, তেমন সব সময় খারাপও যায় না। নিজের ভাগ্যকে মনে মনে তারিফ না করে পারল না গৌরাঙ্গ।

আসলামভাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বন্দুকটা তুলসীর ঘরে লুকিয়ে রেখে এসেছিল বটে, কিন্তু অত দামী জিনিসটা হাতছাড়া করে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি কিছুতেই। খিদিরপুর ডকে তার পরিচিত যে ছেলেটি বলেছিল তার হাতে খরিদ্দার আছে, তারও দেখা পাচ্ছিল না ক’দিন ধরে। ছেলেটি একটি স্টিভেডরের কোম্পানিতে কাজ করে। সেখানে পুরো একটা দিন ঘোরাঘুরি করেও লাভ হয়নি গৌরাঙ্গর। সে নাকি ক’দিন ধরে কাজে আসছে না।

তিন দিনের মাথায় আর থাকতে পারেনি সে। ধুত্তোর, বলে আসলামভাইয়ের কাছে ফিরে গিয়েছিল। যা হয় হোক, ‘মাল’ সে নিজের কাছেই রাখবে। জিনিসটা নিয়ে ধরা পড়ার যা ঝুঁকি, খোয়া গেলে বিপদ অনেক বেশি। যে মারওয়াড়ি ব্যবসায়ীটি তাকে দিয়েছিল বন্দুকটা, সেই রাধেশ্যাম বাজোরিয়ার লোক এর মধ্যেই তিন বার তার মোবাইলে ফোন করেছিল। কাজের সুবিধের জন্য কয়েক দিন আগে সে যে একটা মোবাইল নিয়েছে, এ কথাটা কাউকে না বললেও রাধেশ্যাম বাজোরিয়া ঠিক জেনে গেছে। রাঘববোয়ালদের কাছে কোনও খবর গোপন থাকে না!

তাই বন্দুকটা ফিরিয়ে নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গৌরাঙ্গ। ঠিক করেছিল, দু’এক দিনের মধ্যেই তুলসীর ঘরে গিয়ে সুযোগ মতো জিনিসটা নিয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সে দিন বিকেলেই আসলামভাইয়ের জরুরি তলব। পড়িমরি করে ছুটে গিয়ে যা শুনল, তাতে তো তার মাথায় বাজ পড়ার জোগাড়!

তুলসীর ঘরে বন্দুকটা লুকিয়ে রেখে সে চলে যাওয়ার কিছু ক্ষণ পরেই নাকি সরলা কুণ্ডু তাঁর দলবল নিয়ে সল্টলেকে মিটিং সেরে ফিরে এসেছিলেন। নতুন সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি হবে। তিনি হবেন সেই ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের এক জন! সেখানে প্রত্যেকটি মেয়ের নামে কিছু টাকা রাখা হবে। কিন্তু সকলের পাস-বই থাকবে তাঁর কাছে। তিনিই যার যেমন প্রয়োজন, তেমন টাকা তোলার ব্যবস্থা করে দেবেন। চন্দনা, পারুল, তুলসীরা তো আর নিজেরা তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালাতে পারবে না! সে ক্ষমতাই তাদের নেই। তাই তিনিই তাদের হয়ে, তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালাবেন। মেয়েদের এই সব বোঝাতে বোঝাতেই ফিরছিলেন সরলাদেবী।

সেই কথার মাঝেই একটি মেয়ে বলে ওঠে, ‘‘ও মা, আমরা নিজেরা নিজেরা টাকা রাখতে পারবুনিকো? আমি ভেবেছিলুম বুঝি...’’

‘‘কেন রে লক্ষ্মী, তোর নিজে টাকা রাখার অত শখ কেন রে?’’ মেয়েটিকে কথা শেষ করার আগেই ধমকে ওঠেন সরলা। ‘‘কত টাকা সরিয়েছিস? কোথায় লুকিয়ে জমিয়েছিস টাকা?’’

‘‘ও মা, না, না। আমি কই ট্যাহা সরালাম? সবই তো তোমার হাতে দেই মাসি! আমি এমনি জিজ্ঞেস করলুম তো,’’ লক্ষ্মী যতই অস্বীকার করে, সরলার সন্দেহ ততই ঘনীভূত হয়ে ওঠে।

ক’দিন আগেই পারুলের ঘরে তল্লাশি চালিয়ে তিন হাজার টাকা পাওয়া গেছে!

সে দিন রাতেই সরলা আবার হুকুম জারি করেন, আর এক বার ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানো হবে। আগের বার হয়েছিল চার জনের ঘরে। এ বার অন্য পাঁচ জন।

যে পাঁচ জনের ঘরে চড়াও হবে দুলালরা, তার মধ্যে যে তুলসীর নামও আছে, এ কথা আসলামভাই কী ভাবে জানতে পেরেছিল, তা জানে না গৌরাঙ্গ। কিন্তু তুলসীর ঘরে লোক ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার বুদ্ধিটা দুর্দান্ত।

এক জনের ঘরে খদ্দের আছে দেখে সরলা কুণ্ডুর তিন অনুগত চর অন্য মেয়েদের ঘরগুলি ওলট-পালট করে সযত্নে সঞ্চিত অর্থের খোঁজ করতে শুরু করে।

‘‘তার পর কী করল আসলামভাই? আহ, একটু কাছে আয় না!’’ তুলসীকে নিজের বুকের কাছে টেনে আনল গৌরাঙ্গ। কী সুন্দর একটা আতর মেখেছে মেয়েটা!

‘‘আসলামভাই কী করবে? ওই যে লোকটা এয়েছেন, নাম তো বললে ইয়াসিন, সেই তো জোব্বার তলায় করে বন্দুকটা নে বেরোয়ে গেল। কী সাহস গো লোকটার! সিধে ঝাঁটু আর দুলালের সামনে দে টলতি টলতি বেরোয়ে গেল। যেন কত মদ খাইছে। আসলে কিচু খায়নিকো!’’

খুকখুক করে হাসল তুলসী।

‘‘কত ক্ষণ ছিল তোর ঘরে?’’ প্রশ্নটা বেশ কিছু ক্ষণ ধরে তাকে কাঁটার মতো বিঁধছিল দেখে নিজেই একটু অবাক হল গৌরাঙ্গ!

‘‘এক ঘণ্টা।’’

‘‘তোকে কিছু করল?’’

‘‘করবেনি তো কী? অমন সুযোগ পালি কেউ ছাড়ে?’’ তুলসীর ম্লান হাসিটায় দুঃখ আর সারল্য মাখামাখি হয়ে আছে। মেয়েটার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে থাকল গৌরাঙ্গ।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Graphic Novel Mystery novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE