Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
ছোটগল্প

সম্পর্ক

আজ এসে থেকে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। বারবার শাশুড়িমায়ের কথা মনে পড়ছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, মাথার আঘাতটা আপাতভাবে দেখে গুরুতর মনে হচ্ছে না। কিন্তু হাঁটুর মালাইচাকিতে যদি জোর আঘাত লাগে তবে চিড় ধরতে পারে। ভুগতে হতে পারে।

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

ছবি: তারকনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:০০
Share: Save:

কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলতেই রনিতার নজর যায় ঘড়িটার দিকে। ইস! এত বেলা হয়ে গিয়েছে! সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সচরাচর সে ঘুমোয় না। দরজা খুলতে মিনুদির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়।

“বলি বন্‌ধ বলে কি ভেবেছিলে মিনুরও বন্‌ধ? ওটি হচ্ছেনি বাপু।”

“না গো, সকালবেলায় চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল।”

“লাগবেনি, রাত জেগে নিকবে, পড়বে, চোকের আর দোষ কী বলো?” কথাগুলো মিনুদি শুধু মুখেই বলে না, হাত দিয়ে চিত্র নির্মাণ করার চেষ্টা করে। রনিতার হাসি পেয়ে যায়। কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে চায়ের জল চাপাতে যায়। জল ফুটতে ফুটতে ব্রাশ করে নেওয়া তার অভ্যাস।

“ও দিদি দেকবে এস মাসিমার কী হয়েছে।” মিনুদির চিৎকারে বুকটা ধড়াস করে ওঠে। ব্রাশে পেস্ট লাগানোই থাকে। তাড়াতাড়ি গ্যাসের নবটা অফ করে ঘরে ঢোকে।

মানুষটা তো দিব্যি খাটে বসে আছে।

“কী হয়েছে মা?”

“বাথরুম যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি মা,” লক্ষ্মীদেবীর গলায় যন্ত্রণার সুর।

“দ্যাকো দিদি কত রক্ত দ্যাকো!” মিনুদির কথায় রনিতা ভাল করে দেখে।

“মাথাটা তো কেটেছে, আর কি কিছু হয়েছে মা?”

“তুমি ব্যস্ত হয়ো না বৌমা, একটু লেগেছে, ঠিক হয়ে যাবে।”

“এক বার উঠে দাঁড়ান তো দেখি।”

“দাঁড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে মা।”

এ বার রনিতা ভয় পেয়ে যায়। কোথায় ব্যথা জানতে চায়। কাপড়টা তুলে পা-টা দেখে। হাঁটুর কাছে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে। কে জানে, ভেঙে যায়নি তো?

“এক বার উঠে দাঁড়ান মা,” রনিতা জোর করে।

লক্ষ্মীদেবী দাঁড়াতে গিয়ে ককিয়ে ওঠেন। রনিতা কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, “ও মিনুদি! কী হবে?’’

মিনু জানে দিদিমণিটা খুব ভাল। আজকাল নিজের মায়ের কেউ দায়িত্ব নেয় না, আর এ তো পরের মা। তবুও দিদিমণি কী অবলীলায় মানুষটাকে যত্নআত্তি করে।

রনিতা ভাবে, তার কি সমরেশকে খবর দেওয়া উচিত? একটা দোটানার মধ্যে পড়ে যায়, যতই হোক সমরেশের তো নিজের মা।

******

এখনও পিক আওয়ার শুরু হয়নি। তবুও খবর আসতে শুরু করেছে। সব খবরই বন্‌ধ সম্পর্কিত। আগে জেলার ডেস্কের চাপ অনেক কম ছিল। এখন জেলাভিত্তিক আলাদা পাতা হওয়াতে চাপ বেড়েছে। বরাবর রনিতার লেখার অভ্যাস ছিল। সেই লেখা যে তার জীবিকা হবে, কখনও ভাবেনি।

আজ এসে থেকে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। বারবার শাশুড়িমায়ের কথা মনে পড়ছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, মাথার আঘাতটা আপাতভাবে দেখে গুরুতর মনে হচ্ছে না। কিন্তু হাঁটুর মালাইচাকিতে যদি জোর আঘাত লাগে তবে চিড় ধরতে পারে। ভুগতে হতে পারে। শরীরের ভিতরের ব্যাপারস্যাপার নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাই আগে টেস্টগুলো করা দরকার। খরচও হবে তিন-চার হাজার টাকা। মাসের শেষে এতগুলো টাকা জোগাড় করতে হবে। এটুকু ভেবেই দুশ্চিন্তাটা বাড়তে থাকে। তার পর? রিপোর্ট যদি খারাপ থাকে? তখন তো ভাল করে চিকিৎসা করাতে হবে। তখন কী হবে? আবার সমরেশের কথাটা মাথায় আসে। শেষ পর্যন্ত কি তবে তাকে সমরেশের শরণাপন্ন হতে হবে!

সমরেশের নামটা জীবন থেকে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু পারছে কই! বিয়ের পরই বুঝতে পারে সমরেশ শুধু তার শরীর চায়। তার মনের খোঁজ সমরেশ কোনও দিন রাখেনি। অথচ সে তো মনসর্বস্ব এক নারী। রনিতা ভাবে, শরীরের মাঝে যদি মন এসে পড়ে সেটা তো পরম পাওয়া। সে মনকে বুঝিয়েছিল, তার স্বামী হয়তো রোম্যান্টিক নয়, কিন্তু উদাসীনও নয়। না হলে তার শরীরটা এত প্রবলভাবে পেতে চাইবে কেন? কিন্তু তবুও দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। সহেলির ব্যাপারটা অনেক পরে জানতে পারে রনিতা। পরিবর্তনটা যে নজরে পড়েনি তা নয়। একটা সময়ের পর সমরেশ রোজ বাড়ি ফিরত না। তার পর পাকাপাকি ভাবে সহেলির সঙ্গে বাসা বাঁধল। নিজের মাকে দেখতেও আসত না। আর ন’মাসে ছ’মাসে এলেও, এমন সময় আসে যখন রনিতা থাকে না। ভাগ্যিস সে খবরের কাগজের চাকরিটা ছেড়ে দেয়নি। এটাই আজ তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে।

******

“এনি প্রবলেম?” তার ডেস্কের সামনে অতনু এসে জানতে চায়। রনিতা অতীত ছেড়ে বাস্তবে ফেরে। অফিসে অতনুর সঙ্গে তার বেশ ভাল সম্পর্ক। ছেলেটার হাবভাব একদম বাচ্চাদের মতো। কিন্তু কলমের জোর আছে। সপ্তাহের একটা দিন ওর রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা বার হয়। যা পড়তে পাঠকদের ভাল লাগে। এখনও বিয়ে করেনি। ওরা দু’জন দু’জনকে নাম ধরে ডাকে, আর তুমি বলে সম্বোধন করে।

“আসলে আজ সকালে আমার শাশুড়িমা পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছেন,” রনিতা বলে।

“হাসপাতালে না বাড়িতে”?

‘‘না, বাড়িতে। ডক্টর দেখিয়েছি। একগাদা পরীক্ষা করাতে হবে।”

“একে মা রাঁধে না তাই আবার পান্তো।’’

অতনুর কথাতে এত দুঃখের মাঝেও রনিতার হাসি পায়। জানে ও এমনই। জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, ‘‘আমি কি তোমাদের মতো কলকাত্তাইয়া নাকি? গ্রামের ছেলে। আমার মা এ সব বলে।’’

“তুমি সেই একই রয়ে গেলে। আমার এ দিকে যা হওয়ার তাই হচ্ছে,” রনিতা সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে।

“ভুল কিছু বললাম? এক, তোমার টাকা লাগবে। দুই, তোমার ছুটি লাগবে।”

রনিতা চুপ করে থাকে। জানে তার যে কোনও সমস্যা সমাধানে বল-ভরসা এখন অতনু।

অতনুর সঙ্গে সম্পর্কটা আগলছাড়া হচ্ছে। অতনুর সঙ্গ তাকে আনন্দ দেয়। ভাললাগায় মনটা ভরে ওঠে। অতনু তার চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট। আসলে মনের মিলটাই তো আসল, বয়সটা কোনও বাধা নয়। অতনুকে তার ভাল লাগে। অতনু কাছে এলে মনের মধ্যে একটা অন্য রকম সুর সে শুনতে পায়।

“চলো, অফিস ছুটির পর এ নিয়ে কথা হবে।”

“হ্যাঁ, আজ কাজের খুব চাপ।”

“কাজ করো। আমাকেও লিখতে বসতে হবে। বাই...”

অতনু চলে যাওয়ার পরও ভাবনাটা মন থেকে যায় না। সে তো এখনও আইনত সমরেশের স্ত্রী। তাদের ডিভোর্স হয়নি। সে পারত আইনের আশ্রয় নিতে। হয়তো বা খোরপোষ দিতে সমরেশ বাধ্য হত। তা করেনি। ঘৃণা, ঘৃণা, শুধু একরাশ ঘৃণা জমে আছে মনের মধ্যে।

******

বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা খবরগুলোতে চোখ বোলাতে থাকে রনিতা। বন্‌ধকে ঘিরে সরকারপক্ষ আর পুলিশের সঙ্গে বন্‌ধ-সমর্থকদের বিরাট সংঘর্ষের ঘটনার খবর আসছে। দ্রুত সংবাদ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেয়। কাজ করতে করতে রনিতা এটুকু শিখেছে, ঘটনা হচ্ছে খবরের কাগজের প্রাণ। এমন অনেক খবর থাকে যা টিভি নিউজে দেখানো হয় না। সেই সমস্ত খবরগুলো গুরুত্ব অনুযায়ী সাজিয়ে নিতে থাকে। বিজয় খুব পারদর্শী। কোন খবরটা কোন ডেস্কে যাবে, তার প্রাথমিক বাছাইটা করেই ও দিয়ে যায়। কাজে চাপ কমলে বাড়িতে একটা ফোন করে। না, সব ঠিক আছে।

অতনু সেই যে নিজের চেয়ারে বসেছে, আর উঠেনি। নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ লেখায় মন দিয়েছে। নিজের খবরগুলো ঠিকঠাক করে রনিতা বসে থাকে। ঘড়িতে নজর বোলাতেই দেখে, রাত্রি আটটা বেজে গিয়েছে। আবার শাশুড়িমায়ের কথা মনে পড়ে। ফোনটা করতেই শাশুড়িমা ফোন ধরেন। মিনুদি ঘণ্টাখানেক থেকে কাজ সেরে বেরিয়ে যায়। রান্নাবান্না সেরে নিজে খেয়ে শাশুড়িমাকেও খাবার দিয়ে দেয়। বিকেলের জলখাবার ঠিক করে ফ্রিজে রেখে আসে। এমনিতে মানুষটা বেশ শক্তসমর্থ। আজ কী যে হল!

“হ্যালো মা, রনিতা বলছি। আপনার শরীর এখন কেমন”?

“চিন্তা কোরো না বৌমা, আমি ঠিক আছি।”

“বিকেলের জলখাবার খেয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ মা। তুমি খেয়েছ?”

“আমার জন্য আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি চা খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, খেয়েছি।”

আজ আসার সময় ফ্লাস্কে চা রেখে এসেছিল। অন্য দিন শাশুড়িমা নিজেই করে খান।

“পায়ের ব্যথাটা এখন কেমন আছে?’’

“অনেকটা কম। চিন্তা কোরো না। সাবধানে বাড়ি এস।”

“আচ্ছা, এখন রাখি।”

******

আজ অতনুর গাড়িতে ফিরবে রনিতা। তেমনই কথা হয়েছে। আজ কাশীনাথবাবুর নাইট ডিউটি। রনিতা কাশীনাথবাবুকে বুঝিয়ে দেয়। ভদ্রলোক কানে একটু কম শোনেন। নিজে চেঁচিয়ে কথা বলেন। উনি শুনতে না পেলে দ্বিতীয়বার সে কথাটা জোরে বললে রেগে বলেন, ‘‘চিৎকার করছেন কেন? আমি কি কালা না কি?’’ কাশীবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই অতনু এসে পড়ে। তাড়া লাগায়, “বি কুইক।”

গাড়িতে বসে অতনুকে কিছুটা গম্ভীর দেখায়। যা ওর স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। রসিকতা করে রনিতা বলে, “বসের আজ মুড অফ মনে হচ্ছে? কারও সঙ্গে ঝগড়া হল না কি?”

রনিতা বুঝতে পেরেছে দেখে নিমেষে অতনু নিজেকে গুছিয়ে নেয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখে। কী নির্মল সেই চাউনি। চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু মুগ্ধতা ঝরে পড়তে থাকে। রনিতা চোখ সরিয়ে নেয়। পুরুষের এই দৃষ্টিটুকুর জন্য কত রাত প্রতীক্ষা করেছে সে। কই, সমরেশের চোখে তো তা আগে কোনও দিন ফুটে ওঠেনি। আবার চিন্তায় সমরেশ ঢুকে পড়ায় সে অতনুর দিকে মন ফেরায়।

“লেখাটা কি খুব শক্ত হয়ে গিয়েছে, পাবলিক নেবে না মনে হচ্ছে?” রনিতার কথায় অতনুর মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে ওঠে।

“পাবলিক নেবে কি নেবে না তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। মা নেবে কি না আমি তা-ই ভাবছি।”

অতনুর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারে না রনিতা। অতনু আলতো করে রনিতার হাতে হাত রাখে। রনিতা চমকে ওঠে। একটা স্পর্শ যে শরীরের মধ্যে কত কথার জন্ম দেয়!

“মা ফোন করেছিল। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে। বাবা নাকি খুব তাড়া দিচ্ছেন। একা কলকাতা শহরে ছেলেটা পড়ে আছে, তাই নিয়ে ওরা খুব চিন্তিত। আমি বলে দিয়েছি আমার মেয়ে দেখা আছে।”

অতনুর কথায় রনিতা ভাবে তার মানে অতনু এনগেজড। নিমেষে নিজেকে সামলে নেয়।

“কে গো সেই ভাগ্যবতী?’’

“তুমি।”

কী বলছে ছেলেটা! মনের মধ্যে সাময়িক আনন্দ এলেও মুহূর্তে তা মিলিয়ে যায়। চিন্তার ঝড় সমস্ত কিছুকে ওলট-পালট করে দিতে থাকে। অনেক কথার স্রোত রনিতার বুকের মধ্যে। তবুও মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হয়, “না, অতনু।” কথা শেষ হওয়ার আগেই অতনু রনিতার ঠোঁটে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। সমস্ত শরীরে একটা আলোড়ন, শিহরন। মনে হয় এই প্রথম কোনও পুরুষ-স্পর্শ পেল সে। যা তার স্বপ্নে ছিল।

******

কলিং বেল বাজাতেই শাশুড়িমা দরজা খোলেন। মানুষটাকে খুব ঝরঝরে লাগছে। যাক, ওষুধে কাজ করেছে। রনিতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

“সমরেশ এসেছিল,” লক্ষ্মীদেবীর কথায় রনিতা চমকে ওঠে।

“আমাকে নিতে এসেছিল। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি ওকে। বাকি জীবনটা মা-মেয়েতেই কাটিয়ে দেব বলেছি।”

রনিতা কিছু বলতে পারে না। এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে সে। এক দিকে লক্ষ্মীদেবী, অন্য দিকে অতনু। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। ভবিষ্যতের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE