Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ছোটগল্প: পদ্মলোচন করণ

অন্ধ অভিলাষ

সেবার দিল্লিতে দু’মাসের একটা ট্রেনিংয়ের জন্য আমার ডাক এল।  আমাকে ট্রেনিং দিতে হবে। ফিরলাম যখন তখন শুনলাম পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছে। ভাবলাম, হয়তো কোথাও বেড়াতে গিয়েছে।

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

স্মৃতি জীবনের সময়কে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায় কিনা জানি না। কথাটা এতদিন ভাবিনি। আজ অবসর সময়ে প্রায়ই মনে পড়ে যায় বহু পুরনো কথা। অনেক অনেক বছর আগের কথা। কিন্তু মনে হয় এই তো সে দিন দু-এক বছর আগের। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অনেক ছবি ... যা আজও অমলিন। স্পষ্ট। বিরাজমান।

তখন শিল্প দপ্তরে সহ-সচিবের পদে কাজ করি। দফতরে মোট পাঁচজন পিওনের মধ্যে নিবারণ একজন। চাপা রং, মাঝারি উচ্চতা ও ছিপছপে চেহারার নিবারণ অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। তা তাকে একঝলক দেখলেই বোঝা যায়। বেশ সপ্রতিভ, হাসিখুশি ও বিনয়ী ছেলেটা এক নজরে দৃষ্টি কেড়ে নেয় সকলের। আমি ওই দফতরে আসার বছরখানেক আগে কমপেনশেসন গ্রাউন্ডে বাবার চাকরিটা পেয়েছে।

বেল টিপলেই সবার আগে নিবারণ এসে হাজির। এক মুখ হেসে সবিনয় জিজ্ঞাসা, ‘‘বলুন স্যর, কী করতে হবে?’’ অফিস ছুটির পরও সেই শুধু বসে থাকে। আমার বেরনোর অপেক্ষায়।

একদিন শেষ বিকেলে অফিসে বসে একটা কিছু লিখছি। মাথা তুলতেই দেখি নিবারণ কাঁচু মাচু মুখে দাড়িয়ে। আমাকে তাকাতে দেখেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। ওর ওই অবস্থা দেখে আমি হেসে বললাম, ‘‘কী নিবারণ, কিছু বলবে?’’

সে কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল, ‘‘স্যর, সামনের রবিবার আমার বিয়ে।’’

অবাক হয়ে বললাম, ‘‘বিয়ে? সে কি নিবারণ! আগে বলনি তো? হঠাৎ ঠিক হল বুঝি?’’

একগাল হেসে সলজ্জভাবে নিবারণ বলল, ‘‘হ্যাঁ স্যর! তা একেবারেই হঠাৎ-ই...’’

‘‘তা মেয়ে কোথায় থাকে?’’

‘‘মুকুন্দপুরে স্যর। আমাদের গ্রাম থেকে ছয় মাইল দূরে। আমার মামাই সব ব্যবস্থা করেছেন। আপনাকে কিন্তু আমাদের বাড়ি যেতে হবে।’’

‘‘অফিসে আর কাউকে বলেছ নাকি?’’

‘‘দু-একজনকে বলেছি। যাবে কিনা জানি না। তবে আপনাকে অবশ্যই যেতেই হবে স্যর।’’

একটু নির্লিপ্তভাবে বললাম, দেখি, ‘‘সময় করে উঠতে পারি কি না।’’

নীচের দিকে মুখ করে নিবারণ একটুখানি হেসে বলল, ‘‘আপনি গেলে বড় ভাল লাগবে।’’

নিবারণের কথা রেখেছিলাম। সাদামাটা বাড়ি, আরও সাদামাটা বাড়ির মানুষজন। বৌ বেশ হাসিখুশি মেয়ে।

আসার সময় ওরা দু’জন প্রণাম করতে আশীর্বাদ করে বললাম, ‘‘সুখী হও।’’

পরের কয়েক মাস নিবারণের মুখে খুশি লেগে থাকত। অন্তত তাকে দেখে তাই মনে হত। একদিন ডেকে বললাম, ‘‘নিবারণ বৌ কেমন হয়েছে?’’

নিবারণ সলজ্জ হেসে বলল, ‘‘ভাল স্যর। তবে বড় বায়না করে।’’

হেসে বললাম, ‘‘এই কথা! আরে ও এখন ছেলেমানুষ। বায়না তো একটু করবেই।’’

‘‘সেটা তো আমি বুঝি স্যর। তবে ওর বায়না একটু অন্য রকম।’’

‘‘কী রকম?’’ আমি একটু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

নিবারণ একটু চুপ করে মাথা নিচু গলায় বলল, ‘‘স্যর। আমি যে পিওনের চাকরি করি, আমার মাইনে যে কম, এটা বোধ হয় ওর পছন্দ নয়। কথায় কথায় টাকা নিয়ে অন্যের সঙ্গে আমার তুলনা করে। বলুন স্যর, এটা কি ঠিক?’’

বুঝলাম বৌয়ের কথায় নিবারণের আত্মসম্মানে ঘা খেয়েছে।

ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘‘মন খারাপ করো না নিবারণ। বিয়ের পর সব মেয়েই চাকুরে স্বামীর আয় নিয়ে কটাক্ষ করে। ও নিয়ে কিছু ভেবো না। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।’’

নিবারণ চুপ করে রইল। কোনও উত্তর দিল না।

সেবার দিল্লিতে দু’মাসের একটা ট্রেনিংয়ের জন্য আমার ডাক এল। আমাকে ট্রেনিং দিতে হবে। ফিরলাম যখন তখন শুনলাম পনেরো দিনের ছুটি নিয়েছে। ভাবলাম, হয়তো কোথাও বেড়াতে গিয়েছে।

নির্দিষ্ট দিনেই নিবারণ ফিরল। কিন্তু আড়াই মাসের ব্যবধানে ওকে দেখে মনে হল যেন অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। আগের মতো সেই উৎফুল্ল ভাব নেই। কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে আছে। সেটা লক্ষ্য করেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী নিবারণ শরীর ভাল আছে তো? বাড়ির সব খবর ভাল?’’

নিবারণ শুকনো মুখে উত্তর দিল, ‘‘এমনি তো ভাল আছি স্যর, তবে...’’

‘‘কী তবে?’’

‘‘স্যর, একটা সমস্যায় পড়েছি। আপনি ছিলেন না, তাই বলতে পারিনি।’’

‘‘কী সমস্যা?’’

‘‘সে অনেক কথা স্যর। বিকেলে আপনি ফাঁকা হলে আসব। তখন বলব।’’

‘‘ঠিক আছে।’’

সে দিন বিকেলে অফিস ফাঁকা হলে নিবারণ আমার ঘরে এল। বলল, ‘‘স্যর, পরিবারের কথা, নিজের বৌয়ের কথা সবাইকে তো বলা যায় না। আবার না বললেও সমস্যার সমাধান হয় না। আপনি তো আমার সব জানেন স্যর। আমার বৌকেও দেখেছেন...’’

‘‘তা দেখেছি। তোমাদের সমস্যাটা কী?’’

‘‘স্যর, সেটা এক মাত্র ঈশ্বরই জানেন। আমি আমার স্ত্রীকে কত ভালবাসি। ও প্রথম থেকেই একটু নাক উঁচু ছিল। সেটা বুঝেই শুধু ওকে সুখী করার জন্য আমি আমার পক্ষে যা করা সম্ভব তাই করেছি। এর মধ্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে দু-বার লোন নিয়েছি। আমার যা সম্বল ছিল শেষ করে ওর অনেক বায়না মিটিয়েছি। কিন্তু এত করেও...’’এটুকু বলেই থেমে গেল নিবারণ।

‘‘কী নিবারণ?’’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘‘ও বোধ হয় আমাকে ভালবাসে না। প্রথম প্রথম ও আমার চাকরি নিয়ে,আমার আয় নিয়ে কটাক্ষ করত। তাতে খারাপ লাগলেও কিছু মনে করিনি। কিন্তু যে দিন জানলাম, ও বিয়ের আগে থেকেই আর একজনকে ভালবাসে, এবং এখনও ওর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সে দিন বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তুএটাই চরম সত্যি।’’

চমকে উঠলাম। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম।

নিবারণ আমার ভাবটা লক্ষ্য করল। সামান্য করুণ হাসি হেসে বলল, ‘‘স্যর, অনেক খোঁজ নিয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি। ওর বাবার বাড়ির গ্রামের একটা ছেলে। ঠিকাদারি করে অনেক টাকা করেছে। আগে থেকেই ওদের ভালবাসা। আমার অনুপস্থিতিতে এখনও ওদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’’

‘‘তুমি তো বৌকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো পারো,’’ না থাকতে পেরে বলেই দিলাম।

নিবারণ একই ভাবে বলল, ‘‘করিনি আবার? কিন্তু ও আমার কাছে একটা কথাও স্বীকার করল না। উল্টে আমার সন্দেহ করার বাতিক আছে বলে অভিযোগ করল।’’

‘‘কিন্তু এমনও তো হতে পারে নিবারণ, তুমি যা শুনেছ সব ভুল। মিথ্যে রটিয়ে তোমাদের ক্ষতি চাইছে কেউ। আজকাল তো মন্দ লোকের অভাব নেই।’’

‘‘তা নেই। কিন্তু খামোখা স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে লোকে যাবে কেন? তাছাড়া...’’

‘‘কী?’’

নিবারণ সারাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘স্যর, একটা বিশেষ সময়ে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিশেষভাবে কাজ করে। যার দ্বারা কোনটা সত্যি তার আভাস পাওয়া যায়।’’

বাধা দিয়ে বললাম, ‘‘না নিবারণ, ইন্দ্রিয় দিয়ে সব সময় সব কিছু বোঝা যায় না। যেখানে তোমার জীবনের সুখ শান্তি নিহিত আছে সেখানে নিজের দৃষ্টি ছাড়া অন্য কিছুতে বিশ্বাস করা খুব শক্ত। এত সহজে মানুষের উপর বিশ্বাস হারিও না নিবারণ। ভগবান করুন, তোমার সব আশঙ্কা যেন ভুল হয়।’’

নিবারণ সে দিন আমার শেষের কথায় কতটুকু আশ্বস্ত হয়েছিল জানি না। শুধু কোনও কথা না বলে বিমর্ষ ও চিন্তাক্লিষ্ট মনে বিদায় নিয়েছিল।

দিল্লিতে ট্রেনিংয়ের সুবাদে মাসখানেকের মধ্যে আমার অন্য জেলায় বদলি হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে চলে আসতে হয়েছিল। নিবারণের সঙ্গে যোগাযোগ আর হয়ে ওঠেনি। জেলায় এসে কাজের ব্যস্ততায় ওর কথা প্রায় ভুলে গেলাম। বছর দুই-আড়াই এভাবেই কেটে গেল।

সে বার সল্টলেকে তিন দিনের জন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম। বিকাশভবনের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। হঠাৎ পিছন থেকে ‘স্যর’ ডাক কানে এল। ফিরে দেখি নিবারণ। ছুটতে ছুটতে আমার কাছে আসছে।

ও কাছে আসতে বললাম, ‘‘নিবারণ তুমি?’’

একটু দম নিয়ে ও বলল, ‘‘হ্যাঁ স্যর। আমি ওদিকে যাচ্ছিলাম। দূর থেকে হলেও আপনাকে ঠিক চিনেছি। অনেকদিন পর দেখা... না স্যর?’’

আমি নিবারণের দিকে ভাল করে তাকালাম। ওর আর সেই চেহারা নেই। কেমন একটা রোগাটে শরীর। গায়ের রঙের জৌলুস নেই। চোখ দুটো অনেকটাই কোটরগত। চুল কমে গিয়েছে। বললাম, ‘‘হ্যাঁ, অনেকদিন পর দেখা হল। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?’’

নিবারণ একটু হাসল। বলল, ‘‘আমার কথা থাক স্যর। বলুন আপনি কেমন আছেন?’’

‘‘আমি ভালই আছি। এখন তো জেলায় চলে গিয়েছি। তোমাদের সঙ্গে তো দেখা হয় না। তুমি বলো, আফিস কেমন চলছে? তুমি কী ওই অফিসেই আছো?’’

‘‘তা আছি স্যর।’’

‘‘বেশ বেশ। তোমার বা়ড়ির খবর কী? তোমার বৌ কেমন আছে? আর কোনও সমস্যা নেই তো?’’

নিবারণ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘না স্যর আর কোনও সমস্যা নেই। বৌ বেশ ভালই আছে।’’

‘‘ছেলেপেলে হয়েছে কিছু?’’

নিবারণ খুব আস্তে করে বলল, ‘‘তা হয়েছে স্যর।’’

আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘‘বাহ্‌ খুব ভাল খবর। মনে আছে, তখন বলেছিলাম, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। তা এদিকে কোথায় যাচ্ছিলে?’’

‘‘বৌয়ের কাছে যাচ্ছিলাম স্যর। ও এদিকে থাকে কিনা।’’

অবাক হয়ে বললাম, ‘‘সে কি তুমি এখন সল্টলেকে থাকো নাকি? ভাড়া না কোয়ার্টার পেয়েছ?’’

নিবারণ একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিল। তার পর বলল, ‘‘সে অনেক কথা স্যর। কিন্তু তার আগে যদি আপনার সময় থাকে সামনের ওই চায়ের দোকানে বসবেন একটু? চা খেলে ভাল হতো।’’

‘‘ঠিক বলেছো, আমার সময় আছে। চলো, চায়ের দোকানেই যাওয়া যাক।’’

দোকানে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিবারণ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বলল, ‘‘স্যর, ভগবান আপনার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন। সে জন্য আপনাকে আমার সব কথা না বললে আমি শান্তি পাব না। আমার পাপও হবে।’’

এটুকু বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল নিবারণ। তার পর খুব ধীর স্বরে বলল, ‘‘আমার বৌ আবার বিয়ে করেছে স্যর।’’

চমকে উঠলাম। বিস্ময়ে বলে উঠলাম, ‘‘কি বলছো নিবারণ?’’

‘‘হ্যাঁ স্যর। অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু বৌকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ও সেই ঠিকাদার ছেলেটির সঙ্গে একেবারেই মজে গেল। এক দিকে ভালবাসা, অন্য দিকে টাকার লোভ। সে আর কিছুতেই আমার কাছে ফিরতে পারল না। আমিও দেখলাম জোর খাটিয়ে কী লাভ? ভালবাসা তো আর জোর করে পাওয়া যায় না? তার চেয়ে ও যদি অন্যকে ভালবেসে সুখী হয় – আমি তাতে বাধ সাধব কেন? সে আমাকে না ভালবাসুক, আমি তো তাকে ভালবাসি। আর আমি যাকে ভালবাসি, তার সুখের জন্য আমাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে বইকি!’’

দুপুর রোদের তাপ গায়ে এসে লাগছে। হয়তো রাস্তার পিচ গরম হয়ে গলতে শুরু করবে। চায়ের দোকানে আমরা দু’জন ছাড়া কেউ নেই। কিছুটা দূরে বুড়ো দোকানদার উনুনে কয়লা ঠেলছে। তারও ওপারে গাছের রোদ ঝলসানো পাতাগুলো কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে রয়েছে।

নিবারণের কথা আমাকে চুপ করিয়ে দিল। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিবারণের ভালবাসা এত গভীর, এত নিঃস্বার্থ!

মুখে বললাম, ‘‘তার পর?’’

নিবারণ আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে কোনও এক সুদূর পানে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘‘আমি বৌকে ডিভোর্স দিলাম স্যর। ওরা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করল। সল্টলেকে ছেলেটির বড় বাড়ি। ওরা এখন ওখানেই থাকে।’’

আমি ধীর স্বরে বললাম, ‘‘কিন্তু তোমার ছেলে?’’

নিবারণ হেসে বলল, ‘‘ছেলে নয় স্যর, মেয়ে। ওটা আমার নয় ওদের। মাস কয়েক হল হয়েছে। বেশ ফুটফুটে হয়েছে স্যর।’’

আমার সব কিছু আবার গুলিয়ে গেল। বললাম, ‘‘তবে তুমি যে একটু আগে বললে বৌ এর কাছে যাচ্ছিলে? তা হলে? সেটাও কি ঠিক কথা নয়? অন্য কোথাও যাচ্ছ?’’

নিবারণ মাথা নেড়ে বলল, ‘‘ওদের বাড়ির কাছে যাই স্যর। ওদের কাছে না। দূর থেকে দেখি। বাস স্ট্যান্ডের গায়ে ওদের বাড়ি। রাস্তা থেকে ওদের বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যায়। কোনও সময় বৌ তো মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় আসে। তখনই গাছের আড়াল থেকে এক পলক দেখি। বৌ বা অন্য কেউ বুঝতে পারে না। অবশ্য সব দিন তো দেখতে পাই না। কোনও কোনও দিন না দেখতে পেয়ে চলে আসি। ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে বৌয়ের হাসিমুখ দেখলে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায় স্যার।

তার পর একটুখানি চুপ করে মাথা নিচু করে নিবারণ বলল, ‘‘কি করব স্যর, জানি এটা খুবই অন্যায়, ও এখন পরস্ত্রী, কিন্তু মন যে মানে না। মনকে কত করে বোঝাই, কিন্তু এখনও শাসনে আনতে পারিনি যে।’’

চোখ দুটো চকচক করে উঠল নিবারণের। আমার চোখে চোখ রেখে মিনতি করল, ‘‘আমাকে একটা উপায় বলে দেবেন স্যর? যাতে বৌয়ের কথা আমার মনে না পড়ে। যাতে ওদের আমি ভুলে থাকতে পারি।’’

আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি। কী বা উত্তর দেব? মনে মনে ঈশ্বরের কাছে চাইলাম, ঈশ্বর যেন নিবারণের ইচ্ছে পূরণ করেন।

নিবারণ উঠে দাঁড়াল। বলল,‘‘স্যর, আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। আমি এখন আসি।’’

নিবারণ পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। আমার চোখের সামনে ওর অবয়বটা ক্রমশ ছোট হতে হতে এক সময় হারিয়ে গেল।

অনেক বছর আগের কথা। অবসর জীবনের অগোছালো সময়গুলোর ফাঁকে মাঝে মধ্যে এখনও নিবারণের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। মনে হয় কেমন আছে নিবারণ এখন? সে কি তার স্ত্রীকে আদৌ ভুলতে পেরেছে? না কি এখনও আড়ালে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে রাস্তার ধারের বারান্দার দিকে? তার এক সময়ের স্ত্রীকে একটুখানি দেখার আশায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE