Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

অন্য এক অয়দিপাউস

নিজের মা’কে খুন করেছিল ছাব্বিশ বছরের টনি। এই একটি হত্যার আগুপিছু জেনে গোটা মার্কিন মুলুক সে দিন নড়ে গিয়েছিল। ষাট-সত্তরের দশকে এই বেকল্যান্ড পরিবারের কেচ্ছা ছিল ব্যতিক্রমী, রগরগে ও থ্রিলার-প্রতিম। যদিও পরিবারটিকে ‘সাদামাটা’ বলা চলে না, কারণ কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র বারবারা ড্যালি বেকল্যান্ড ছিলেন ব্যাকেলাইট আবিষ্কর্তা লিও বেকল্যান্ডের নাতবউ।

সুস্নাত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

নিজের মা’কে খুন করেছিল ছাব্বিশ বছরের টনি। এই একটি হত্যার আগুপিছু জেনে গোটা মার্কিন মুলুক সে দিন নড়ে গিয়েছিল। ষাট-সত্তরের দশকে এই বেকল্যান্ড পরিবারের কেচ্ছা ছিল ব্যতিক্রমী, রগরগে ও থ্রিলার-প্রতিম। যদিও পরিবারটিকে ‘সাদামাটা’ বলা চলে না, কারণ কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র বারবারা ড্যালি বেকল্যান্ড ছিলেন ব্যাকেলাইট আবিষ্কর্তা লিও বেকল্যান্ডের নাতবউ। ব্যাকেলাইট, মানে বাণিজ্যিক প্লাস্টিকের প্রাথমিক রূপ, যা গোটা বিশ্বের ছবিটাই বদলে দিচ্ছিল বিশ শতকের শুরু থেকে। স্বভাবতই অর্থের অভাব ছিল না। এ হেন পরিবারে ব্রুকস বেকল্যান্ডের বউ হয়ে এলেন পরমা সুন্দরী মডেল বারবারা। জন্ম নিল তাঁদের সন্তান অ্যান্টনি, ওরফে টনি। শুরু থেকেই ছেলেকে নিয়ে বড্ড বেশি সচেতন, খানিক পজেসিভও ছিলেন বারবারা। সেই অতিসচেতনতাই ভবিষ্যতে গোটা সংসারটা ছারখার করে দেবে।

টনি কিছুটা বড় হতেই বোঝা যেতে লাগল, সে সমকামী। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল বারবারার। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তত দিনে এক অস্ট্রেলীয় যুবক জেক কুপারের সঙ্গে তুমুল দোস্তি হয়ে গিয়েছে টনির। কুপার ছিল উভকামী। তার ওপর নানাবিধ শুকনো নেশার চক্করেও সিদ্ধহস্ত। তারা জোট বেঁধে পাড়ি দিল মরক্কো, ক্যানাবিসের পীঠস্থান। ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে ধাওয়া করলেন মা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টনিকে নিয়ে ফিরলেন। নিমরাজি হলেও মেনে নিলেন কুপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক। কিন্তু তলে তলে ব্যবস্থা করলেন অন্য। এই সফরেই টনির সঙ্গে আলাপ হয় স্পেনীয় যুবতী সিলভি-র, সুযোগ বুঝে তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চাইলেন ছেলের। সিলভিকে প্রায় ঘরে এনেই তুললেন। কিন্তু খেলা ঘুরে গেল অন্য দিকে। টনির বাবা ব্রুকস আর সিলভি পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন। সিলভিকে নিয়ে ঘর ছাড়লেন ব্রুকস। আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন ভগ্নহৃদয় বারবারা।

আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসার চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে টেনশন ক্রমশ বাড়ছে। টনিকে ‘শোধরাতে’ এ বার যৌনকর্মীদের দ্বারস্থ হলেন বারবারা। সে প্রয়াসও ব্যর্থ হতে, তাঁকে চূড়ান্ত অস্ত্রটা বের করতেই হল। নিজেই রণাঙ্গনে, মানে বিছানায় নামলেন! ছেলের সামনে নিজেকে উজাড় করে দিলেন সুন্দরী বারবারা। অসমকামে অনিচ্ছুক ছেলের সঙ্গে জোর-জবরদস্তি সঙ্গম করতে চাইলেন। ছেলেকে ‘পথে আনতে’ চাওয়ার তীব্র বাসনার দাম এ বার চোকাতে হল মা’কে। টমির মধ্যে ক্রমশ দেখা দিচ্ছিল স্কিৎজোফ্রেনিয়া ও প্যারানোইয়ার লক্ষণ। হঠাৎই এক দিন সামান্য কথা-কাটাকাটির জেরে রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি এনে মায়ের বুকে বসিয়ে দেয় সে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। পুলিশ যখন এল, টমি তখন নির্বিকার মুখে ফোনে চাইনিজ অর্ডার করছে। তারিখটা ছিল ১৭ নভেম্বর ১৯৭২। এই ঘটনা-পরম্পরায় ইউরোপ ও মার্কিন জনমানসে এতটাই গভীর ধাক্কা পৌঁছয়, এতটাই ‘শকিং’ লাগে যে দীর্ঘ দিন পরেও তা নিয়ে বই লেখা হয়, বারবারা-টমি চলচ্চিত্রের কাহিনি হয়ে ওঠেন। ২০০৭ সালে মুক্তি পায় ‘স্যাভেজ গ্রেস’ (সঙ্গের ছবি)। সে ছবিতে বারবারা-গ্রিন-টমির উত্তেজক ‘থ্রিসাম’ দৃশ্যটি নিয়েও ঢের জল-ঘোলা হয়। একই বিছানায় মা, পুত্র ও মায়ের প্রেমিক পরস্পর আলিঙ্গনবদ্ধ ও খিলখিল হাসিতে যৌনক্রীড়ারত! সিনেমার এ অংশটি আগাগোড়া মিথ্যে ও বিভ্রান্তিকর, এই অভিযোগে মামলা করেন স্যামুয়েল গ্রিন স্বয়ং।

তবে, বাস্তবিকই এই ঘটনার একটা রাউন্ড-আপ ছিল। ১৯৮০ সালে সংশোধনাগার থেকে ছাড়া পায় টমি। তাকে নিউ ইয়র্কে দিদিমা নিনা ড্যালির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক ছ’দিনের মাথায় দিদিমাকেও ছুরি দিয়ে আঘাত করে বসে টমি। ঘটনাচক্রে নিনা বেঁচে যান, কিন্তু টমিকে ফের গ্রেফতার করে পুলিশ। এর এক বছরের মধ্যেই সংশোধনাগারের ভেতর এক দিন পাওয়া যায় টমির নিথর দেহ। শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু। সম্ভবত আত্মহত্যা। ‘ফাদার অব প্লাস্টিক’ লিও বেকল্যান্ডের প্রপৌত্র মৃত অ্যান্টনি বেকল্যান্ডের মুখ তখনও ঢেকে রেখেছে সদ্য-ব্যবহৃত শ্বাসরোধের অনিবার্য অস্ত্রটি— একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ।

susnatoc@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE