Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

অ ত ছোট্ট বাছুর আমি কখনও দেখিনি। কী যে হরিণ হরিণ! ল্যাগব্যাগ করছিল। ভাল করে হাঁটতেও পারছিল না এক্ষুনি জন্মানোর পর। ওর মায়ের মুখটা খুব ক্লান্ত। সূর্য ডুবে আসছিল। পুরো ঘটনাটা এত মায়াময় ছিল, যেন লীলা মজুমদারের লেখা বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের গলার আর বুকের কাছে বাসা বাঁধছে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:১৫
Share: Save:

অ ত ছোট্ট বাছুর আমি কখনও দেখিনি। কী যে হরিণ হরিণ! ল্যাগব্যাগ করছিল। ভাল করে হাঁটতেও পারছিল না এক্ষুনি জন্মানোর পর। ওর মায়ের মুখটা খুব ক্লান্ত। সূর্য ডুবে আসছিল। পুরো ঘটনাটা এত মায়াময় ছিল, যেন লীলা মজুমদারের লেখা বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের গলার আর বুকের কাছে বাসা বাঁধছে।

পর দিন দুপুর। হরিপদ গরুর খড় কাটছে। বাইরেটা তেতেপুড়ে খাক। শুকনো গরম হাওয়া আর লালমাটির খরখরে প্রকৃতি। একটা দুর্দান্ত মেলানকলি। বাছুরটা মাঝে মাঝেই হাম্বা ডাক দিচ্ছে। আমি শুয়ে ছিলাম, এক দৌড়ে গেলাম গোয়ালের বাইরেটায়। এই সময় দুধ দোয়ানো হয়। চাঁইচুঁই করে মা-গরুটার দুধ দুইতে ওস্তাদ হরিপদ। আমি অনেক বার দুইতে চেয়েছি, কিন্তু দেয়নি। উল্টে মা’কে নালিশ করেছে।

আজ ফের গিয়েছি দুধ দোয়ানো দেখতে। ছোট্ট বাছুরটা বার বার ছুট্টে আসছে দুধ খাবে বলে। হরিপদ ওকে বার বার সরিয়ে দিচ্ছে। সে-ও নাছোড়। আমি খুব খানিক রাগ করে বললাম, ‘হরিপদ, এই গরুটা তো এই বাছুরটার মা, তুমি কেন সরিয়ে দিচ্ছ ওকে?’ হরিপদ নির্বিকার হয়ে বলল, ‘তা হলে গরুর দুধটা ভাল হবে না গো দিদি। আমি বের করে দিই। দু-এক দিনে ভাল দুধ দেবে গরু।’ গোড়ায় কিছু বলতে পারলাম না আমি। তার পর একটু দিদিগিরি ফলিয়ে বললাম, ‘তুমি ওকে খেতে দাও না। একটু পরে দুধ দুইবে।’ হরিপদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তখন আর দুধ থাকবে না গো দিদি।’

আমি আর আমার ঢাল-তরোয়াল খাড়া রাখতে পারলাম না। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম। আর হরিপদকে অভিসম্পাত করতে থাকলাম, ‘তুমি বাজে লোক। আর কোনও দিন তোমার পিঠে উঠব না। কোনও দিন তোমার সঙ্গে চাষ দেখতে যাব না।’ কিন্তু হরিপদ আমার মামার বাড়ির পুরনো লোক। তার এ সব ফ্যাঁচফ্যাঁচে কান দেওয়ার মেলা সময় নেই। সে কেবল বলল, ‘বাছুরটাও দুষ্টু, ও একটু আগেই খেয়েছে গো দিদি।’ কিন্তু আমার কান্না থামেই না।

কিছু ক্ষণ পরে বাছুরের মা’কে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাছুর আর তার দুধটুকু পেল না। সে ভারী হাম্বা হাম্বা চেঁচাতে লাগল। আমি ছুট্টে রান্নাঘর থেকে এক বাটি দুধ এনে দিলাম তার সামনে। খেল না। অনেক বোঝালাম, এটা তারই মায়ের দুধ। বাটিতে রয়েছে শুধু। তবু খেল না। আমার ফোঁপানি ছিল সারা সন্ধে।

আমাদের বাড়ি জয়েন্ট ফ্যামিলি। সঙ্গে ঢালাও দেশের লোক আসা, থাকা, আর এন্তার আত্মীয়স্বজন মায় অপরিচিতের আনাগোনা রাত অবধি। সেই ঝামেলা ম্যানেজ করতে করতে বিকেল, সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে যেত মা-জেঠিমার। স্কুল থেকে ফেরা, খেলা, হোমওয়ার্ক বেয়ে চোখ টেনে আসত, তবু মায়ের কাছটা ঠিক করে পেতাম না। রোজ শুনতাম, ‘একটু বোঝো সোনা, কত লোক এসেছে না।’ বাছুরটার চেয়ে কতই বা বড় আমি তখন? বছর ছ-সাত।

পর দিন সকালে আমার সামনেই বাছুরকে দুধ খাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু সেই বিকেলটায় বাছুরটার ছটফটানি আমার আর হরিপদ’র— যে কিনা আমায় ঘাড়ে করে খেতের আল দিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেত, হ্যাট হ্যাট গরুর গাড়ি চালিয়ে বনে বেড়াতে নিয়ে যেত, কাঁচা আম পেড়ে আর খেজুর গাছে উঠে রস নামিয়ে খাইয়েছিল— সেই পরম নির্ভরশীল বন্ধুত্বের মাঝখানে, ছোট্ট কাঁটা পায়ের তলায় বিঁধে যাওয়ার মতোই খচখচে হয়ে রইল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay deer book milk cow
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE