Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উল্কি

ফা রহান আখতারের ‘ডন টু’-র অনেক আগেই শরৎচন্দ্র দেবদাসকে ‘ডি’ উল্কি পরিয়েছিলেন, কলকাতায় প্রথম গিয়ে নিজের হাতে নাম দাগিয়েছিলেন দেবদাস। আগেকার কালে গ্রামের জমিদারনন্দনরা শহরে এসেই নানা বিভঙ্গে উড়তে শুরু করতেন, আজকের মতো ‘ট্যাটু বুটিক’ না থাকলেও কলকাতায় রাস্তাঘাটে বেদে বুড়িরা শলা আর কালি নিয়ে পসরা সাজাতেন।

বরুণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

ফা রহান আখতারের ‘ডন টু’-র অনেক আগেই শরৎচন্দ্র দেবদাসকে ‘ডি’ উল্কি পরিয়েছিলেন, কলকাতায় প্রথম গিয়ে নিজের হাতে নাম দাগিয়েছিলেন দেবদাস। আগেকার কালে গ্রামের জমিদারনন্দনরা শহরে এসেই নানা বিভঙ্গে উড়তে শুরু করতেন, আজকের মতো ‘ট্যাটু বুটিক’ না থাকলেও কলকাতায় রাস্তাঘাটে বেদে বুড়িরা শলা আর কালি নিয়ে পসরা সাজাতেন। বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ কলকাতার প্রথার তালিকাতে লিখে গিয়েছেন উল্কি বৃত্তান্ত: ‘উলকি পরা আমরা ছোটবেলায় দেখিয়াছি, তারপর ক্রমে উঠিয়া গেল। ...বিশেষতঃ যারা জাহাজে কাজ করে তাহাদের ভিতর এটার বিশেষ প্রচলন। তাহারা জাহাজের নোঙর, দড়ি ইত্যাদি বুকে পিঠে হাতে আঁকিয়া লয়।’

সত্যি, জাহাজের সঙ্গে উল্কির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। জোব চার্নক যখন সবে জাঁকিয়ে বসতে চলেছেন এঁদো সুতানুটিতে, তখন শেষ হচ্ছে তাঁর এক দেশোয়ালি ভাইয়ের পরিক্রমা। অস্ট্রেলিয়া, সুমাত্রা, নিকোবর সফর শেষে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে দেশে ফিরছেন উইলিয়াম ডাম্পিয়ের। স্বাস্থ্য থেকে অর্থ— সবই গেছে নাবিকি নেশায়। সুসভ্য বিলেতকে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায় এমন তুরুপের তাস একটাই পড়ে আছে তাঁর আস্তিনে। কোনও শামুক-ঝিনুক-গজমোতি-মসলিন নয়, একটা আস্ত মানুষ!

জিয়োলো’কে ডাম্পিয়ের নগদ কড়িতে কিনেছিলেন ফিলিপিন্‌স-এর মিন্ডানাও থেকে। সে অবশ্য যে-সে মানুষ নয়। ডাম্পিয়ের তার নাম রেখেছেন সচিত্র শাহজাদা। পুবের দেশগুলো থেকে তুলে আনা সোনার জলে আঁকা পুথির মতোই এগজিবিট করা হল মোয়ানজিস উপদ্বীপের এই রহস্যময় রাজপুত্রকে। মুখ এবং হাত-পায়ের পাতা ছাড়া শরীরের গোটা দৃশ্যমান অংশ এমন বিচিত্র বর্ণময় নকশায় ঢেকে আছে যে মানুষটাকেই চোখে পড়া মুশকিল। সাহেবরা তখনও ট্যাটু চোখে দেখা তো দূরের কথা, শব্দটাই শোনেনি। তখন ক্যামেরা বলেও কোনও বস্তু নেই। তাই সে আমলের ওস্তাদ খোদাইশিল্পী জন স্যাভেজ-এর ডাক পড়ল এই আইটেম’টির ছবি ধরে রাখার জন্য। স্যাভেজের মনে হয়েছিল, অত্যন্ত গুণী কোনও শিল্পী অসামান্য সূক্ষ্মতায় এই চিত্রময়তা সৃষ্টি করেছেন। এর রং এমন পাকা, ধুলে, এমনকী খুঁটলেও উঠে যাবে না। যে রহস্যময় লতাপাতা থেকে এই রং তৈরি করা হয়েছে, তার রঙিন রসে ডুবিয়ে রাখলে মৃতদেহেও পচন ধরে না, আবার সেই রসে ডোবানো তির বিঁধলে বড় জন্তুজানোয়ারও ঘায়েল হয়ে যায়।

কিন্তু এই বি‘চিত্র’ রাজপুত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেলেন— সারা দেহের উল্কি তাঁকে বাঁচাতে পারল না গুটিবসন্তের সংক্রমণ থেকে। আরও প্রায় আট দশক পর, তাহিতি দ্বীপ থেকে ট্যাটু আর ট্যাবু— এই এক জোড়া শব্দ ইংল্যান্ডে আমদানি করলেন ক্যাপ্টেন কুক। উল্কির ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে দুনিয়াভর পরিচিত ‘ট্যাটু’ শব্দটা ইংরেজি অভিধানে প্রবেশ করাতে কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাকে, কারণ সামরিক কুচকাওয়াজ শেষে সৈন্যদের ঘরে ফেরানো ভেরীর আওয়াজকে ওই নামেই ডাকা হত। ক্রমে ‘ট্যাটু’ শব্দটার চালু মানে দাঁড়িয়ে গেল অনেকটা মার্কামারা লোকের মার্কা, বা দাগির ‘দাগ’-এর মতো। অসভ্য এবং অপরাধীদের ছাপ মেরে দেওয়ার আর একটা শব্দশলাকা পেয়ে গেলেন সুসভ্যরা। তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি, ইউরোপ-আমেরিকার গোকুল জুড়ে বাড়ছে এমন এক রুচি এবং স্টাইল, যা এই চিহ্নকে কোটি ডলারের ব্যবসায় পরিণত করে ফেলবে।

কে না জানে বাংলা দু’শো বছর ধরে আজ তাই ভাবত, যা ইংরেজ গত কালই ভেবে ফেলেছে। অভ্যাসের ওই খোঁয়ারি আজও বেশ তাজা। এ দেশে উল্কি ব্যাপারটা বিলেত থেকে আসেনি, অনেক কাল ধরেই ছিল। কিন্তু নবজাগরণের জোয়ারে খাই-খাই করতে থাকা পড়িলিখি বাঙালিও ধরে নিল আদরসোহাগ আর সাজগোজের এই মুদ্রাটি অসভ্যতার ব্যাপার। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখাতেও এই ঝোঁকটা ফুটে উঠেছে: ‘তখনকার দিনে নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোকেরা ও গ্রাম্য স্ত্রীলোকেরা উলকি পরিত। কপালে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে, দাড়িতে এমন কি নাকের উপরেও উলকি পরিত। পূর্ববঙ্গের স্ত্রীলোকদিগের ভিতর অদ্যাপিও সে প্রথা আছে।’

গোলমেলে চরিত্রদের উল্কি দিয়ে দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাস থেকে বঙ্কিম রবীন্দ্র শরৎ কেউ বাদ যাননি। বঙ্কিমের কমলাকান্তের রসবতী নাগরী প্রসন্ন গোয়ালিনী মোটাসোটা গোলগাল বয়সে চল্লিশের নীচে, দাঁতে মিশি, হাসিভরা মুখ, কপালে একটি ছোট উল্কি। আনন্দমঠের গৌরী ঠাকরুনের খোলতাই বর্ণনাতেও উল্কি দেগেছেন সাহিত্যসম্রাট— তিনি অর্ধবয়স্কা, মোটাসোটা, কালো-কালো, ঠেঁটি পরা, কপালে উল্কি। বিদেশের ঠাকুর ফেলে দেশের কুকুর ধরা তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্ত এ দেশের অন্তঃপুরিকাদের বেশভূষাপ্রসাধনে উল্কির উল্লেখ করেছেন সকৌতুকে—

‘শাড়ি পরা এলোচুল, আমাদের মেম।

বেলাক নেটিব লেডি, শেম শেম শেম।

সিন্দুরের বিন্দু সহ, কপালেতে উল্কি।

নসী, জশী, ক্ষেমী, বামী, রামী, শামী, গুল্কি’

দেবদাস যে শহরে এসেই বখে গিয়েছিল, সে সংকেত তো শরৎবাবু দিয়েইছিলেন। শ্রীকান্ত কমললতার আখড়ায় গিয়েছিল শুনেই রাজলক্ষ্মী বলে উঠেছিল— সেখানে সব নাক খাঁদা উল্কিপরা বোষ্টুমী থাকে এবং তারা মোটেই সুবিধের নয়। আর বর্মায় উল্কি পরা কামিনী বাড়িউলি যে চরিত্রহীন, তা তো স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শরৎবাবু।

উল্কির সঙ্গে অসভ্যতার সমীকরণের আঁচ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন কিশোরবেলার বিলেত প্রবাসে। নববর্ষ উপলক্ষে এক সাহেব ডাক্তারের পরিবারে তিনি আসবেন শুনেই, সে বাড়ির মেজো আর ছোট মেয়ে পালিয়েছিলেন বাড়ি ছেড়ে। ভারতবর্ষের যে লোকটা বাড়িতে হাজির হয়েছে, তার মুখে উল্কি আর ঠোঁট-ফোঁড়া অলংকার নেই শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

বিশ শতকের দিকে পা বাড়ানো ইংল্যান্ডে উল্কি নিয়ে নানারকম ছুঁতমার্গের বজ্র আঁটুনি থাকলেও ফস্কা গেরোও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। জনরব ছিল, স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া নাকি শরীরের গোপন স্থানে একটি উল্কি দাগিয়েছিলেন এবং সেটি এঁকেছিলেন যন্ত্ররসিক শিল্পী অ্যালফ্রেড চার্লস সাউথ। ইনিই প্রথম ইংল্যান্ডে ট্যাটু-মেশিনের পেটেন্ট নেন।

উল্কির যন্ত্র তৈরির কাহিনিও বেশ রোমাঞ্চকর। তবে ব্যাপারটা খানিকটা হঠাৎ করেই ঘটে গিয়েছিল আমেরিকায়— খোদ টমাস আলভা এডিসনের ল্যাবরেটরিতে। তিনি বানাতে চেয়েছিলেন মোটর লাগানো একটা কলম। পেটেন্টও নিয়েছিলেন। এই উদ্ভাবন বাণিজ্যিক সাফল্য পাবে না আঁচ করেই যন্ত্রটাকে নিয়ে বেশি কিছু ভাবেননি এডিসন। খেলনা গোছের জিনিসটাকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে নাকি সেই দিয়েই পাঁচ-ফুটকি একটা উল্কি ফুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজের হাতে। পরে সেই হাত এডিসনের মতো ধুরন্ধর ব্যবসায়ী কত বার কামড়েছিলেন কে জানে!

সিক্স-প্যাকায়িত আমির খান-কে ‘গজনি’-তে কতগুলো উল্কি যে করে দিয়েছিলেন বান্দ্রার উঠতি উল্কিশিল্পী আল আলভা, তার ইয়ত্তা নেই। চরিত্র কেমন, তা বোঝার পর আলভা নাকি মোট ১৬ জন এক্সট্রাকে দিয়ে হাত-মকশো করেছিলেন। তবে বায়োস্কোপের উল্কি বলতে গড়পড়তা বাঙালির প্রথমেই মনে পড়ে কাশীর ঘাটে মছলিবাবাজির হাতের বেমানান উল্কির কথা। ফেলুদার ভাষায় ‘ভেরি ফিশি’।

রোমিয়ো কেষ্ট এবং জুলিয়েট রাধাবর্গ এক কালে নিজের হাত ছুরি-ব্লেড দিয়ে কেটে-ফুঁড়ে সুইটহার্টের নাম খোদাই করে ফেলতেন। পরিস্থিতি (মানে প্রিয়পাত্র) বদলালে, চামড়া থেকে দাগ তুলতে টেটভ্যাক ইঞ্জেকশন নিতে হত। তবুও উল্কির জন্ম হয়। আত্মপীড়নের এই আনন্দের একটা জৈব আকর্ষণ বহু উল্কিবিলাসীই কবুল করেছেন। মহেন্দ্রনাথের লেখাতে এই মধুর বেদনার একেবারে কেজো দিকটা আছে: ‘ধামার চারদিকে আমরা ছোট ছেলেমেয়ে ঘিরিয়া বসিতাম। যার দুর্ভাগ্য সে প্রথমে উলকি পরিত। গোটাকতক ছুঁচ হাতে করে ছোট মেয়েটির কপালে বা হাতে বিঁধিতে লাগিল। আর ছোট মেয়েটি পরিত্রাহী চিৎকার করিত। তারপর ভেলা না কি মাখিয়ে দিয়ে তাতে চিরকালের কাল দাগ করে দিত। আমরা এই দেখে ছুট মেরে দৌড়ে একেবারে উপরে।’

যে সব আরণ্যক সভ্য মানুষেরা উল্কি আঁকা উদ্ভাবন করেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করতেন এর অমোঘ জাদুশক্তিতে। আমাদের পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ড ছত্তীসগঢ়ের বিভিন্ন আদিবাসী ভূমিপুত্র ভূমিকন্যারা নিজেদের গোষ্ঠীপতির নির্দেশ মেনে উল্কি পরতেন, নিজেদের একটা বিশেষ আইডেন্টিটি তৈরির বাসনায়। মৃত্যুর পর প্রেতলোকে ওই উল্কি দেখেই আদি পিতামাতারা চিনে নেবেন নিজ নিজ পরিবারের সদস্যকে। কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা লেখক রে ব্র্যাডবেরি-র ‘ইলাস্ট্রেটেড ম্যান’ নামে একটি সংকলনের গল্পগুলির মূল যোগসূত্র এক জনের গায়ের উল্কি। তাও আবার সে উল্কির কারিগর এক ভিনগ্রহী মেয়ে।

পোল্যান্ডের আউশউইৎজে ইহুদি বন্দিদের গায়ের উল্কিতে দেগে রাখা হত তাদের নিয়তি। কয়েক বছর আগেই পঞ্জাবে একটি গোষ্ঠীর মেয়েদের কপালে ভিত্তিহীন সন্দেহবশত পুলিশ দেগে দিয়েছিল চোর বদনাম। ‘দিওয়ার’ ছবির রাগী যুবকের রাগটা বজায় থাকত ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’ অপবাদটা নিজের চামড়ায় বার বার দেখে দেখে। আবার, মধ্যপ্রদেশের বৈগা গোষ্ঠীর আদিবাসী মেয়েরা উল্কি আঁকার আদিম দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক স্বাবলম্বনের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তাঁদের ভাষায় উল্কির নাম ‘গোদনা’। এখন সেই নকশা দিয়ে ওই নামের একটি চিত্রাঙ্কন-ঘরানা গড়ে উঠেছে। বৈগা গোষ্ঠীর বয়স্ক মেয়েরা অবশ্য এই অভ্যাসকে একটু সন্দেহের চোখে দেখেন। তাঁরা মনে করেন, এ কাজে তাদের দেবতা রুষ্ট হতে পারেন। মধ্যবিত্ত বাঙালি নির্ঘাত একমত হবেন। ছেলেমেয়ের গায়ে নয়া নয়া উল্কি দেখে তাঁদের কপালে নিরন্তর ভাঁজ। তবে বিরাট কোহলির-টা দেখে কিছু বলার ধক তাঁদেরও নেই!

barun.chattopadhyay@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tattoo Barun Chattopadhyay Rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE