Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘পুজোর সময় বাবাকে লুকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখেছিলাম উত্তম-সুচিত্রার ছবি’

কিশোরবেলার রোম্যান্টিকতার শুরু— এই পথ যদি না শেষ হয়! তখন তো জানতাম না, সেই ছবির সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমার পুজোর গান শুনে প্রশংসা করবেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পাশাপাশি গায়িকা হিসেবে আমারও ছবি বেরোবে! হৈমন্তী শুক্লকিছু গান আছে, যার গায়ে ঠিক যেন পুজোর গন্ধ মাখা। শুনলে মনে হয়, এই তো পুজো এসে গেল। তখন আমরা ছোট। পুজোয় কার কী গান বেরোচ্ছে, সেই জল্পনায় মশগুল থাকতাম।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৮
Share: Save:

কিছু গান আছে, যার গায়ে ঠিক যেন পুজোর গন্ধ মাখা। শুনলে মনে হয়, এই তো পুজো এসে গেল। তখন আমরা ছোট। পুজোয় কার কী গান বেরোচ্ছে, সেই জল্পনায় মশগুল থাকতাম। কী গান বার করবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মান্নাদা-র গাওয়া ‘একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে’, সন্ধ্যাদির ‘মধুমালতী ডাকে আয়’— এই সব গান আমার কাছে এখনও পুজোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।

আমরা তখন অল্প-অল্প গাইতে শুরু করেছি। রেডিয়োয় নতুন কোনও গান শুনলেই রেডিয়োর পাশে বসে খাতা-কলমে লিখে নিতাম। অনেক সময় আবার এক দিনে সবটা লিখে উঠতে পারতাম না। তখন থেকেই মনের কোণে ইচ্ছেগুলো দানা বাঁধছিল, ওই রকম একখানা গোল কালো রেকর্ড বাজবে রেকর্ড প্লেয়ারে, আর সেখান থেকে ভেসে আসবে আমার গলা।

ছোট থেকেই বাবার কাছে ক্লাসিক্যাল গানের তালিম নিতাম। আমার সব ভাইবোনই গান ভালবাসত। কিন্তু গানের প্রতি আমার ভালবাসাটা কিছু অন্য রকম। গান ছাড়া সব কিছুই আমার কাছে পানসে। সব কিছুই তখন গানকে ঘিরে ঘুরপাক খেত। যখন খেলতাম, তখন গান-গান খেলা করতাম। ভাবতাম কোনও একটা ফাংশনে গিয়েছি। সেখানে মাইক ধরে চিৎকার করে আমি গান গাইছি। কাগজ পাকিয়ে মাইক বানাতাম। তখন যে গান শুনতাম, সেই গানই গাওয়ার চেষ্টা করতাম। তার পর এক-একটা সিনেমাতে কোরাস গাইবার সুযোগ এল। তখন আবার মনে ভাবতাম, ওই মেন মাইক্রোফোনটার সামনে আমি একা কবে গান গাইব?

গান নিয়ে এই রকম নানা স্বপ্ন দেখার মধ্যে পুজোর গান একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। ১৯৭০ সালে আমার গলায় রেকর্ড হল বাচ্চাদের ছড়ার গান। শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে। তার পর ১৯৭২ সালে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আর শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে আর একটা গান রেকর্ড হল— ‘এ তো কান্না নয় আমার’। পুজোর গান। মানে, পুজোর ঠিক আগে রেকর্ডটা বেরিয়েছিল। তার পর থেকেই নিয়মিত পুজোর সময় আমার গানের রেকর্ড বেরোতে শুরু করল। কেমন যেন একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। মনে হত, পুজোর সময় নতুন জামা, নতুন জুতো না-ই বা হল, কিন্তু নতুন গান গাইতেই হবে। জুন-জুলাই মাস থেকেই শুরু হত প্রস্তুতি। কার সুরে গাইব, কোন গানটা গাইব তার বাছাবাছি চলত পরের কয়েক মাস ধরে।

মহালয়ার পরে শনি-রবিবার বসত অনুরোধের আসর। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকতাম। অনুরোধের আসরে শেষ গানটা ছিল একটা চমক। আন্দাজে ঢিল ছুড়তাম আমরা। আজ শেষ গানটা কার বাজাবে, প্রতিমাদি, হেমন্তদা, সন্ধ্যাদি... কার? এক সময় এই আগ্রহটা বদলে গেল, তখন ভাবতাম, কখন আমার গানটা বাজানো হবে। প্রথম বার যখন পুজোর সময় রেকর্ড হল আমার গলা, তার পর কী ছটফটানি! এক দিন শৈলেন মুখোপাধ্যায় ফোন করে বললেন, সামনের সপ্তাহে তোমার গানটা বেরোবে। তখন ভয়-ভয় করতে লাগল। গেয়ে তো ফেলেছি। এ বার শ্রোতারা পছন্দ করবেন তো? যেন পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোনোর টেনশন। তবে, বয়স তো তখন অল্প, তাই ফলের আশাটাও কম ছিল। গান যে বেরোচ্ছে সেটাই যথেষ্ট। সেই আশ্চর্য অনুভূতিটুকুই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম।

পুজোর সময় কার সুরে কে গাইছেন, সেটা নিয়েও কত উৎসাহ! এ বছর পুজোয় সলিলদা কার গান করলেন, হেমন্তদার কোন গানটা বেরোচ্ছে। হেমন্তদা আমাকে মেয়ের মতো দেখতেন। পুজোর গান বেরো‌নোর আগে থেকেই তাই জেনে নিতে চাইতাম, হেমন্তদা আপনার কী গান বেরোবে এ বার? হেমন্তদা শান্ত প্রকৃতির মানুষ। আমাদের মতো অত উত্তেজনায় টগবগিয়ে ফুটতেন না। বলতেন, ও-ই তো বেরোবে একটা। তবে, আমার প্রথম পুজোর গানটা শুনে বলেছিলেন, তোর গানটা হিট হবে। এখন এই পুজোর গান হিট হওয়ার ব্যাপারটাই তো আর আগের মতো নেই।

এক বার পুজোর আগে রিলিজ় করল ‘সপ্তপদী’। উত্তম-সুচিত্রার ভাল ভাল সিনেমা সব পুজোর আগেই বেরোত। তখন পুজোয় ‘থিম’ ছিল না, কিন্তু ‘পুজোর ছবি’ ছিল। উত্তমকুমার আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় নিয়ম করে পুজোয় রুপোলি পর্দায় ধরা দিতেন। কোনও বছর ইনি ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র বেশে, কোনও বছর উনি ‘সোনার কেল্লা’-য় ফেলুদার বেশে। আর ছবির সঙ্গেই পাল্লা দিত গান। আমার তো ছবির গান নিয়ে খুব উৎসাহ! ছবির গান বছরের দুটো সময় বেরোত, পয়লা বৈশাখ আর পুজো। পয়লা বৈশাখে মহরত হত ছবির। ছবির গান দিয়ে মহরত শুরু হত। যাই হোক, সপ্তপদী-র সময় আমি স্কুলে পড়ি। এক সপ্তমীর দুপুরে বন্ধুরা মিলে দেখতে গেলাম বাবাকে লুকিয়ে। দেখে এসে প্রথমে চুপিচুপি মা’কে বললাম। মায়ের মুখে জানতে পেরে বাবা বকুনি দিলেন খানিকটা। তবে, তার পরই বললেন, ‘নতুন কিছু গান শুনলি কি না সেইটা আগে বল।’ বাবা এই রকমই ছিলেন। সিনেমার চেয়েও নতুন গানে বেশি উৎসাহ ছিল তাঁর। তা, সপ্তপদীর ‘নতুন গান’ কেমন হিট হয়েছিল, সে তো ইতিহাস। উত্তমকুমারের মোটরবাইকে সুচিত্রা, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’... তখন আমাদের কৈশোরের শুরু। পুজোর সঙ্গে রোম্যান্টিকতার মাখামাখিটা বুঝে নেওয়ারও শুরু।

তারও আগে দেখেছিলাম ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’। সে ছবির গানগুলোও ছিল অপূর্ব। শুধু সেই গান শোনার লোভেই প্রচুর বকুনি খেয়েও ছবিটা আমি তিন বার দেখেছিলাম। গানের কথাগুলো পারলে ওই অন্ধকার হলে বসেই দু-এক লাইন লিখে ফেলি আর কী! একটা গানের কথা মনে পড়ছে, ‘ও বাঁশি হায়’। সলিলদার সুরে, লতা মঙ্গেশকরের গান। সে গান শোনার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। যত ক্ষণ না অবিকল গাইতে পারছি স্বস্তি নেই মনে। সমানেই রেডিয়ো শুনছি, যদি একটুখানিও শোনা যায় আর একটি বার। সঙ্গে উঠতে-বসতে প্র্যাকটিস, ভুলভ্রান্তিগুলো শুধরে নিতে।

এখন বড় কষ্ট হয়। শিল্পীর সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু পুজোর গান শোনার সেই উন্মাদনা আর শ্রোতাদের মধ্যে দেখি না। আমরা যখন গান রেকর্ড করতাম, তার একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকত। অনেক দিনের প্রস্তুতি। এখন প্রযুক্তির সামনে অনেক কিছুই সহজ হয়ে গিয়েছে। আমাদের সময় তো প্রযুক্তির সাহায্য তেমন পাইনি। একবারে একটা গান ঠিক করে গাইতে হত। কোনও ভুল হল তো সমস্ত মিউজ়িশিয়ানরা বসে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। এখন এই জটিল ব্যাপারটা আর নেই। আমার প্রথম গান রেকর্ড হয়েছিল একটা মাইক্রোফোনে। আমি গাইছি, আমার ঘাড়ের কাছে রাধাকান্ত নন্দীর তবলা, একটা টুলের ওপর নিয়ে বাজাচ্ছেন আর এই দিকে খোকন মুখোপাধ্যায় এবং ওয়াই এস মুলকি। তার পর আস্তে আস্তে এইচএমভি-তে অনেক বড় স্টুডিয়োতে গিয়ে গান করলাম। তখন সমস্ত মিউজ়িশিয়ানদের নিয়ে আগে রিহার্সাল করে নেওয়া হত। আমি ১৯৮৬-৮৭’তে যখন পণ্ডিত রবিশংকরের সুরে বাংলা গান গাইছি, তখন সাত দিন এইচএমভি-র রিহার্সাল রুমে রিহার্সাল হয়েছিল। কে কতটুকু বাজাবে, সমস্ত আগে থেকে রেডি করে ফ্লোরে যাওয়া হয়েছিল। সেও তো একটা পুজোর সময়েরই কথা। পুজোর গানেই বোধহয় বেরিয়েছিল আমার গাওয়া ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’ বা ‘আমার বলার কিছু ছিল না/ চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...’

তখন এইচএমভি থেকে ‘শারদ অর্ঘ্য’ বলে একটা বইও বেরোত। তাতে প্রত্যেক শিল্পীর ছবি বেরোত আর তাঁর গাওয়া গানটা পুরো লেখা থাকত। তখন তো টেলিভিশনের এত চল ছিল না। শুধু আর্টিস্টদের ছবি দেখার জন্য অনেকে এই বইটা কিনতেন। আমিও অপেক্ষা করে থাকতাম বইটার জন্য। বইটা ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় কত বার ভেবেছি, এই বইয়ে আমার ছবি কবে আসবে? যখন সত্যিই সেই ছবি ছাপা হল, ভাবলাম, আরে, আমিও কি আর্টিস্ট হয়ে গেলাম না কি?

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছবির পাশে আমার ছবি... ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।

অনুলিখন: পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Haimanti Sukla Song
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE