Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
জা স্ট যা চ্ছি

কিছুটা কু কিছুটা ঝিকঝিক

মা ঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছিলাম দু’বার, মেঘ ডাকছিল। জানলার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তার পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বুঝতেই পারিনি বৃষ্টি চলছে নিঃশব্দে। অ্যালার্ম বেজে উঠতেই চোখ খুলে গেল। মনে পড়ল, আজ তো যাওয়া। পড়ি কি মরি করে রাস্তায় পৌঁছে দেখি আকাশ ভিজে ভূত-কালো। বাড়ির বারান্দার নীচে তখনও শুকনো ফুটপাতের কিছুটা জায়গায় লোক ঘুমোচ্ছে মশারি টাঙিয়ে।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

মা ঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছিলাম দু’বার, মেঘ ডাকছিল। জানলার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তার পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বুঝতেই পারিনি বৃষ্টি চলছে নিঃশব্দে। অ্যালার্ম বেজে উঠতেই চোখ খুলে গেল। মনে পড়ল, আজ তো যাওয়া। পড়ি কি মরি করে রাস্তায় পৌঁছে দেখি আকাশ ভিজে ভূত-কালো। বাড়ির বারান্দার নীচে তখনও শুকনো ফুটপাতের কিছুটা জায়গায় লোক ঘুমোচ্ছে মশারি টাঙিয়ে। কুকুরও ঢুকেছে। বৃষ্টি ঠাহর করে হেডলাইট জ্বালিয়ে ট্যাক্সি আসছিল আস্তে আস্তে। উঠেই বললাম, ‘হাওড়া, জলদি।’ জানলার বাইরে আধমরা শহর। শুধু মিটারের লাল ডিজিটগুলো জেগে। স্টেশনে পৌঁছে দেখি থইথই লোক। পরপর লম্বা লাইন টিকিট কাউন্টারে। ন্যাকা সেজে কেউ কেউ ঢুকে পড়ছে লাইনে, মুহূর্তের মধ্যে ভোরে ফোটা টাটকা গালাগালি উপচে পড়ছে চার পাশ থেকে। কাউন্টারের কাছে, অনেক মাথার আড়ালে আরও বিস্ফোরণ। লাইন এগোচ্ছে না। বেরিয়ে এলাম। পরের লোক খুশি হল।
টিকিট ছাড়া ট্রেনে চড়িনি কখনও, একটু টেনশন শুরু হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে পাশ ফিরল সরীসৃপ। ছ’টা পাঁচে ছেড়ে যাবে ট্রেন, ধরতেই হবে, অল্পই সময়। ক্লান্ত কোন ট্রেন এক ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে, দৌড়ে গেলাম। লোক নামার আগেই কুলিদের মতো এসির দরজা ধরে নিলাম। মুহূর্তে ভেতরে এবং ডাইনে ঘুরেই টয়লেটে। ফাঁকা। উফ। এর কিছু পরেই ফুরফুরে মেজাজে ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্মে। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে আমার ট্রেন। আদরের নাম গনো। এসি কম্পার্টমেন্ট যেন অ্যাকোয়ারিয়াম। ভেতরে নিশ্চিন্ত অ্যাঞ্জেল আর অ্যাঞ্জেলিনারা। সবার টিকিট আছে। ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি। আমার আনরিজার্ভড কামরাতে ওঠার অধিকারও নেই। যেতে পারি না, তবু যাব। জানলার খাঁচার মধ্যে তিন স্তরে মানুষ সেট ও রিসেট হচ্ছে। এত লোক যে আলো জ্বললেও অন্ধকার। দরজায় অত ভিড় নেই। কারণ সবাই প্ল্যাটফর্মে, শেষ মুহূর্তে উঠে খোলা দরজায় হাওয়া খাবে। বোকারা আগে ঢুকে দমবন্ধ হয়ে হাঁপাবে। আমিও সেয়ানা। পাশের স্টল থেকে চা নিলাম।
ছাড়ল গণদেবতা, দরজার ফুটবোর্ড আর চলন্ত প্ল্যাটফর্মে চটি জুতোর লাথালাথি। ঢুকিয়ে দিলাম নিজেকে। সিজন্‌ড ওস্তাদরা ঠেলে আমাকে প্যাক করে দিল যথাস্থানে। ঝাঁক করে চেনা গন্ধটা এল। যাক, ট্রেন মিস হয়নি। একটাই মুশকিল। দলা পাকানো জ্যান্ত লোক, বাংক থেকে ঝোলানো ময়লা পা পেরিয়ে আমাকে ঢুকতে হবে ভেতরে। সেখানে চেকার পৌঁছতে পারবে না এ রকম ধারণা নিয়ে। কিন্তু, সম্ভব নয়। তাই চার পাশের শরীরের চাপে সিধে হয়ে দুলতে লাগলাম চলতে শুরু করা ট্রেনের রিদ্‌মের সঙ্গে। হাঁটুতে শক্ত, খোঁচামত কী লাগছিল, দেখতে পাচ্ছিলাম না। কার, কী: বোঝাও যাচ্ছিল না। ওই অবস্থাতেও আন্দাজে লাথি চালালাম সাইড ড্রিব্‌ল স্টাইলে, কারা যেন কী সব বলল। কিন্তু খোঁচা লাগা থেমে গেল। ভিড়ের ওপর দিয়ে দেখলাম বাইরে আকাশে আলো ফুটছে। মেঘের জলছাপে সরে যাচ্ছে ইলেকট্রিক পোস্ট। সাবধানে ডটপেন দিয়ে টানা লাইনের মতো পরপর তার। পাখি নেই কোনও। আগেই উড়িয়ে দিয়েছে সামনের ইঞ্জিনের হর্ন।

কারশেড পেরোয়নি, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। কাউকে সাবধান করা হচ্ছে সমবেত কণ্ঠে: নামবেন না, নামবেন না। উৎসাহ পেলাম, দেখা দরকার কী হচ্ছে দরজায়, কে নামতে চাইছে এখনই, কেনই বা। খেয়াল হল, একটা বুড়ো লোক বসে মাটিতে, এত ভিড়ের মধ্যেও, তলানির মতো। কোলে হাঁড়ি। সেই হাঁড়ি ও বুড়োর মাথার ওপর দিয়ে টপকে গেলাম অবলীলায়, এই নড়াচড়ায় অনেকেরই অসুবিধে হল নিশ্চয়ই। কিন্তু মূল ঘটনায় মন থাকায় গুরুত্ব দিল না। এ বার দেখতে পেলাম ঠিক কী হচ্ছে। নেমে পড়তে উদ্যত লোকটা, দিশেহারা চেহারা, প্রায় ঝুলছে সিঁড়িতে, উঠে আসতে পারছে না। কারণ লোকজন তার হাত ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। পাশের পোস্ট পেরনোর সময় তাকে একটু টেনেও নেওয়া হচ্ছে। টেনশনে আছে সে। তার বউ ট্রেনে উঠতে পারেনি, রয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মে। ‘বার বার বললাম জল খেয়ো না, চা খেয়ো না, বিস্কুট খেয়ো না, যা বারণ করব তাই করবে, খেয়ে তবে উঠবে, তা পারল উঠতে?’ পাবলিক মজা পেয়ে গেছে। ‘বউদিকে রাতে ভাল করে বিস্কুট জল খাইয়ে আনলেন না, সাতসকালে সাধ তো হতেই পারে।’ বউকে না নিয়ে নিজে কেন উঠেছে, চলন্ত ট্রেন থেকে কেনই বা বিস্কুটখোর বউয়ের কাছে ফিরে যেতে চাইছে, জানা গেল না। শোনা গেল হারিয়ে ফেলে বলে মোবাইলটাও বউয়ের কাছে আছে। তো, ফোন করলেই হয়: যেখানে আছো, থাকো, আসছি। মোড়লি করে বললাম, ‘বউদির নম্বরটা দিন, না না, আপনারটা, বউদিকে ধরে দিচ্ছি।’ ঝুলন্ত উত্তর এল, ‘লাভ নাই, অচেনা লোকের নম্বর দেখলে ধরবেই না, খালি আমারটা ধরে।’ ভিড়ের মধ্যে প্রবল হাসির হর্‌রা, কে বলল, ‘ঝুলেই যখন গেছেন, বলেই ফেলুন।’ ‘তার মানে ওনারও মোবাইল আছে, বলুন বউদির নম্বরই বলুন, আমি ধরে দিচ্ছি।’ আবার কথা টপকে এল, ‘চৌত্রিশ, চব্বিশ, আটতিরিশ।’

আমার সরে আসা জায়গায় অন্য লোক সেট হয়ে গেছে,তার আপত্তি আছে পায়ের কাছে হাঁড়ি কোলে বুড়োকে নিয়ে। তাকে দাঁড়াতে বলা হলেও, না শোনার ভান করে বসেই আছে। ফলে, ভেতরের আরও বেশি চাপে থাকা লোকজনের মেজাজ আরও বিগড়ে গেছে। ‘মাটিতে রস নামিয়ে দাঁড়াও না দাদু’: এ সবও শুরু হয়ে গেছে, অন্য এপিসোড, আলাদা মেজাজ তার। বেশ জোরে চলছে ট্রেন, তাই বাইরের লোকটাকে অনেকটাই ভেতরে টেনে এনেছে। বউয়ের মোবাইল নম্বর বলেছে, আমি ফোনও করলাম, বেজে গেল, ধরল না। লোকটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, ‘খতরনাক মেয়ে, নিজের বাপের বাড়ির টিরেন চেনে, উঠে চলে যাবে।’ ওর নম্বর জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘মনে নেই, বউ জানে।’ কড়া গালাগাল করতেই অবশ্য বলল নিজেরটা। লাগালাম ফোন। বাজছে। ধরল। প্ল্যাটফর্মের আওয়াজ, এখনও স্টেশনেই আছে। তার পরেই ‘হ্যালঅ, উনি নেই বাড়িতে, পরে করবেন।’ কেটে গেল। মহা মুশকিল। বললাম, ‘শুনুন আবার করছি, নিন ফোনটা, ধরলেই কথা বলবেন, তবেই উনি বুঝবেন যে আপনি।’ ঝুলন্ত লোকটা বলল, ‘পেত্থমে গোল গোল দিবেন।’ ফালতু কথা, মাথা দিয়ে লাভ নেই, রিডায়াল হয়ে গেছে, ধরিয়ে দিলাম।

ভেতরে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে, বুড়ো সম্ভবত উঠে দাঁড়িয়েছে, হিন্দিতে মেজাজ দেখাচ্ছে। আমার পায়ের কাছটা চটচটে, হাঁড়িটা কি ভেঙেছে? সেটা দেখার আগেই সদ্য পত্নী-বিচ্ছিন্ন লোকটার চিৎকার, ‘কে তোমাকে বিস্কুট খেতে বলেছিল? আমি বলেছিলাম?’ ‘আরে, এই ঘাউড়াকে নিয়ে তো মহা ঝাড়, এক্ষুনি নামিয়ে দে, দে ফেলে।’ মুহূর্তের মধ্যে জনরোষ তৈরি, ট্রেনের স্পিড কমছে, সম্ভবত শ্যাওড়াফুলি আসছে, থামবে বোধহয়, নেমে ফিরতি ট্রেন ধরলেই চলবে। কিন্তু বলতে তো হবে, ‘থাকো, আসছি আমি।’ কোথায় কী! সেই এক কথা, চা-বিস্কুট-জলের কাজিয়ার একটা পিঠ শোনা যাচ্ছে, গলা চড়ছে। সম্ভবত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বউও ছেড়ে কথা বলছে না। এক জন বলেই ফেলল, ‘দাদা-বউদি ফুল হট, কেউ কাউকে ছাড়ছে না। দাদার একটা ঝুলন্ত সেল্‌ফি হয়ে যাক।’ ভেতরে দাদুর হাঁড়ি, হাফ-বাইরে দাদার বিস্কুট নিয়ে সবাই চেঁচাচ্ছে, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। শুধু ‘শ্যাওড়ায় নেমে সোজা হাওড়া চলে যা’ শোনা গেল। ট্রেন আস্তে আস্তে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে, প্রচুর লোক। উঠবে নিশ্চয়ই, ভেতরে তাই সবাই যোদ্ধা। দরজা জ্যাম। ট্রেন থামতেই বাইরে থেকে সুনামির মতো লোক আছড়ে পড়ল। তারই মধ্যে বোধহয় গলে, নেমে গেছে লোকটা। আমার মুখে একটা নিশ্চিন্তি ভাব ফুটে উঠেই আবার মোচড় পড়ল তলপেটে। আমার মোবাইলটাও এখন ফিরে যাচ্ছে হাওড়ার দিকে।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhomoy mitra travel rail station train
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE