Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বহু অভিনেতাই বাংলা ভাষা নিয়ে উদাসীন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলা ভাষার আশ্রয়েই তাঁদের অভিনয়, অথচ বাংলা শব্দ, তার উচ্চারণ, বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁদের অজ্ঞতার সীমা নেই। অভিনয়কর্মীর কল্পনা, অনুভব, অভিজ্ঞতা, সবই দাঁড়িয়ে থাকে ভাষা ও সাহিত্যের ভিতে।বাংলা ভাষার আশ্রয়েই তাঁদের অভিনয়, অথচ বাংলা শব্দ, তার উচ্চারণ, বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁদের অজ্ঞতার সীমা নেই। অভিনয়কর্মীর কল্পনা, অনুভব, অভিজ্ঞতা, সবই দাঁড়িয়ে থাকে ভাষা ও সাহিত্যের ভিতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

মঞ্চমুহূর্ত: ‘রাজা লিয়ার’ নাটকের মহড়ায়। নীচে, ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নাটকে

মঞ্চমুহূর্ত: ‘রাজা লিয়ার’ নাটকের মহড়ায়। নীচে, ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ নাটকে

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:৫৭
Share: Save:

গত শতাব্দীর শেষ দিকে নব্বইয়ের দশকে আমি কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে আমার শেষতম প্রযোজনা ‘ন্যায়মূর্তি’ মঞ্চস্থ করি। এই নাটকটিতে বহু ছোটখাট চরিত্র ছিল, যেগুলির অভিনয় করার জন্যে বেশ কিছু অভিনেতাকে দিয়ে একাধিক চরিত্র করালেও অন্তত চল্লিশ জন ভূমিকা গ্রহণকারীর দরকার ছিল।

এই চরিত্রগুলিতে অভিনয়ের জন্যে কী ভাবে শিল্পী পাওয়া যায় তা নিয়ে প্রথমেই একটা সমস্যার সৃষ্টি হল। অত ছোটখাটো ভূমিকার জন্যে প্রতিষ্ঠিত ও অভিজ্ঞ অভিনেতা সচরাচর পাওয়া যায় না, কারণ তেমন অভিনেতাদের প্রত্যাশাই থাকে যে তাঁরা অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ রোলে নিযুক্ত থাকবেন। অতএব ওই রকম ছোট ছোট কাজ তাঁরা করতে চাইবেন না। যদি বা তাঁদের সম্মত করানো যায়, তাঁদের বেতনের হার এতটাই বেশি হবে যে চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে অত টাকা দিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতে কোনও প্রডিউসারই রাজি হবেন না, তা হলে অর্থনৈতিক দিক থেকে সেটা ব্যবসার লগ্নি লাভ ইত্যাদির হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

বাংলা থিয়েটারে জনতার মধ্যে সামাজিক নাটকে বিয়েবাড়ির ভিড়, কিংবা ঐতিহাসিক নাটকে সৈন্যদলের জন্যে এই রকম অপ্রধান ভূমিকার অভিনেতাদের মাঝে মাঝে দরকার পড়লেও, তাদের কখনও পঞ্চাশ-ষাট জনের মতো সংখ্যায় দরকার পড়ত না। আমি এখানে উৎপল দত্তের জনতার দৃশ্যের অসামান্য মঞ্চায়ন অথবা শিশিরকুমারের ‘দিগ্বিজয়ী’র মতো কোনও কোনও নাটকে বা শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’তে যেটুকু জনতার সমাবেশ দেখা গেছে, কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে তেমন উদাহরণ বেশ বিরল বলেই বাদ রাখছি। তা ছাড়া মনে রাখা ভাল যে পেশাদার রঙ্গালয়ে কিছু দিনের জন্য থিয়েটার করলেও উৎপল দত্তের অভিনেতৃবর্গের বেশির ভাগই ছিল তাঁর ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর সভ্য-সভ্যারা।

সাধারণ রঙ্গালয়ে দরকার পড়লে ক্রাউড সিন বা ভিড়ের দৃশ্যে যাঁদের ব্যবহার করা হত তাঁরা হলেন থিয়েটার পাড়ায় আসা-যাওয়া করা কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ যাঁরা ওই রকম ছোটখাটো ভূমিকায় দর্শকের সামনে সামান্য কিছু সময় দাঁড়াতে চাইতেন, এবং দর্শকের সামান্য নজরে পড়ার জন্যে খুশি থাকতেন। এ রকম অনেকেই ছোটখাটো সব আত্মপ্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে অপেক্ষাকৃত বড় রোলের অভিনেতা হয়ে উঠতেন ক্রমে ক্রমে। এ রকম ক্রাউড সিনের অভিনেতা থেকে বাংলা থিয়েটারের সবথেকে জনপ্রিয় অভিনেতা রূপে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়ার সবথেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমি ‘ন্যায়মূর্তি’ করার সময় এমনই সব উচ্চাশাপীড়িত মঞ্চমুগ্ধদের উপরে নির্ভর করব বলে স্থির করেছিলাম, এবং সেই রকম কর্মীদের নিয়েই প্রয়োগকর্ম সম্পন্নও করেছিলাম। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে একটা বিষয়ে আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলাম। বিষয়টা সমাজে কি প্রতিষ্ঠানে মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশার সময় আমার গোচরে এসে থাকলেও, থিয়েটার করার সময় তার ভয়াবহতা অনেক বেশি করে অনুভব করতে শুরু করি। আগেকার কালে ক্রাউড সিনের জন্যে যাঁদের পাওয়া যেত তাঁরা সব সময়ে উৎকৃষ্ট অভিনেতা না হলেও তাঁদের মুখের বাংলা ভাষাটা এখনকার কালের মতো অপকৃষ্ট ছিল না। বস্তুত বেশির ভাগ বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে এমন অপকৃষ্ট ছিল না। আমি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ওই চল্লিশ জন বাঙালিকে দিয়ে সুষ্ঠু বাংলা সংলাপ বলাতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলাম, এবং গভীর উদ্বেগের সঙ্গে অনুভব করি যে বাঙালি ভাল স্পষ্ট সুন্দর বাংলাই আর বলতে পারে না।

পথেঘাটে, বাসে-ট্রামে, জীবন চালনার নানা ক্ষেত্রে, যুবতীদের উচ্চারণের ততটা অবনমন না হলেও যুবকদের জিহ্বার মধ্যে যে মস্তান-সমুচিত আলস্য ও আড়ষ্টতা অনুপ্রবেশ করেছে তা আগে শ্রুতিপথে এলেও থিয়েটার করতে গিয়ে তা যেন আরও পরিষ্কার বুঝতে পারলাম।

পরিতাপের বিষয় হল, স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালির জীবনসংগ্রাম যত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছিল, তার বিপ্রতীপে মুখের কথ্য ভাষার প্রতি তার অমনোযোগ ততই যেন বৃদ্ধি পাচ্ছিল, বুঝিবা তা এই মানসিকতা-সঞ্জাত হয়ে যে, এই আপৎকালীন অবস্থায় ভাষা-টাষা নিয়ে ভাবাটা প্রাধান্য পাওয়ার দরকার নেই, ওটা অবহেলা করলেও তো ক্ষতি নেই।

থিয়েটার একটা জাতির পরিচয় বহন করে। থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংলাপ কথনের মধ্যে দিয়ে যে পরিচ্ছন্ন শোভন ভাষা প্রবাহিত হয়ে আসে, সাধারণ মানুষের কাছে তা-ই উপযুক্ত কথ্য ভাষা হিসেবে মান্যতা পায়। আমরা অল্প বয়স থেকেই শুনে আসছি, ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ঘোষক ও সংবাদপাঠকদের ইংরেজি উচ্চারণ সাধারণ মানুষের কাছে বাচিক দৃষ্টান্ত বলে মান্যতা পায়। ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার বা ওল্ড ভিক-এর মতো নাট্যদলগুলির সংলাপ পরিবেশনে উচ্চারণের যে অসাধারণ সৌকর্য প্রকাশ পায় তা-ই শিক্ষিত দর্শকসাধারণের কাছে চিন্তা চর্চা ও অনুসরণের প্রবাহপথ বলে পরিগণিত হয়। কলকাতা বেতার ও থিয়েটার প্রতিষ্ঠানগুলিও আমাদের বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেই পরিমার্জিত উচ্চারণবিধিকে অনেকটাই মান্যতা দিতে পেরেছিল। কেন তার পর তা আর অনুসরণযোগ্য রইল না তার ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যের বাইরে।

দেশভাগ এবং তজ্জনিত কারণে বিপুল সংখ্যক আগন্তুক ছিন্নবাস্তু মানুষের এ দেশে, বিশেষত কলকাতায় আগমন জীবনধারণের দাবিতে, ও সেই কারণে বাংলা ভাষার বেশ কিছু আঞ্চলিক কথনরীতি ও কলকাতা তথা ভাগীরথী তীরবর্তী শুদ্ধ বাক্‌রীতি বলে মান্যতাপ্রাপ্ত ভাষার সঙ্গে তাদের মাত্রাহীন মিশ্রণ, উচ্চারণবিধির দিশাহারা হওয়ার একটা বাহ্যিক কারণ বলে নির্দেশ করা যেতে পারে।

বস্তুত দাঙ্গা, দেশভাগ ইত্যাদির ফলে সে বড় ভয়ঙ্কর সময় কেটেছে দেশবাসীর। এমনকি উত্তর-স্বাধীনতা সময়ে জাতীয় চিত্ত ও চরিত্রের মধ্যে শান্ত ভাবে জীবনযাপনের অবস্থা বোধহয় আর কোনও দিনই ফিরে আসেনি। আমাদের দেশে দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কার যতই থাক না কেন, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রীতি শ্রদ্ধা আতিথেয়তা ইত্যাদির যে মানবিক মূল্যবোধ প্রবাহিত ছিল, তথাকথিত স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ যুদ্ধ ইত্যাদি, সেই সব শান্তিকালীন সাংস্কৃতিক স্থিতাবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। ভাগ হওয়া ভারতভূমির অন্য অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এই সাতটি দশকেও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়নি। পরন্তু তাদের সংঘর্ষ দু’দেশেরই শাসকদলের কাছে দেশব্যাপী দারিদ্র ও পী়ড়নের দিক থেকে দুই দেশের অধিবাসীর দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার, অশান্ত করে রাখার একটা মনোহর উপায় বলে আজও ব্যবহার হচ্ছে।

আর একটি দুঃখের কথা হল, লোকগান, লোকনাটক প্রভৃতি লোকায়ত সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে দিয়েও সাধারণ মানুষের কাছে লোকশিক্ষার যে স্রোত বয়ে আসত, যা এমনকি ইংরেজ শাসনের কালে, শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারের কালেও অবিচ্ছিন্ন ছিল, ইংরেজি শিক্ষিতদের অনুকরণস্পৃহাতেও যা দমিত বা বিভ্রান্ত হয়নি— দেশভাগ-পরবর্তী অস্থির সময়ে বিনোদন-পিপাসার্ত জনতা কিন্তু তা থেকে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। সেখানে বেশ দ্রুতই বিনোদনের শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে প্রায় অবিসংবাদিত ভাবে স্থানাধিকার করল সিনেমা তথা হিন্দি সিনেমার লঘু নাচগানের পসরা।

এই অস্থির সময়ের অগ্ন্যুৎপাতে কখন যে আমাদের ভাষা থেকে আমাদের ভালবাসা প্রত্যাহৃত হয়ে গেছে তা বোধকরি আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। আমার নাটকের বিভিন্ন প্রযোজনার সময় এই সত্যটা বারবার আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আমাদের কলেজে পড়ার সময়েও পঞ্চাশের দশকে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ সারা দিনের মুখর ব্যস্ততার মধ্যেও দ্বিপ্রহরে অবসরে রবীন্দ্র বঙ্কিম তারাশঙ্কর মানিক বিভূতিভূষণের উপন্যাস পড়তেন, এ তো স্বচক্ষে দেখেছি। মোদের গরব মোদের আশা বাংলা ভাষার প্রেমিক এখন কি ‘আ মরি’ বলে তার বন্দনা করেন? না কি সত্যি সত্যি ‘কী যাদু বাংলা গানে’ তার খোঁজে বাঙালি জীবনের শেকড়ের কাছে চলে আসেন? বাংলা ভাষা নিয়ে মনন চিন্তা ও গৌরববোধ পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের চিদাকাশ শূন্য করে বিদায় নিয়েছে। সে গৌরববোধ বরং বাংলাদেশের গরিষ্ঠ বাঙালির অহঙ্কারের মধ্যে এখনও দীপ্ত হয়ে আছে তিন দশকের পরেও। হয়তো তাঁদের মাতৃভাষাই তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের জয়ের আয়ুধ হয়ে আছে বলেই সে গৌরববোধ এখনও অনুজ্জ্বল হয়নি। তাঁদেরই সত্যিকারের বাঙালি বলতে ইচ্ছে করে যাঁরা উর্দু আধিপত্যবাদের পায়ে আত্মসমর্পণ করেননি। পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত বাঙালি কিন্তু কেবল রাষ্ট্রিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সংস্কৃতিতেও অকুণ্ঠ অনুকরণলিপ্সায় হিন্দি ও ইংরেজির আধিপত্যকে বরণ করে নিচ্ছে। আশ্চর্যের কথা হল, বহু পশ্চিমবঙ্গবাসী হিন্দুকে বাংলাদেশীদের ‘বাঙালি’ বলতে নারাজ দেখি। ‘ওরা তো বাঙালি নয়, মুসলমান’, এই ভাবে তাঁরা জাতিগত শ্রেণিভাগ করেন সাম্প্রদায়িক কৃপাণের অগ্রমুখে। আমাদের ছাত্রজীবনেও ভাষা নিয়ে এ পার-ও পার দু’দিকের বাঙালির যেটুকু গর্ব দেখতে পেতাম, তাকে ভালবাসারই অহঙ্কার ভাবতে আমার আপত্তি নেই— এখন তা আর পশ্চিমবঙ্গবাসীর মধ্যে দেখতে পাই না। এখন অহঙ্কার আছে, অহঙ্কারের উপযুক্ত হওয়ার তেজটুকু নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে।

এই একটি বিষয় যা নিয়ে অভিনেতা ও নির্দেশক হিসেবে আমাকে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিষয়ে জ্ঞান দূরস্থান, প্রাথমিক কৌতূহলও যে অভিনয়কর্মীর নেই, সে অভিনেতা হিসেবে কত দূর যেতে পারে? আমি তো পেরু কি প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও দ্বীপপুঞ্জের অভিনেতা নই, আমি বাঙালি অভিনেতা, বাংলা ভাষার আশ্রয়ে অভিনয় করি। সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা, শব্দ, তার ব্যবহারের বিশিষ্টতা বা আর একটু বিস্তারিত করে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গেও আমার পরিচয়টা আবশ্যিক।

আমি এমন সহ-অভিনেতার কথা জানি যার সঙ্গে আমি একটি ছবির শুটিং করছিলাম, প্রয়াত বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির প্রায় পাশেই একটি গৃহে। সেই সুযোগে আমি কবিপত্নী মীনাক্ষীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর আমার অভিনেতা সহকর্মী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে, সকলে খুঁজছিল?’’ আমি বললাম, ‘‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম।’’ ও প্রশ্ন করেছিল, ‘‘দেখা হল?’’ আমি আর এক বার বললাম, ‘‘আমি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম।’’ ও তখন বলল, ‘‘বাড়িতে ছিলেন? দেখা হল?’’ আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘‘ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে এখন তো বহু দূর যেতে হবে। ডাক না এলে সেখানে আর যাচ্ছি কী করে?’’

সকলকেই কবিতার পাঠক হতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা দাবি না করলেও আমাদের কালের সবথেকে বড় কবি, অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন মানুষের নামটির সঙ্গেও যদি পরিচয় না থাকে তা হলে সে অভিনেতার সংস্কৃতিমনস্কতার, এমনকি মাতৃভাষার প্রতি প্রীতির ভাঁড়ার যে শূন্য তা বুঝতে বাকি থাকে না। অভিনয়ের পেশায় নাম পেয়েছেন কিন্তু পেশার বাইরে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের ব্যাপারে উদাসীন অনাগ্রহী এমন মানুষ আছে, সেই কথাটি বোঝানোর জন্যেই এই পরিহাসতরল গল্পটির অবতারণা।

দুঃখের বিষয়টা হল, অভিনয় পেশায় এ রকম অজ্ঞানের সংখ্যা কম নয়।

অভিনয় প্রাথমিক ভাবে সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম হিসেবে দাবি করতে পারে কি না, এ নিয়ে জটিল তর্ক উঠলে তার কী মীমাংসা হবে বলতে পারি না। নাচ, গান বা ইন্দ্রজালের মতো অভিনয়কে একটি পারফর্মিং আর্ট হিসেবে গণ্য করতে আশা করি কারও খুব একটা আপত্তি হবে না। এই দেহপট-নির্ভর শিল্পটির উৎকৃষ্ট চূড়ান্ত বিকাশ কিন্তু নৃত্যের মতো মুদ্রা ও পদবিক্ষেপের সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণের ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। স্বরলিপি ও সুরবিন্যাসের যুগসঞ্চিত বিধির উপরেও অভিনয় নির্ভর করতে পারে না। সব শিল্প উদ্যমেরই যা লক্ষ্য তা হল জীবনের সত্যরূপকে ব্যক্ত করা। জীবনের সেই সত্যরূপ প্রকাশ, অভিনয় কলারও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। কিন্তু সেই লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার জন্যে অভিনেতার জীবনের অভিজ্ঞতার বিপুলতা, কল্পনার অভ্রান্ততা ও অনুভবের তীব্রতা বহুলাংশেই দাঁড়িয়ে থাকে ভাষা ও সাহিত্যের সজীবন আশ্রয়ে।

অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে যাঁরা পুরোদস্তুর এই পেশার উপযুক্ত করে নিজেদের গড়ে নেওয়ার কথা ভাবেন তাঁদের পেশার দাবিতে অনেক কিছুই শিখতে হয়। গাড়ি চালানো, অশ্বারোহণ, সাঁতার কাটা, ফেন্সিং ইত্যাদি নানাবিধ শারীরিক ক্রিয়ার জন্য তাঁদের সক্ষম হয়ে উঠতে হয়। এই সব শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়কর্মের দাবিতেই কিছু মানসিক প্রসারণের দিকেও অভিনেতা অগ্রসর হতে পারেন। অভিনেতাকে রূপসজ্জার সাহায্য নিতে হয়। মানুষের আকৃতিগত বিশেষত্ব অনুধাবন করতে হয়। এই ব্যাপারে তিনি যদি চিত্রকরের পর্যবেক্ষণ থেকে তার ধারণা গঠন করেন, পোশাক-আশাকের ঐতিহাসিক বিবর্তন তিনি যদি ধ্রুপদী বা আঞ্চলিক চিত্রকলার ভিতরে সন্ধান করেন তবে তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কল্পদৃষ্টিরও সম্প্রসারণ হতে পারে। বহু সময় ধরে কাজের দাবি থেকে এ সব শিক্ষা আয়ত্ত করার দাবি এসে উপস্থিত হয়। যদিও এ ক্ষেত্রেও দেখি অভিনেতাকুলের চিত্রকলা বা অন্যান্য কারুশিল্পের সঙ্গে সংস্রব এতই ক্ষীণ যে তা থেকে শিল্পবোধের উজ্জীবন সম্ভব বলেই মনে হয় না।

তবে শারীরিক পটুত্ব বা শিল্পকলার থেকে আহৃত ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের থেকেও অভিনেতার জীবনে আরও প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে তাঁর দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার অর্জন। দেশের ললিতকলা নৃত্য বা সঙ্গীতকলার বৈচিত্রের মধ্যেই তো শুধু সংস্কৃতির উত্তরাধিকার লুকিয়ে থাকে না, দেশের মানুষের জীবনধারায়, আহারে, বাসস্থান নির্মাণে, পোশাকে-পরিচ্ছদে, ক্রিয়াকর্মে, আচার-অনুষ্ঠানে, উৎসব-পার্বণে, জীবনধারণ ও জীবিকা সম্পাদনের বহুবিধ বৈচিত্রের মধ্যে স্বদেশীয়দের যে সংস্কৃতির স্রোত প্রবলভাবে উপস্থিত থাকে, তার তটের কাছে গিয়ে সব শিল্পকর্মীর মতো অভিনেতাকেও আঁজলা ভরে নিতে হয়।

এই জীবন অনুসন্ধানের আগ্রহ অভিনেতাকে মানবজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাছে নিয়ে যায়। সেখানে সুখ-দুঃখের প্রবল অভিঘাত তাঁকে জীবনকে চিনতে শেখায়। জীবনকে বোঝার পথে আর একটি সহায় তাঁকে ঋদ্ধ করে। মানুষের যে বিপুল জ্ঞানভান্ডার সংখ্যাহীন গ্রন্থের পাতায় পাতায় অক্ষরবন্দি হয়ে আছে, কৌতূহলী অভিনেতাকে তারও সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। গ্রন্থে সঞ্চিত ঋষিঋণ সব শিক্ষার্থীর মতোই অভিনয়কর্মীরও জীবনবেদের আকর হয়ে উঠতে পারে। জীবনসাধনার এই পথও তো ভাষা ও সাহিত্যের আলোতেই উজ্জ্বল হয়ে আছে।

১১ জুলাই ২০১৮-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত সপ্তম রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা (‘অভিনেতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতি’)

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Soumitra Chatterjee Bengali language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE