Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
লিন্ডা, ক্রিস্টি

মডেল যখন ‘সুপার’

উই ডোন্ট ওয়েক আপ ফর লেস দ্যান টেন থাউজ্যান্ড ডলার আ ডে’— ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসের ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনে কথাটা বলেছিলেন লিন্ডা ইভাঞ্জেলিস্তা। অনেকেই বলেন, এটাই মডেলিং দুনিয়ার সবথেকে বিখ্যাত কোটেশন। এই ‘উই’ শব্দটার এক জন তো তিনি, আর এক জন হলেন ক্রিস্টি টার্লিংটন।

নয়নিকা চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:৩৪
Share: Save:

উই ডোন্ট ওয়েক আপ ফর লেস দ্যান টেন থাউজ্যান্ড ডলার আ ডে’— ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসের ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনে কথাটা বলেছিলেন লিন্ডা ইভাঞ্জেলিস্তা। অনেকেই বলেন, এটাই মডেলিং দুনিয়ার সবথেকে বিখ্যাত কোটেশন। এই ‘উই’ শব্দটার এক জন তো তিনি, আর এক জন হলেন ক্রিস্টি টার্লিংটন।

আমেরিকার মেয়ে ক্রিস্টি তো একেবারে ডানাকাটা পরি। মাখন-ত্বক, ব্যাকরণ-মাফিক হাত-পা-চোখ-নাক-মুখের নির্মেদ সুঠাম নকশা, স্যাটিনের নদীর মতো চুল। ও দিকে কানাডার লিন্ডা বিদ্যুৎ। চোখ-ধাঁধানো রূপসি।

দুজনেই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন বেশ অল্প বয়সে। নিজের শহরে টুকটাক মডেলিং করে, লিন্ডা চলে আসেন নিউ ইয়র্ক সিটি। সেখানে তাবড় মডেলিং এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর, নাম ছড়ায়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মডেলিংয়ের মক্কা প্যারিস নগরীতে পৌঁছে যান তিনি। সব বড় বড় ফ্যাশন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আর ভেতরের পাতায় ঝলমল করতে থাকে তাঁর ছবি। বয়স তখন কুড়িও পেরয়নি বোধ হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে ডেকে পাঠালেন কিংবদন্তি ফ্যাশন ডিজাইনার জিয়ানি ভারসাচি স্বয়ং। অন্য দিকে হাই ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলও তাঁর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করল। লিন্ডার জীবনের সঙ্গে মডেলিং ইতিহাসেও শুরু হল একটা নতুন অধ্যায়।

আশির মাঝামাঝি পর্যন্ত মডেলদের নিয়ে ফ্যাশন শিল্পে একটা পরিষ্কার বিভাজন ছিল। এডিটোরিয়াল মডেলিং, আর রানওয়ে মডেলিং। প্রথম দল বন্ধ ঘরে আলো জ্বালিয়ে ক্যামেরার সামনে নানা রকম পোজ দিতেন, সে ছবি বের হত পত্র-পত্রিকায়। আর দ্বিতীয় দল ডিজাইনারদের জন্য র‌্যাম্পে ক্যাটওয়াক করতেন, অ্যাড-ভিডিয়ো শুট করতেন। এক দলের কাজ ইন্ডোরে, অন্যদের আউটডোরে। লিন্ডা প্রথম মডেল, যিনি এই সীমানাটা ভেঙে দিলেন। ম্যাগাজিন আর ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করতে লাগলেন এক সঙ্গে।

এই রকম সময়েই তাঁর তালে তাল মিলিয়ে উঠে এলেন ক্রিস্টি। সব প্রচ্ছদে আর ক্যাটওয়াকে এই দুই কন্যার দাপট চলছে। কে প্রথম কে দ্বিতীয় এই নিয়ে দুজনের মধ্যে একটু রেষারেষি থাকলেও, ভেতরে বেশ ভালবাসাও ছিল যেন। লিন্ডা তো তত দিনে সর্বকালের অন্যতম সেরা মডেল হওয়ার রাস্তায় ছুটছেন। একটার পর একটা ট্রেন্ড গড়ছেন। ১৯৮৮ সালে, একটা শুটে উইগ-টা কিছুতে মনোমত হচ্ছিল না। ব্যস, চুল কেটে ছোট করে ফেললেন। ফ্যাশন-ইন্ডাস্ট্রি তো শক্ড! এমন স্কুল-পালানো ছেলের মতো চুলে মডেলিং হয়! প্রায় ১৬টা ফ্যাশন শো থেকে বাদ পড়লেন লিন্ডা। তিনি কিন্তু অম্লানবদনে ওই চুল নিয়েই একটা সাদা শার্ট পরে ফোটোশুট করলেন। জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। এবং কী আশ্চর্য! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল নতুন ফ্যাশন হয়ে গেছে লিন্ডার ওই হেয়ারস্টাইল। মডেলরা তো বটেই, অভিনেত্রীরাও পরদায় দেখা দিচ্ছেন ওই ছোট্ট চুলে। তার নাম ‘লিন্ডা কাট’। লিন্ডার সঙ্গে কাজ করার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আকাশছোঁয়া দাম উঠল তাঁর। একটার পর একটা আইডিয়া বের করছেন পোশাক-শিল্পী বা শো পরিচালকরা, আর বলছেন, লিন্ডাকে চাই। এটা একমাত্র ও-ই করতে পারবে। অবস্থা এমনই যে, শুধু লিন্ডার জন্যই একটা আনকোরা শব্দ জন্ম নিল: ‘সুপারমডেল’।

আস্তে আস্তে এই নতুন গ্যালাক্সিতে ঢুকে এলেন ক্রিস্টি টার্লিংটন আর নেওমি ক্যাম্পবেল। লিন্ডা, ক্রিস্টি আর নেওমি-র প্রভাব তখন এতটাই, তাঁদের বলা হত প্যারিসের হাই ফ্যাশন দুনিয়ার ‘ট্রিনিটি’। মডেলিংয়ের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। কয়েক দিন বাদেই ট্রিনিটি পেলেন নতুন দুই জুড়িদার। সিন্ডি ক্রফোর্ড আর তাতিয়ানা পাতিৎজ। সাফল্যের মাঝগগনে পৌঁছে গেলেন এই ফেমাস ফাইভ।

পপুলার কালচারে ওঁদের প্রভাব তখন চিন্তাভাবনার বাইরে। সে সময়ের কোনও অভিনেত্রী, গায়িকা বা পপস্টারেরও এমন জৌলুস ছিল না। জর্জ মাইকেল তো একটা মিউজিক অ্যালবামই বানিয়ে ফেললেন ওঁদের নিয়ে। ‘ফ্রিডম’। পঞ্চকন্যা অসাধারণ পারফরমেন্স দিয়েছিলেন সেই ভিডিয়োয়। সেখানেই আমি প্রথম দেখি ওঁদের। বিশেষ করে আমার মনে বিঁধে গিয়েছিলেন ক্রিস্টি আর লিন্ডা। আত্মবিশ্বাস, সৌন্দর্য, বুনো মাদকতা আর রাজকীয় আভিজাত্য এক সঙ্গে যেন চুঁইয়ে পড়ছিল ওঁদের প্রকাশভঙ্গিতে! তার পর থেকেই আরও অ্যালবাম খুঁজতাম, শুটের ছবি পেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ম্যাগাজিন পেলে তো কথাই নেই। কত খবর থাকত! ফ্যাশন ডকুমেন্টারি ‘আনজিপ’ নাকি মাত করে দিয়েছেন ক্রিস্টি। ‘পেটা’র ক্যাম্পেনে ফারের পোশাক ব্যবহারের বিরুদ্ধে গলা তুলে সাহসী ছবি তুলেছেন। ও দিকে বার বার চোখে পড়ত লিন্ডার ছোট চুল আর সাদা শার্টের সেই আশ্চর্য ছবি। তত দিনে ইতিহাসে ঢুকে গেছে ছোট চুলে তোলা সেই ‘হোয়াইট শার্ট পিকচার’। প্যারিসের ফ্যাশন-পার্লারে হটকেকের মতো বিকোচ্ছে ‘ইভাঞ্জেলিস্তা উইগ’। লিন্ডা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন ইন্ডাস্ট্রিকে। চুলের রং পালটাতে লাগলেন। এক বার প্লাটিনাম ব্লন্ড, ক’মাস পরেই টেকনিকালার রেড। তাঁর সঙ্গে তুলনা হতে লাগল এলিজাবেথ টেলর আর সোফিয়া লোরেনের।

লিন্ডাকে খুব ভাল লাগলেও, একই সঙ্গে আমি ক্রিস্টিতেও বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলাম। ক্রিস্টির রূপ তো ছিল একেবারে স্বর্গে গড়া। নিখুঁত। এক সময় আমিও ঢুকে পড়লাম মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে। বেশি করে জানার সুযোগ পেলাম আমার আইকনদের কাজ ও জীবন সম্পর্কে।

অবশ্য, কাজের চেয়ে কেচ্ছার প্রতিই কাগজ ও পত্রিকাগুলোর নজর থাকত বেশি। সেটা এখনও থাকে, কিন্তু নব্বইয়ের প্রথম ভাগে অবস্থা ছিল আরও সঙ্গিন। মিডিয়ার একাংশ মডেলিং পেশাটাকে একেবারেই সম্মান দিত না। শুধু ভারতীয় মিডিয়ার কথা বলছি না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও একই পালকের পাখি। লিন্ডার বর্ণময় ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা রকম কুরুচিপূর্ণ পেজ-থ্রি নিউজ বের হত। অভিনেতা এডওয়ার্ড বার্নস-এর সঙ্গে ক্রিস্টির বিয়েটা টিকল না ভাঙল— তার মনগড়া গল্প থাকত। অথচ বয়সকে গোহারান হারিয়ে দুজনে আজও কী রকম চুটিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন— তা নিয়ে কেউ লেখেই না! মডেলিংয়ের পাশাপাশিই ক্রিস্টি কলম্বিয়ায় পাবলিক হেল্থ বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিট্যারিয়ান অর্গানাইজেশন ‘কেয়ার’-এর হয়ে রাশি রাশি কাজ করে চলেছেন। প্রসবের আগে ও পরে নতুন মায়েদের অপুষ্টি, রোগ-ব্যাধি আর মৃত্যু ঠেকাতে খেটে চলেছেন প্রতি দিন। আবার একটার পর একটা ডকুমেন্টারি ছবিও বানিয়েছেন। সফল পরিচালকের খেতাব জিতেছেন। গানের অ্যালবাম বানিয়েছেন। ম্যাডোনা, জেনিফার লোপেজ পর্যন্ত গান গেয়েছেন সেখানে। যোগাভ্যাস নিয়ে বই লিখেছেন। আর ক্রমাগত ক্যাম্পেন চালিয়ে যাচ্ছেন সিগারেট-তামাকের বদ-নেশার বিপক্ষে। শুধু রূপে না, গুণেও মেয়েটি সাক্ষাৎ দশভুজা। সুপারমডেলের চলতি ইমেজ ভাঙার ক্ষেত্রেও এঁরা তাই সুপারওম্যান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE