Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

উন্নত মানুষ হওয়ার সাধনাই অভিনেতার লক্ষ্য

অর্থ, কীর্তি বা সচ্ছলতা নয়। ভিতর থেকে সার্থকতার বোধ না এলে অভিনেতা ফুরিয়ে যান। কিন্তু চাইলে তিনিই এগিয়ে যেতে পারেন মানুষের কল্যাণচিন্তার দিকে। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। ভাষার এই বিশিষ্টতাই শেষ পর্যন্ত হোমো সেপিয়েন্সদের বৌদ্ধিক চর্চার অধিকারী করে তুলেছিল। বুদ্ধি ও বিবেচনার ক্ষেত্রে অগ্রণী হয়ে তারা যে ‘কগ্‌নিটিভ রেভোলিউশন’ সাধন করে তা-ই তাদের জগতের সর্বোত্তম প্রাণী হিসেবে উন্নীত করে। আজও ভাষাই মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধন।

অভিনয়মুহূর্ত: ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকের দৃশ্য

অভিনয়মুহূর্ত: ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকের দৃশ্য

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৮ ০০:১৪
Share: Save:

ভাষাই মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছে। এর অর্থ এই নয় যে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর ভাষা নেই। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ও ভাববিনিময় করার জন্যে প্রাণিজগতের প্রায় সমস্ত শাখাই কোনও না কোনও উপায়রূপে ভাষার ব্যবহার করে। এমনকি পতঙ্গরূপে জীবিত পিঁপড়ে কি মৌমাছিরাও জানে কী সূক্ষ্ম উপায়ে পরস্পরকে খাদ্যবস্তুর সন্ধান জানাতে হবে। কণ্ঠনির্গত ভাষা হিসেবেও মানবভাষাকে প্রাণলোকে প্রথম বলে গণ্য করা হয় না। হোমো সেপিয়েন্স বলে পরিচিত যে বানর প্রজাতির আধুনিক নররূপে বিবর্তন ঘটেছে, তাদের অভ্যুদয়কালেই আরও অন্তত ছ’টি শাখামৃগের প্রজাতি বিবর্তনের পথে এই ধরণিতলে খাদ্য সংগ্রহ ও জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত ছিল— এমন সত্য প্রাগৈতিহাসিক গবেষণার দ্বারা অর্জিত জ্ঞান হিসেবে এখন স্বীকৃত। অস্ট্রেলো পিথেকাস, হোমো ইরেকটাস, হোমো সোলোএনসিস কি নিয়েনডার্থালেনসিস প্রভৃতি বিবর্তিত বানর প্রজাতিকে কিন্তু আমাদের আদি পূর্বপুরুষ বলা যায় না। হোমো সেপিয়েন্সই মানবরূপে আমাদের আদি পূর্বপুরুষের প্রথম উদ্ভাস। অন্যান্য মানবরূপে বিবর্তিত প্রজাতিগুলির কারও কারও মস্তিষ্ক আমাদের পূর্বপুরুষের থেকেও বড় ছিল, এবং তাদের সকলেরই ব্যবহারের নিজস্ব আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ছিল। তবু হোমো সেপিয়েন্সরাই তাদের সকলকে পিছনে ফেলে যে এগিয়ে যায়, তার জন্যে দায়ী অদ্যাবধি অজানিত কোনও জেনেটিক মিউটেশন বা পরিবর্তন, এবং এই কারণে পরিবর্তিত তাদের ভাষার বিশিষ্ট শক্তি। এই পরিবর্তনের ফলে সেপিয়েন্সদের ভাষায় যে নমনীয়তা ও বিচিত্রগম্যতার শক্তি আসে, তার ফলে তারা বাস্তবকে বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার জগতেও ভ্রমণসক্ষম হয়ে ওঠে। ভাষার নব অর্জিত ক্ষমতার জোরেই ছোট গোষ্ঠীর সীমাবদ্ধ কর্মক্ষমতার বাইরে এসে তারা নিজেদের প্রসারিত করে। বৃহৎ সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠে হোমো সেপিয়েন্সরা। এই যূথবদ্ধতার জন্যে যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল তার ভিত্তিই ছিল ভাষা।

ভাষার এই বিশিষ্টতাই শেষ পর্যন্ত হোমো সেপিয়েন্সদের বৌদ্ধিক চর্চার অধিকারী করে তুলেছিল। বুদ্ধি ও বিবেচনার ক্ষেত্রে অগ্রণী হয়ে তারা যে ‘কগ্‌নিটিভ রেভোলিউশন’ সাধন করে তা-ই তাদের জগতের সর্বোত্তম প্রাণী হিসেবে উন্নীত করে। আজও ভাষাই মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধন। ভাষা না থাকলে মানুষের জীবন জন্মমৃত্যুর বন্ধনে বদ্ধ এক কারাগার মাত্র। যোগাযোগের এই সেতুটি না থাকলে মানবসভ্যতার এত বড় বিকাশ সম্ভবই হত না। যে বিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষের সভ্যতা বিশ্বজগৎকে জানার পথে এত দূর এগিয়েছে, সেই বিজ্ঞানের জন্যেও ভাষার সহায়তাও প্রয়োজন হয়েছে।

অভিনেতা যদি এত সব কথা ভাবার দরকার নাও মনে করেন তবু অন্তত যে ভাষার মাধ্যমে তিনি ভাবপ্রকাশ করেন তার চরিত্র, তার শক্তি এমনকি দুর্বলতার উৎস সন্ধান না করেন তা হলে অভিনয়কর্মের বহু দায়িত্বই তিনি পালন করতে পারবেন না, অভিনয়ের উৎকর্ষ সাধন তো অনেক দূরের কথা।

ভাষার এই চরিত্র সন্ধানে খামতি থাকার জন্যে বাঙালি অভিনেতার যে সব ভুল হয় তার মধ্যে থেকে ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত দিই। বাংলা ভাষার কথনরীতিতে অজস্র যুগ্মশব্দ তৈরি করে ব্যবহৃত হয়। পরস্পরের পিঠোপিঠি এই সব শব্দ-যুগল যেমন একত্রে সন্নিবিষ্ট, তেমনি একত্র করেই উচ্চারণ করলে তবেই তাদের সঠিক অর্থ প্রকাশ হয়। একটা সামান্য উদাহরণ দিই। একটি সংলাপে আছে ‘আজ তো প্রাণের সাধ মিটিয়ে খানাপিনা হবে’। এ ক্ষেত্রে উচ্চারণের সময় ‘সাধ’ আর ‘মিটিয়ে’ এই দুটো শব্দ একটি যুগ্মশব্দে পরিণত হয়ে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু অভিনেতা যদি ‘মিটিয়ে’ শব্দটাকে সামান্য আলাদা করে নিয়ে, ‘মিটিয়ে’ শব্দটার উপরে বেশি জোর দিয়ে সেটাকে আলাদা শব্দের ওজন দেন তা হলে ‘সাধ মিটিয়ে’ কথাটার ভাবপ্রকাশ ব্যাহত হয়। এখনকার কালের ছেলেমেয়েরা অভিনয় করার সময় এই রকম পিঠোপিঠি দুটি শব্দকে বিশিষ্ট করে আলাদা করে ফেলেন প্রায়শই। অথচ বাঙালি জনসাধারণের উচ্চারণরীতি খেয়াল করলে এই ভুল নিশ্চয়ই করতেন না।

বাঙালি গরিষ্ঠ মানুষের জনপ্রবাহের উচ্চারণরীতি সম্পর্কে অনেক অভিনেতাই ওয়াকিবহাল নন। সেই জন্যেই সভয়ে লক্ষ করি, তাঁরা বাংলা উচ্চারণরীতি থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন। আর জোলা মালো চাষি তাঁতি প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষের সংলাপ বলতে হলে তাঁদের অক্ষমতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে দূরত্বটা বোঝা যায়। প্রাকৃত বাংলা ঠাটে কথা বলার ছন্দ, সুর কিছুই এখনকার প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা অভিনেতাদের না জানা থাকায় তাঁদের সে অবস্থায় দেখলে মনে হয় নিঃসহায় হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

বাংলা সাহিত্য, ভাষা কি শব্দতত্ত্ব, বাংলা উচ্চারণ প্রভৃতির ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলে বাঙালি অভিনেতাকে হাতিয়ারহীন নিধিরাম সর্দার হয়েই থেকে যেতে হয়। এই অসহায়ের সহায় হতে পারে সাহিত্যের সংস্রব। বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত উঁচুদরের সার্থক সাহিত্যস্রষ্টার অভাব নেই। তাঁদের সাহিত্যকর্মের মধ্যে বাঙালির যে সব অসামান্য পরিচয় উজ্জ্বল হয়ে আছে, অভিনেতাকে সে সবের অনুধাবনের জন্য অনুরোধ করি। সাহিত্যকারদের লেখনীতে ভাষার যে জীবনসন্ধানী ব্যবহার অজস্র ধারায় মূর্ত হয়েছে, তার জ্ঞান অভিনেতাকে গভীরতর শিল্পবোধের মধ্যে নিশ্চিত, নিঃসঙ্কোচ করে তুলতে পারে। সেই জ্ঞান ও বোধের উৎকর্ষ দিয়ে তিনি সৃজনশীল সাহিত্যস্রষ্টার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেন।

আমার এই প্রতিবেদনটি শেষ করতে চাইছি এমন একটি সূত্র দিয়ে যাকে আসলে জিজ্ঞাসা বলাই ভাল হবে। এই জিজ্ঞাসা অভিনয়ের আঙ্গিকগত কোনও বিবেচনার কারণে উদ্ভূত নয়। এ জিজ্ঞাসা অভিনেতার আত্মিক অনুধাবন সংক্রান্ত।

অভিনেতা অভিনয় করেন কেন? দু’চার রাত্রির শখের বা আকস্মিক মঞ্চাবতরণ, অথবা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর শৌখিন উত্তেজনা-অভিলাষীদের কথা আমি বাদ দিচ্ছি। যাঁরা অভিনয়কর্মকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে এই অনিশ্চিত পেশার ক্ষুরধার পথে কোন কারুবাসনার দংশনে হেঁটে চলেন, আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমার নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে। দু’চার দিনের শখ সম্বল করে কি অভিনেতা বছরের পর বছর অভিনয় করে যেতে পারেন? কিসের তাগিদে তিনি এই পথে পা রাখেন? সে কি আত্মপ্রদর্শনের তাগিদে? না কি নিছক গ্ল্যামারের হাতছানিতে? অথবা মুদ্রারাক্ষসীর মোহিনী মায়াজালে পড়ে?

হ্যাঁ, অনেক মানুষেরই মতো অভিনেতাদেরও মনোজগতে এ সবের প্রতি আকর্ষণ থাকতেই পারে। কিন্তু এ রকম পেশায় অনিশ্চয়তার তপ্ত ঝোড়ো হাওয়ায় এ সব বাসনা বেশি দিন টেকে না, এ সব আকর্ষণ অভিনেতাকে কত দিন আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে? অভিনয়কর্মের ভিতর থেকেই যদি কোনও তৃপ্তি বা সার্থকতার বোধ অভিনেতার মনকে স্নিগ্ধ করে না রাখে তা হলে অভিনেতা অনন্যোপায় হয়ে পেশাতে যদি বা টিকে থাকেন চলমান শবের মতো, তাঁর মন কিন্তু জীবিত, সৃষ্টিশীল থাকে না। অভিনেতা তা হলে এক সময় ফুরিয়ে যান, তাঁর কাজ একঘেয়ে অনুবর্তনের গ্লানিতে পূর্ণ হয়ে যায়।

কোনও কোনও অভিনেতা এই সঙ্কট নিরসনের পথ পান দর্শকসাধারণকে বিনোদিত করতে পেরে এক ধরনের তৃপ্তির আস্বাদ পেয়ে। দর্শককে এই বিনোদিত করার ইচ্ছেটাকে এক প্রকার শুদ্ধ মানসিকতা বলে আমি ভাবতে পারি কারণ এমন মানসিকতাও তো অভিনেতাকে আত্মকেন্দ্রিক নার্সিসাস চিন্তা থেকে বার করে এনে নিজের থেকে বড় কোনও বিবেচনার মধ্যে উদ্বোধিত করতে পারে। এই মানসিকতার অধিকারী হলেও তো অভিনেতা জনসাধারণকে আনন্দ বিতরণের দায় স্বীকার করে তার অভিনয়কর্মকে এক সেবাধর্মে উন্নীত করতে পারে। হয়তো অল্পবয়সের আত্মপ্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা তখন সত্যপ্রদর্শনের সাধনপথে এসে দাঁড়াতে পারে। বহুজনকে বিনোদিত করার অভিপ্রায় হয়তো তখন বহু মানুষের হিতচিন্তার অভিমুখে অভিনয়কর্মীকে ভাবিত করে তুলতে পারে।

তখন অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়, উন্নততর মানুষ হওয়ার সাধনাই অভিনেতার যাত্রাপথের লক্ষ্য হয়ে উঠতে থাকে। উৎকৃষ্ট অভিনেতা হওয়ার পথ এবং উন্নত মানুষ হওয়ার পথ তখন অভিন্ন
হয়ে যায়।

এই যাত্রার প্রধান প্রেরণা একটি চার-অক্ষরি শব্দের মধ্যে অনন্ত শয়ানে এলায়িত হয়ে থাকে— ভালবাসা। এই শব্দের আন্তরিক শক্তি শিল্পীকে বিরামহীন পথিক করে রাখে। আর এই পথের প্রধান পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে তার মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা— যে ভাষায় সংলাপ উচ্চারণ করে প্রতিদিন তার হৃদয় সার্থকতার বোধে পূর্ণ হয়। তখন তার মনে হয়—

পুরস্কার তিরস্কার কলঙ্ক কণ্ঠের হার

তথাপি এ পথে পদ করেছি অর্পণ,

রঙ্গভূমি ভালোবাসি হৃদে সাধ রাশি রাশি

আশার নেশায় করি জীবন যাপন।

১১ জুলাই ২০১৮-য় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত
সপ্তম রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত স্মারক বক্তৃতা
(‘অভিনেতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতি’)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE