Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

আশ্চর্য আড্ডার ভুবন

ষাটের দশকের উত্তর কলকাতা পাড়া সংস্কৃতির পীঠস্থান, আর তার গর্ভগৃহটি হল রোয়াক বা রক। শুধু টেনিদা বা ক্যাবলা, প্যালারা নয়। যুবক থেকে প্রৌঢ়, সকলেরই ঠাঁই সেখানে। ঘনাদার চিলেকোঠার আড্ডা ছিল অন্য। কিন্তু রকের আড্ডায় রাজনীতি থেকে যামিনী রায়, মোহনবাগান থেকে সোফিয়া লোরেন মিশে যেতেন অনায়াসে।এই ছোট রাজপথগুলিই উত্তর কলকাতার নানা ‘অঞ্চল’-এর নির্ধারক।

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

চাপা-কল থেকে শোঁ-শোঁ করে গঙ্গার জল হোসপাইপ বেয়ে ঝাঁ-চকচকে পেতলের মুখ থেকে বেরিয়ে এসে ধুইয়ে দিচ্ছে আশুতোষ শীল লেনের কালো পিচের রাস্তা। তোড়ে আসা সেই জলরাশি মুহূর্তে দিনভর পথে জমা ধুলো, শালপাতা আর টুকিটাকি জঞ্জাল ধুয়ে সহসা স্রোতস্বিনী-হয়ে-ওঠা বাঁধানো নর্দমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জলের অভিঘাতে প্রথম প্রভাতে খাদ্যসন্ধানী চড়াই আর পায়রার দল উড়ে গিয়ে বসছে গলির সার-সার বাড়ির রেলিং আর কার্নিশে। শার্সি-খোলা জানালাগুলো থেকে রেডিয়ো-বাহিত হয়ে ভেসে আসছে নাৎসি অত্যাচারে এ দেশে পালিয়ে আসা শরণার্থী-সুরকার ওয়াল্টার কাউফম্যান সুরারোপিত ‘আকাশবাণী’র সেই বিখ্যাত সিগনেচার টিউন। মধ্য-ষাট দশকের সুকিয়া স্ট্রিট, উত্তর কলকাতা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে।

দশ-বারো ফুটের জলের পাইপ সামনে-পিছনে এনে, কুড়ি প্লাস কুড়ি প্রায় চল্লিশ ফুট রাস্তা ধুয়ে, পাইপওয়ালা তার বাঁ কাঁধে পাইপ গুটিয়ে গলির ভিতর চলে গেল আরও একটি চাপা-কলের কাছে, যেখান থেকে আবার শুরু হবে ধৌত-কর্ম। এই ভাবে ধুতে ধুতে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় স্ট্রিটে পৌঁছে হয় ডান হাতের সার্কুলার রোড (এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড), বা, বাঁ হাত ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিটের (এখন রাজা রামমোহন রায় সরণি) দিকে চলে যাবে। প্রাত্যহিক এই প্রভাতি কার্যক্রমে এ পাশ-ও পাশ মিলে ফুট চল্লিশ রাস্তা চকচক করে। তার পর ফুট পাঁচেক রাস্তা বাদ দিয়ে আবার ফুট চল্লিশ জল ধোওয়ার আওতায় থাকে। এই সব জলসিঞ্চিত চিকচিকে কালো রাস্তার মাঝে মাঝে ওই না-ধোওয়া ম্যাটমেটে জায়গাগুলো কলকাতার রাজপথ ও গলিগালায় মিনিট দশেকের জন্য এক জাদু শতরঞ্চি বিছিয়ে রাখে। সূর্যের তাপ একটু বাড়লেই যা উবে যাবে। এই ভাবে গার্সিয়া মার্কেজ় পড়ার আগেই উত্তর কলকাতা জাদুবাস্তবতার গূঢ় কথা জেনে যায়!

গলি থেকে গলির ভুলভুলাইয়া পেরোতে পেরোতে মাঝে মাঝে বাস-ট্রাম চলা রাজপথ পেরিয়ে ফের গলির গর্ভে ঢুকে কলকাতা শহরের যে অংশে যে কোনও জায়গা থেকে যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, মহানগরের সেই অংশটিরই নাম উত্তর কলকাতা। সাহেবি আমলের ‘ব্ল্যাক টাউন’। ধরুন, আপনি শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর দিক থেকে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে যেতে চান। কোনও চিন্তা নেই! সাবেক কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (এখন বিধান সরণি) হয়ে ফড়িয়াপুকুরের শিবদাস ভাদুড়ি স্ট্রিটে ঢুকে কীর্তি মিত্র লেন-এ সেঁধিয়ে যান। এর পর ‘মোহনবাগান’-‘শিকদার বাগান’-এর গলিপথ ধরে (এর মধ্যে অনেকগুলিতেই গাড়ি ঢোকে না, বা একটি ঢুকলে উল্টো দিকেরটি দাঁড়িয়ে যায়) ক্রমশ দক্ষিণের দিকে এগোতে থাকুন। মাঝে মাঝে গ্রে স্ট্রিট (এখন অরবিন্দ সরণি), বিবেকানন্দ রোড আর কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের মতো ছোট-বড় রাজপথ পার হয়ে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট-কলেজ রো দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে (‘দিলখুশ’ রেস্টুরেন্টের উল্টো দিক) পৌঁছে যান! একই ভাবে বৌবাজার অঞ্চলের নানা গলির চক্রব্যূহ দিয়ে ধর্মতলা বা ডালহৌসির আপিসপাড়ায় গিয়ে উঠুন!

এই সব গলি-উপগলি, পুবে-পশ্চিমে ধাওয়া নানা ছোট রাজপথ (যেমন বাগবাজার স্ট্রিট, গ্রে স্ট্রিট, বিডন স্ট্রিট, সুকিয়া স্ট্রিট বা কেশব সেন স্ট্রিট) থেকে বেরিয়ে শিরা-উপশিরার মতো উত্তর কলকাতাকে একটি ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক (ঐতিহাসিকও) ব্যবস্থা হিসেবে বেঁধে রেখেছে বহু দিন। পুবে-পশ্চিমের এই ছোট রাজপথগুলি আবার উত্তর কলকাতার উত্তর-দক্ষিণমুখী তিনটি প্রধান রাজপথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র (আপার সার্কুলার) রোড, বিধান সরণি বা চিত্তরঞ্জন (সেন্ট্রাল) অ্যাভিনিউ, বা কয়েকটি রবীন্দ্র সরণিতেও (চিৎপুর) গিয়ে পড়েছে।

এই ছোট রাজপথগুলিই উত্তর কলকাতার নানা ‘অঞ্চল’-এর নির্ধারক। যেমন, কেউ নিজেকে ‘সুকিয়া স্ট্রিটের ছেলে’ বললে (‘ছেলে’ই বলত, কদাপি ‘মেয়ে’ নয়— আসলে ১৯৬০-’৭০-এও উত্তর কলকাতা দারুণ পুং-কেন্দ্রিক) ওই রাজপথের বিস্তৃত অঞ্চলের নানা গলি-উপগলির সামগ্রিক অস্তিত্বকেই বোঝাত। আর ‘পাড়া’ বলতে বোঝাত ওই ‘অঞ্চলের’ একটি বা কয়েকটি গলিকে। যেমন, সুকিয়া স্ট্রিট অঞ্চলের বৃন্দাবন মল্লিক ফার্স্ট লেন, কিংবা বাদুড়বাগান, বা আশুতোষ শীল লেন-কালু ঘোষ লেন নিয়ে এক একটি ‘পাড়া’। পাড়াগুলির সাংস্কৃতিক সীমানা নির্ধারণ করত মূলত বারোয়ারি দুর্গোৎসব। চাঁদা তোলা থেকে ঠাকুর ভাসান, এবং তার পর বছর-শেষ অব্দি নানা খোলা জলসার অনুষ্ঠান, পাড়া সংগঠনগুলিকে পরস্পরের প্রতি কখনও তীব্র, কখনও মৃদু ঈর্ষা-প্রতিযোগিতায় চাগিয়ে রাখত।

উত্তর কলকাতার নানা অঞ্চলে তখনও উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের পুরনো ‘কলচর’-এর রেশ ইতিউতি লেগে আছে। কিছু পুরনো দিনের মানুষ তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ‘রবিবাবুর গান’ বলেন। অনেকেই পুরনো বনেদি বাড়ির বৈঠকি আসরের স্মৃতিধর। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ অনুরোধ করলে লালচাঁদ বড়াল, জ্ঞান গোঁসাই বা ‘কানা কেষ্ট’র (মান্না দে-র কাকা, কৃষ্ণচন্দ্র দে) দু-এক কলি চোখ বুজে গেয়ে দিতে পারতেন। এঁদের চোখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দারুণ আধুনিক, শ্যামল ‘মিত্তির’ তো ‘বাচ্চা ছেলে’! তবে, বোধকরি ’৪৩-এর মন্বন্তরের মর্মান্তিক দৃশ্য আর ‘৫৯/৬৬-র খাদ্য আন্দোলনের টাটকা স্মৃতিতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ও সলিল চৌধুরীর গানের (বিশেষত, ‘গাঁয়ের বধূ’র) প্রতি বিশেষ দুর্বল। এঁরা পঙ্কজ মল্লিক, কে এল সায়গলের ভক্ত। চল্লিশ দশক অবধি হিন্দি গান চলতে পারে কিন্তু ‘লারেলাপ্পা’ হিন্দি গানের প্রতি এঁদের তীব্র অশ্রদ্ধা। অথচ, এই গানেই (আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে) তখন উত্তর কলকাতার তরুণ সমাজ ভাসছে। রেস্ত-এর টানে বনেদি বাড়ির জলুস কমেছে, ঠাকুরদালানের বৈঠকি গানের প্রদীপও নিভু-নিভু। এই সময় বারোয়ারি পুজো-কেন্দ্রিক পথেই অনুষ্ঠিত গানের জলসাগুলি ‘নতুন’ আধুনিকতা নিয়ে আসে। সাধারণ মানুষের যোগদানে আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়তে থাকে।

এই রকম খোলা জলসায় (কিছু চৌকির ওপর ফরাস পেতে বানানো মঞ্চে) সেই সময়ে অতি জনপ্রিয় পিন্টু ভট্টাচার্য, হৈমন্তী শুক্ল থেকে আরতি মুখোপাধ্যায়, বা সদ্য ‘ওঠা’ অনুপ ঘোষাল, মীরা বিশ্বাস-বুবাই বিশ্বাস, বা প্যারডি শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত— কার গান শুনিনি! শেষোক্ত শিল্পী চলতি হিন্দি ছবির জনপ্রিয় গানে মুহূর্তে মজাদার কথা বসিয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন। যেমন, শাম্মি কপূর-শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ মুক্তি পেলে গেয়েছিলেন: ‘আরে ছেলের কথা শুনে হলাম হাবা/ বলে, সিনেমায় নিয়ে চল না বাবা/ পথে পথে পোস্টার দেখি টুপির ওপর মেয়ে নাচে/ নিয়ে চল, চল, চল, চল/ অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস...’ অথবা, রাজেশ খণ্ণা-শর্মিলা ঠাকুরের ‘আরাধনা’র ‘রূপ তেরা মস্তানা’র অনুসরণে— ‘কোথায় তোমার আস্তানা/ দিয়েছিলে ভুল ঠিকানা/ কোন পাড়ার কোন মোড়ের ডাইনে-বাঁয়ে...’

মূলত হারমোনিয়াম-তবলার ভরসায় এই সব অনুষ্ঠান চলত। একটু কেতার হলে সঙ্গত-শিল্পীদের থাকত বুকে ঝোলানো অ্যাকর্ডিয়ান ও বেহালা; তবলার পাশাপাশি থাকত ‘নাল’ বা আফ্রিকার ছোট তবলা-জোড়া, যা ‘বোঙ্গো’ নামে পরিচিত। পপ জাতীয় গানে ম্যারাকাস বাজত, যেমন, আরতির ‘জলে নেমো না/ আর থই পাবে না...’ গানে। অনেক বিখ্যাত শিল্পী কোনও পাড়ার আত্মীয় হলে তাদের গর্বের শেষ থাকত না। যেমন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বৃন্দাবন মল্লিক ফার্স্ট লেন-এর কোনও বাড়ির ‘জামাই’। সেই সূত্রে প্রায় ফি-বছর তাঁর মাতিয়ে রাখা অনুষ্ঠান দেখেছি। এক বার শোনা গেল, আশুতোষ শীল লেনের এক বাড়ির ‘আত্মীয়’ মান্না দে (আদতে বিবেকানন্দের বাসগৃহ সংলগ্ন সিমলা অঞ্চলের বাসিন্দা) আসবেন ‘সুকিয়া কেন্দ্র’-এর অনুষ্ঠানে। শেষমেশ কী কারণে হয়নি। তাই নিয়ে অন্যান্য পাড়ার ছেলেদের সে কী প্যাঁক!

পুজোর আগে-পরে ছেলেরা আশেপাশের পার্কের এবড়োখেবড়ো অপরিসর জমিতে শতচ্ছিন্ন চামড়ার ব্লাডারওয়ালা ‘ফুটবল’ পেটাত। বেশির ভাগেরই পার্কে স্থান সঙ্কুলান হত না, তারা নিজেদের গলির মধ্যেই রবারের অতি শক্ত বড় বল দিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাত। শীতকালে ইটের ওপর ইট সাজিয়ে উইকেট বানিয়ে ক্রিকেট খেলত। চোখ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ডাং-গুলি চলত, মার্বেল (আসলে কাচের) গুলিও। ‘কিং-কিং’ নামে একে অন্যের গায়ে ছোট রবারের বল ছুড়ে মারার বিপজ্জনক খেলাও ছিল। এই সময় ছুটে আসা বলের গতি ও দিশা বুঝে পথচারী ও শকটাদিকে (বেশির ভাগই হাতে-টানা রিকশা, কদাপি মোটরগাড়ি বা ট্যাক্সি) নিজের ‘রিস্কে’ যাতায়াত করতে হত। কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হলে ছেলেদের অনেকেরই ঠাঁই হত পাড়ার নানা ‘রক’-এ, যাকে আদর করে ‘রোয়াক’ বলার চল ছিল। সে এক অদ্ভুত আড্ডার ভুবন!

চব্বিশ-পঁচিশের ছোকরা-যুবক থেকে বাহাত্তুরে বুড়ো— নানান বয়স, পোশাক, রুচি আর মতবাদের অদ্ভুত সংমিশ্রণ আর সমন্বয় হত রোয়াকের আড্ডায়। বলা যেতে পারে তর্কশীল কলকাতার এক নিখরচার পথ-প্রান্তিক উত্তুরে রূপ। কবে কী ভাবে উত্তর কলকাতায় ‘রোয়াক’ সংস্কৃতির শুরুয়াত তা হয়তো প্রয়াত বিনয় ঘোষ (‘কালপেঁচা’) বলতে পারতেন, কিন্তু সাদা চোখে দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে উত্তরের যে ক’টি নির্মাণগত তফাত চোখে পড়ত, তার মধ্যে প্রধান হল গলি, গাড়িবারান্দা আর রোয়াক। দক্ষিণেও কোথাও কোথাও রোয়াক-এর আড্ডার কথা শোনা গেলেও উত্তরের কাছে তা নস্যি! বড় বাড়ির প্রবেশ-দ্বারের পাশে রোয়াক হয়তো গোড়ায় বাড়ির পুরুষদের কাছে আগত বন্ধুবান্ধবদের জন্য তৈরি হয়েছিল— যাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা ছিল। কিন্তু পরে রোয়াকগুলি হয়ে দাঁড়ায় পাড়ার ‘সামাজিক’/‘কমন’ বা ‘সবার’ বসার ও আড্ডা দেওয়ার অধিকারের ক্ষেত্র— শহুরে চণ্ডীমণ্ডপ!

এঁদো গলি থেকে বড়-ছোট রাজপথ সর্বত্র রোয়াক থাকলেও, আড্ডা জমত কোনও গলি ও ছোট রাজপথের মোড়ের রোয়াকগুলিতেই। উত্তরে বাগবাজার, দর্জিপাড়া, ফড়েপুকুর থেকে দক্ষিণে বৌবাজার-তালতলা অবধি রোয়াক-সংস্কৃতি প্রসারিত ছিল। কাছাকাছি অবশ্যম্ভাবী চায়ের দোকান থাকত— পান-বিড়ির দোকান থাকলে সোনায় সোহাগা। বিকেল পাঁচটা-ছ’টা থেকে আড্ডা শুরু হয়ে আটটা-ন’টা অব্দি গড়াত। ছুটির দিনে দু’বেলাই। চলমান জীবন দেখতে দেখতে চলা আড্ডা কিছুটা এলোমেলো হত বর্ষায়, যদি না মাথায় বড় ঝুলবারান্দার ছাউনি থাকত। বৃষ্টি থামলে যখন সুকিয়া স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, ঠনঠনে বা কলেজ স্ট্রিটের অনেক জায়গা ‘ভেনিস’-এর চেহারা নিত, তখন অনেক নাছোড় আড্ডাধারী গন্ডোলার বদলে টানা-রিকশা চেপে রাস্তা থেকে রিকশার সরু-লম্বা হাতল রোয়াকে লাগিয়ে সেতুর মতো তার ওপর দিয়ে রোয়াকে পৌঁছতেন। অনেকে আবার এহেন কসরতে অকৃতকার্য হয়ে পা পিছলে ঘোলা জলে পড়ে (চালু ভাষায় ‘ল্যাটা মাছ ধরে’), পরের দিন আড্ডার ‘খোরাক’ হতেন।

অনেক সময় বয়স অনুযায়ী আড্ডার বিভাজন থাকত, আলোচ্য বিষয়ও হত বিভিন্ন। শুধু বয়স্কদের আড্ডা হলে চলত কিছুটা ধর্ম, কিছুটা দাবা, কিছুটা পুরনো সংস্কৃতি, বাকিটা হা-হুতাশ। একদম ছেলেছোকরাদের হলে কিছুটা রাজনীতি, কিছুটা হিন্দি ছবি (রাজেশ খণ্ণা তখন সদ্য ‘উঠছেন’) আর বাকিটা পাড়ার সুন্দরী কন্যাদের গুণকীর্তন, কেচ্ছা। এই জাতীয় আড্ডার সঙ্গে প্রায়শ বাড়ির মালিক বা পাড়ার লোক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত। অনেক সময় নিজের বাড়িতে ঢুকতে হত এই সব উৎপাতস্বরূপ ‘রকবাজ’দের সরিয়ে। কিন্তু আসলে জমত মিশ্র বয়সের আড্ডাগুলি। এখানে রাজনীতির তত্ত্বকথা থেকে যামিনী রায়ের ছবি, ক্রিকেটের পঙ্কজ রায়-শুটে বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মোহনবাগানের গোষ্ঠ পাল বা শৈলেন মান্না, সিনেমায় সুচিত্রা সেন-মধুবালা থেকে সোফিয়া লোরেন-লোলোব্রিজিদা তর্ক-সমঝোতায় মিলেমিশে থাকত। বেশির ভাগ আড্ডাধারীই ধূমপান করতেন বা পান খেতেন। তবে বয়সের তারতম্য খেয়াল রাখতে হত। সুকিয়া স্ট্রিট-কালু ঘোষ লেনের মোড়ের ‘সান্যাল–লাহিড়ি’ কোম্পানির রোয়াকে এমনই মিশ্র আড্ডায় একই পরিবারের তিন প্রজন্মের তিন সদস্যকে পরস্পরের বিপরীতে মুখ করে ধূমপান করতে দেখেছি।

মুখে-জগৎ-মারা, সবজান্তাপনা এবং বিশুদ্ধ গুলবাজি এই সব আড্ডার আবশ্যিক গুণ ছিল। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘টেনিদা’ সিরিজ়ে ব্যাপারটাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে যান, সেই সঙ্গে অমর করে যান ‘পটলডাঙা’র ‘চাটুজ্জেদের রোয়াক’-কে, যেখানে বসে বিশ্বপেটুক ও মহা-গুলবাজ টেনিদা তার তিন চ্যালা-কাম-বন্ধু প্যালারাম, ক্যাবলা আর হাবুল সেনকে নিয়ে নানান নতুন অ্যাডভেঞ্চারের প্ল্যান ভাঁজছে, আর মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ছে: ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস’! টেনিদা-ভক্ত বাঙালিরা অনেকে জানেন, এক সময় পটলডাঙার বাসিন্দা নারায়ণবাবু তাঁর বাড়িওলা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের আদলে ‘টেনিদা’র চরিত্র গড়েছিলেন। কিন্তু ক’জন জানেন, কোথায় পটলডাঙা? আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস পেরিয়ে মহাত্মা গাঁধী রোড ক্রসিং-এর আগে বাঁ-হাতি মহা-সরু যে গলিটা নানা পাক খেয়ে বৈঠকখানার (সূর্য সেন স্ট্রিট) দিকে বেরিয়েছে, তারই নাম পটলডাঙা স্ট্রিট!

এই সব গুণাবলি অনেক সময় বাস্তবে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছত। ফড়িয়াপুকুরের খেলার দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে ‘ব্যাগাডুলি’ কিনতে গিয়ে রোয়াকের এক মিশ্র বয়সের আড্ডায় ‘রামমোহন বড় না বিদ্যাসাগর’, এই তীব্র সরব তর্কে কান চলে যায়। খানিক ক্ষণ চলার পর, এক টাকমাথা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত (সম্ভবত ‘বাঙাল’) মাঝবয়েসি বিদ্যাসাগরপন্থীর কানভেদী মন্তব্য আজও মনে আছে: ‘হালার পুত, বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় না লিখলে তগো রামমোহন লিখাপড়া শিখল কী কইরা?’ এই ‘অকাট্য যুক্তি’তে রোয়াকের আড্ডা কিছু ক্ষণ থেমে গিয়েছিল।

১৯৬৭-র প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর থেকে উত্তর কলকাতার পাড়া ও রোয়াকের আড্ডার চরিত্র পাল্টাতে থাকে। ‘নকশালবাড়ি’র নাম আমাদের ছোট্ট কানেও পৌঁছয়। গলির দেওয়ালে চিনের চেয়ারম্যান ‘আমাদের চেয়ারম্যান’ হয়ে ওঠেন। ‘শ্রীকাকুলাম’-এর নামও জেনে যাই। সার্কুলার রোডের ও পারে গড়পার থেকে মুহুর্মুহু পেটো ফাটার আওয়াজ ভেসে আসে। রাস্তাঘাটে সিআরপি-র গাড়ি বাড়তে থাকে। রাতারাতি রোয়াকের ছেলেরা ‘বিপ্লবে’ নেমে পড়ে। গলিতে পড়ে থাকা তরুণদের লাশ ক্রমশ ‘চেনা’ হয়ে ওঠে।

এই এলোমেলো সময়েই উত্তর কলকাতার পাড়া ও তার আড্ডাগুলোর পুরনো বৈঠকি ছন্দও কেটে যায়। ‘৮০-’৯০ এর দশকে উত্তর কলকাতার নানা অংশে অ-বঙ্গভাষী লোহার ব্যবসায়ীদের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দাপট বাড়তে থাকে। এই সময় আরও বহু পরিবার শহরের বাড়তে-থাকা পুবে-দক্ষিণে উঠে যায়। রোয়াকের আড্ডা তার প্রাণশক্তি হারাতে থাকে। অনেক বাড়ির মালিক রোয়াকের সমতল পরিসরকে ঢালু করে বাঁধিয়ে আড্ডার সম্ভাবনাই চিরতরে শেষ করে দেন। এখনও উত্তর কলকাতার নানা জায়গায় ‘রোয়াকের আড্ডা’ চলছে হয়তো কোথাও কোথাও। কিন্তু আগেকার বেগবান বহুমাত্রিক কথা-নদীর তুলনায় সে নিতান্তই ‘মরা নদীর সোঁতা’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Culture Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE