Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল সত্যের প্রয়োগ

প্রথম বইয়ের নাম দিলেন ‘হিন্দ স্বরাজ্য’। সেই স্বরাজ্য এক আদর্শ, তার অভাবে রাষ্ট্রিক সাফল্যও হয়ে যায় অলীক কুস্বপ্ন। অতঃপর জনতার সামনেই তিনি রেখে যাবেন নিজের দ্বিধা ও দৌর্বল্যের যাবতীয় বিবৃতি।ভারতের মতো বহুভাষী দেশে অনুবাদ নিয়ে, একাধিক ভাষায় বোঝা ও বোঝানো নিয়ে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে ভাবতে হয়েছে।

সম্পাদনা: হিন্দি ‘হরিজনসেবক’ এবং গুজরাতি পত্রিকা ‘নবজীবন’

সম্পাদনা: হিন্দি ‘হরিজনসেবক’ এবং গুজরাতি পত্রিকা ‘নবজীবন’

গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৫৫
Share: Save:

ভারতের মতো বহুভাষী দেশে অনুবাদ নিয়ে, একাধিক ভাষায় বোঝা ও বোঝানো নিয়ে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে ভাবতে হয়েছে। কী লিখছির সঙ্গে কোন ভাষায় কী ভাবে লিখছি, নিজের দেশি গুজরাতি থেকে প্রভুমন্য ইংরেজির রকমফেরে চিন্তা কী ভাবে প্রকাশ করব, কাদের কাছে বক্তব্য রাখব, তরজমার ধরন কী হবে, তারই সঙ্গে ভাষা ভেদে ভাবনাতে কতটুকু প্রতিসরণ হবে, জীবনচর্চা ও জীবনচর্যায় গাঁধী বারবার এই সমস্যার মোকাবিলা করেছেন। গুজরাতি তাঁর মাতৃভাষা কিন্তু স্কুলে ইংরেজিতে তিনি বেশ কাঁচা ছিলেন, ভাষা শেখার পদ্ধতিরও মাথামুন্ডু বুঝতেন না। পরে যৌবনে স্বচেষ্টায় ইংরেজি শিখেছিলেন, ইংল্যান্ডে আইন পড়বার সময় রোমান বিধি লাতিন ভাষ্যে পড়েছিলেন, ফাঁকি দেওয়া তো তাঁর ধাতে সইত না। ১৮৯১-তে দেশে ফিরে মুখচোরা ব্যারিস্টার গাঁধী পেশা জমাতে পারেননি। ১৮৯৩-তে মেমন ব্যবসাদার দাদা আবদুল্লার কোম্পানির তরফে একটি জটিল মামলায় সাহায্য করার জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবার নিমন্ত্রণ পেলেন। কাজটা সওয়াল করার নয়, বরং ভাষান্তর করার। মামলার নথিপত্র সাবুদ সব গুজরাতিতে, লিপিও তাই। অন্যপক্ষে উকিলরা সব সাহেব, ইংরেজিটাই জানেন। একপক্ষে গুজরাতি দলিল থেকে ইংরেজি আইনমাফিক পয়েন্ট অনুযায়ী সারসংক্ষেপ তৈরি করে উকিলদের হাতে ধরাতে হত, অন্যপক্ষে ইংরেজি আইনের নানা ধানাইপানাই থেকে মামলার সারমর্ম ইংরেজিতে অনভিজ্ঞ গুজরাতি মক্কেলকে কাথিয়াওয়াড়ি উচ্চারণে সহজ দেশি ভাষায় বোঝাতে হত। পেশার খাতিরেই গাঁধী হয়ে উঠেছিলেন সফল দোভাষী, জটিল ও দীর্ঘ বিষয়কে সহজ ও সরল ভাবে উপস্থাপনা করার জন্য তাঁর খ্যাতি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাগাড়ম্বরপ্রিয় বাগ্মী তাঁর নাপসন্দ ছিল।

পেশা থেকে নেশা, অর্থকরী কাজ থেকে সমাজসেবা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থা জানাবার জন্য ও পারস্পরিকতায় তাঁদের সংগঠিত করার জন্য ১৯০৩ থেকে গাঁধী ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ বলে গুজরাতি ও ইংরেজিতে সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করছেন। দশ বছর ধরে এই পত্রিকাতে তিনি দুটি ভাষাতেই একনাগাড়ে লিখে গেছেন। গাঁধী অকপটে জানিয়েছেন যে প্রথম যৌবনে ওই লেখালিখি ও সাংবাদিকতাই তাঁর চিন্তা ও সাধনার বাহন হয়ে উঠেছিল। মানুষের মনের রং ও গঠন কত বিচিত্র হয়, তার আঁচ তিনি ওই পত্রিকায় পাঠানো রচনার মধ্যে পেয়েছিলেন। পাঠকের চিঠি পড়ে, মর্ম হজম করে, যথাযথ জবাব দিতে তিনি দুটো
ভাষাকেই রপ্ত করেছিলেন। সৎ চিন্তাকে ভাষায় প্রকাশ করা, এক ভাষার সৎ গ্রন্থকে অন্য ভাষায় বুঝে উপস্থাপিত করাই তো পত্রিকার কাজ। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোনও পত্রিকা সমাজের চিন্তাভাবনার অগ্রগতি ঘটাতে পারে, সমাজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’-এর পাতাতেই দুরুস্ত দোভাষী মোহনদাস রূপান্তরিত হলেন সত্যান্বেষী দ্বিভাষিক লেখক কর্মচন্দ গাঁধীতে।

তরজমা শব্দটি আরবি। ভাষান্তরে মূল বক্তব্যের সরাসরি বিশ্বস্ত পুনঃকথন অর্থে শব্দটি প্রযুক্ত। নিজের রচনায় ওই শব্দটি ভাষান্তর অর্থেই গাঁধী ব্যবহার করেছেন, গুজরাতি বা হিন্দিতে চালু কথা। অভিধানে তরজমার প্রতিশব্দ রূপে অনুবাদ কথাটি গ্রাহ্য, এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় অনুকীর্তনের ক্রিয়াকাণ্ডই অনুবাদ। তবে অনুবাদের লক্ষণার্থ ব্যাপক, অনুবাদ রসময় পাঠও বটে। চৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, ‘লিখিত গ্রন্থের যদি করি অনুবাদ। তবে সে গ্রন্থের পাইয়ে আস্বাদ।’ অনুবাদ অর্থ প্রকাশক, নিহিত বিষয়ার্থের বোধক। কৃষ্ণদাস-এর বর্গে, ‘‘‘বিধেয়’ কহিয়ে তারে যে বস্তু অজ্ঞাত। ‘অনুবাদ’ কহি তারে সেই হয় জ্ঞাত।’’ দ্বিভাষিক গাঁধীর রচনাতে তরজমা ও অনুবাদ দুই অর্থেই প্রতিচ্ছেদিত হয়েছে, একে অন্যকে পড়ার স্বাদে রকমফের ঘটিয়েছে।

পুরোধা: দার্জিলিঙের রাস্তায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে।

গাঁধী জোহানেসবার্গ থেকে নাটাল যাচ্ছেন। স্টেশনে বন্ধু পোলক তাঁর হাতে রাসকিনের ‘আনটু দিস লাস্ট’ বলে বইটা ধরিয়ে দিলেন। বইটা এক নিশ্বাসে গাঁধী শেষ করলেন। রাতে ঘুম এল না। বইটা একেবারে ‘গ্রন্থরত্ন’। গাঁধীর মতে, রাসকিন আদতে কবি। কবিদের প্রতি গাঁধীর শ্রদ্ধা অপরিসীম। তাঁরাই মানুষের মনের নিহিত গুপ্ত মহৎ ধারণাকে জাগিয়ে তোলেন। তাঁদের রচনাপাঠে পাঠকের জীবনচর্যার নিহিত নির্দেশগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাব্য তো ‘কান্তা সস্মিত’ উপদেশ, সহৃদয়ের অধিগম্য। রাসকিনের বই পড়েই মোহনদাস বুঝতে পারলেন, কায়িক শ্রমের মর্যাদা কী, উকিলের ওকালতি ও নাপিতের হাজামতি তুল্যমূল্য, শ্রমনির্ভর জীবনই বাঞ্ছিত। ১৯০৮-এ ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’-এ বইটা তিনি তাঁর ভাবনামতো গুজরাতিতে ‘তরজুমা’ করছেন, বেছে বেছে কিছু অনুচ্ছেদ, তাঁর বোধ অনুযায়ী মূল ভাবগুলি অন্বিত হচ্ছে। গুজরাতিতে ‘অন্ত্যোদয়’ নামটাই মূলের লাগসই হত, তার পরিবর্তে আর একটা নাম দিলেন ‘সর্বোদয়’, ইংরেজি প্রতিশব্দও জুড়লেন, ‘দ্য ওয়েলফেয়ার অব অল’। সর্বজনহিতের প্রবক্তা গাঁধী আদৌ বেনথামীয় হিতবাদী দর্শনের অনুগামী নন। অনুবাদের শেষে ভারতের অবস্থার প্রেক্ষিতে রাসকিনের ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যার সূত্রে অনুবাদক নিজের বক্তব্য জুড়ে দিলেন। উপসংহারে গাঁধীর স্বরাজের ধারণা সরাসরি উচ্চারিত হল, সত্য সাধনা ও স্বরাজ সাধনা অচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। আধুনিক শিল্পায়ন ও উপনিবেশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন স্বরাজ সাধনার অন্তরায়, জবরদস্ত জঙ্গি রাষ্ট্রের ভাবী ভিত্তি, খাড়া-বড়ি-থোড়ের জায়গায় থোড়-বড়ি-খাড়া প্রতিষ্ঠা করার পর্ব মাত্র। এ ভাবেই গাঁধীর গুজরাতি তরজমায় রাসকিনের খ্রিস্টীয় ন্যায়-নীতিবোধ অনূদিত হচ্ছে গাঁধীর স্বরাজ-সত্যবোধে, নিহিত অর্থের পাঠ তাড়নায় অনুবাদটি রূপান্তরিত হচ্ছে ভাষ্যে।

লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার পথে জাহাজের ডেকে গাঁধী

গত দুই দশক ধরে ত্রিদীপ সুরহুদ, সুরেশ শর্মার মতো গবেষকরা গাঁধীর দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক লেখাগুলির তুলনাত্মক সংস্করণ সম্পাদনা করছেন, প্রকাশিত হচ্ছে চন্দুভাই দালাল বা নারায়ণ দেশাই-এর গাঁধী বিষয়ক গুজরাতি রচনার সুসম্পাদিত অনুবাদ। এখন জানি যে ১৯০৯-এ ইংল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্টিমারে ফেরবার পথে মাত্র নয় দিনে প্রশ্ন ও উত্তরের ঢঙে লেখা গুজরাতি পুস্তিকার আদি নাম আদৌ ‘হিন্দ স্বরাজ’ নয়, বরং ‘হিন্দ স্বরাজ্য’, ওই নামে পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে, পরে চটি বই (১৯১০) হিসাবে ছাপানো হয়। বেরোনো মাত্রই সরকার ভারতে ওই নামের বইটা নিষিদ্ধ করে। তখন গাঁধী নিজে পুস্তিকাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পুস্তিকাটির নাম দেন ‘ইন্ডিয়ান হোমরুল’, ১৯১৪ সালে প্রকাশিত নতুন গুজরাতি সংস্করণের পরিবর্তিত নাম হয় ‘হিন্দ স্বরাজ’। ১৯২১-এ ইংরেজি অনুবাদের আখ্যাপত্রে আমাদের বহুপরিচিত নামটি জাঁকিয়ে বসে, ‘হিন্দ স্বরাজ অর ইন্ডিয়ান হোম রুল’।

১৯৪৬-এর জুলাই মাসে বোম্বাইয়ে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সভায় নেহরু ও পটেলের সঙ্গে গাঁধী।

আদি গুজরাতি সংস্করণগুলি ও ইংরেজি অনুবাদ পাশাপাশি রেখে পড়লে বোঝা যায় যে ভাষান্তরের টানাপড়েনে কী ভাবে ‘পররাজ্য’-এর বিপরীতে কেবল ‘স্বরাজ্য’ শব্দটি ধীরে ধীরে প্রযুক্ত হচ্ছে, দেশি ও বিদেশি শাসনের পারস্পরিক বিরোধী অর্থে। অন্য পক্ষে, কেবল হোমরুল বা রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে ‘স্বরাজ’ কথাটির অর্থ আর সীমিত থাকছে না, বরং ব্যাপক অর্থে প্রসারিত হচ্ছে, স্বরাজের গুজরাতি প্রয়োগ ও ইংরাজি সম্প্রসারণ হচ্ছে সর্বাতিশ্রয়ী আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশাসন ও আত্মসংযম-এর সমার্থে।

এহেন স্বরাজ চৈতন্যে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা গণপরিষদে ভোটাধিকার বাহ্য ঘটনা মাত্র। বরং কৌম জীবনে পশ্চিমি সভ্যতার সার্বিক পরিহারই ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর প্রকল্পকে সর্বার্থসার্থক করে তুলবে। ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর এহেন ব্যাখ্যায় গুজরাতিতে গাঁধী বারবার ‘সুধার’ ও বিপরীতার্থক ‘কুধার’ ব্যবহার করেছিলেন। সাধারণ ভাবে সুধারএর অর্থ সু-সংস্কার, প্রগতি ও উন্নয়নের আবাহন। কু-ধার ঠিক এর বিপরীত, কু-সংস্কার, অবনতি ও বিপর্যয়ের সূচক। গাঁধীর কাছে সামগ্রিকভাবে সু-ধার অর্থ সভ্যতা। পশ্চিমি সভ্যতা ও সংস্কৃতি, প্রগতি ও উন্নয়ন আসলে মানবসমাজের কাছে কুধার, ওই কুহকী সুধারে মানুষ নিয়ত পরবশ্য হয়, চিত্ত ক্লিষ্ট হয়, বিপর্যয়ের আবাহন ঘটে। ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস তার প্রমাণ। ছোট ছোট শব্দের প্রতিসরণে ও অর্থান্তরে ‘হিন্দ স্বরাজ’ পরিণত হয়েছিল গাঁধীর নিজের ভারত সভ্যতা চিন্তার এক স্বোপজ্ঞ বা নিজের করা ভাষ্যে।

শিশুকে আদর করছেন।

না গুরু গোখলের না শিষ্য জওহরলাল নেহরুর, ‘হিন্দ স্বরাজ’ রচনাটি মনঃপূত হয়নি, অন্যরাও আপত্তি তুলেছিল। পশ্চিমি সভ্যতার ও বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে সব আপত্তি সত্ত্বেও গাঁধী ট্রেনে চড়েন, প্রয়োজনে টেলিফোন ব্যবহার করেন, আবার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে ভাইসরয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন, অম্বেডকরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন। এই সব অভিযোগ গাঁধী স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সব সমঝোতাই অগত্যা কর্ম, আপামর ভারতবাসীর জন্য হিন্দ স্বরাজ্যটি পাওয়ার জনগ্রাহ্য প্রস্তুতিপর্ব। তবে গাঁধীর ঐকান্তিক স্বপ্ন হিন্দ স্বরাজ; ভারতীয় সমাজে দৈনন্দিনতার স্বার্থ চর্চিত নানা অভ্যাসের মধ্য থেকে নিষ্কাশিত ও শোধিত এক চর্যণীয় আদর্শ। গাঁধীর মতে, ওই আদর্শের স্পর্শমণি ব্যতীত যে কোনও ঐহিক ও রাষ্ট্রিক সাফল্য অলীক কুস্বপ্নে পর্যবসিত হবে। এই ধরনের মননে অন্বিত বলেই ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর অনুবাদ ভাষান্তর ও শব্দান্তরে প্রতিসরিত, সম্প্রসারিত বা সময়ে সময়ে ব্যঞ্জিত অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে অনন্য ও বিতর্কিত রচনা হয়ে ওঠে, ভারতসিদ্ধ এক অভিনব হোমরুল কথা হয়তো বা। কারও কারও কাছে অতি ভঙ্গুর সেতুসম্ভব কোনও ভবিষ্যতের জন্য এক জন ধর্মিষ্ঠ নৈরাজ্যবাদী চিন্তকের সভ্যতা সম্পর্কে আশা-ভাবনার দলিলও বটে।

অতি সম্প্রতি ত্রিদীপের যত্নকৃত সম্পাদনায় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর আত্মজীবনী পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। গাঁধীর তত্ত্বাবধানে মহাদেব দেশাই-কৃত অনুবাদ, মূল গুজরাতি রচনার অনুপুঙ্খও সম্পাদকীয় টীকায় দেওয়া আছে। নজরে আসে যে ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময় বা দুই খণ্ডে প্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদের প্রথম সংস্করণের শিরোনামে ‘অটোবায়োগ্রাফি’ শব্দটা গরহাজির ছিল, নামকরণে ‘আত্মকথা’র কোনও রণন ছিল না। সেই জন্য দ্বিতীয় সংস্করণের (১৯৪০) আখ্যাপত্রে ‘আত্মকথা’র সাধারণগ্রাহ্য ইংরেজি প্রতিশব্দরূপে ‘অটোবায়োগ্রাফি’ শিরোনামরূপে অগ্রাধিকার পেল, ‘সত্যনা প্রয়োগ’-এর প্রতিশব্দরূপে একরাশ ইংরাজি শব্দাবলি বিকল্প অনুনাম রূপে হাজির হয়েছিল। এই বিন্যাসের রদবদলের কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। পাঠভেদে সৌকর্য সাধন সঙ্গত কারণ হতেই পারে। তবে দ্বিভাষিক পাঠকের কাছে একটি ইঙ্গিত অনুভববেদ্য। গ্রন্থের শুরুতে গাঁধী জানাচ্ছেন যে তাঁর বই আত্ম-কথা, ঠিক ‘জীবন বৃত্তান্ত’ নয়, ‘ওয়াকাই’ বা ঘটনার পরম্পরা একেবারে পরের পর সাজিয়ে ‘হকিকৎ’ বা নিখাদ বাস্তব বৃত্তান্ত লেখা তাঁর উদ্দেশ্য নয়।

বরং জীবনে তিনি যে সব মুহূর্তে সত্য-সাধনা করেছেন, সঙ্কটে বারংবার দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সত্য ও কর্তব্যের পথ অনুসন্ধান করার জন্য হাতড়ে বেড়িয়েছেন, সেই সব পরীক্ষানিরীক্ষা, হাতড়ে বেড়ানোর বিবৃতিই আত্মকথাতে আছে। তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি’ এক সত্যান্বেষীর আত্মসমীক্ষা, নিয়ত নিজেকে যাচাই করার অকপট ব্যাখ্যা, বস্তুজীবনের ঘটনাভিত্তিক ইতিহাস নয়। তিনি গণপরিসরের লোক, গণপরিসরেই তাঁর সব দৌর্বল্য ও দ্বিধার বিবৃতি থাকা উচিত, লুকোছাপার দরকার নেই। গাঁধীর গুজরাতি রচনা ও গাঁধীর নজরদারিতে দেশাই-এর ইংরেজি অনুবাদের নিপুণ টানাপড়েনে গোত্র দ্বন্দ্বটি নজর এড়ায় না, ওই দ্বন্দ্বে শব্দ অনুপুঙ্খে ও ছোট ছোট যোজনার খেলায় অনুচ্চারিত বিধেয়গুলি পাঠকের চোখে ধরা পড়ে।

১২ মার্চ ১৯৩০। একটি তারিখ। সে দিন গাঁধী সবরমতি আশ্রম থেকে সমুদ্রতীরস্থ ডান্ডির দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সে দিনই একটি বই ছেপে বেরোল, গুজরাতিতে গাঁধীর করা গীতার অনুবাদ, নাম ‘অনাসক্তি যোগ’। যাত্রার পিছনে ভালমতোই প্রস্তুতি ছিল, অনুবাদের পিছনেও প্রস্তুতির পর্বকালও দীর্ঘ। ১৯২২-এ জেলে থাকার সময় গাঁধী গীতার শব্দার্থের সূচি তৈরি করেছেন, গুজরাতিতে লেখা ‘গীতা পদার্থকোষ’ ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৬ থেকে আশ্রমে প্রত্যেক দিন গাঁধী গীতা থেকে স্বনির্বাচিত কোনও না কোনও শ্লোকের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিতেন, পরে নোটভিত্তিক সঙ্কলন বেরোয় ‘গান্ধিজিনু গীতাশিক্ষণ’, ইংরেজিতেও অনূদিত হয়। এই পর্বেই গাঁধীর আত্মকথা ‘নবজীবন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। পাশাপাশি গীতার অনুবাদের লিখিত রূপ, নির্বাচিত শ্লোকের টীকা সমেত ‘অনাসক্তি যোগ’-এর পাণ্ডুলিপিও পুস্তক আকারে ছাপা হয়। তাতেই কাজের শেষ হয়নি। অনুবাদটি পড়ার পর অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ইয়েরওয়াড়া জেলে বন্দি অনুবাদক গাঁধী সেই সব সন্দেহ নিরসন করার চেষ্টা করেছিলেন, ‘গীতাবোধ’ নামে পত্রসঙ্কলনে তাঁর উত্তর সন্নিবেশিত রয়েছে।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে গীতার অনুবাদ, অন্বয় ও ব্যাখ্যার সমৃদ্ধ ভান্ডার আছে। শঙ্করাচার্য ও রামানুজের বাদী প্রতিবাদী অন্বয় ও ভাষ্য, বা সন্ত জ্ঞানেশ্বর-এর রচনা ভারতীয় দর্শন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ঔপনিবেশিক ভারতে বঙ্কিমচন্দ্র, তিলক ও অরবিন্দ নিজেদের চিন্তানুযায়ী গীতার শ্লোকার্থ ও টীকা রচনা করেছেন, গাঁধীশিষ্য বিনোবা ভাবে-ও পিছিয়ে থাকেননি। নতুন জাতীয়তাবাদের তাগিদে ধর্মতত্ত্ব তৈরি করা আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ওই রচনা পরম্পরায় গাঁধীর ‘অনাসক্তি যোগ’ দলছুট। কুলযুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্যে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই, কৃষ্ণের অবতারতত্ত্বেও তাঁর আস্থা নেই। ফলে গীতার্থে যুদ্ধ প্রণোদনাকে তিনি বাতিল করেছেন। তাঁর চোখে গীতা মানবজীবনের কাব্যময় রূপক। রূপকের খোলসের মধ্যে আবদ্ধ গীতার ব্যঞ্জিত মর্মকে বুঝে অন্যকে জানানোই গুজরাতি অনুবাদকের কাজ। গীতায় উক্ত ‘যজ্ঞ’ শব্দ গাঁধীর বড় প্রিয়, নির্বিকারে লোকহিতে আত্মোৎসর্গ, স্বেচ্ছায় আত্মযন্ত্রণা বরণ করা, দৃষ্টান্ত জিশুখ্রিস্টের জীবন। গাঁধীর গুজরাতিতে কৃষ্ণ সত্য-নারায়ণ-এর প্রকার মাত্র। সব হৃদয়ে তিনি স্থিত, অন্তঃস্থিত জাগ্রত সত্য-এর নির্দেশ অনুসারে জীবনপথে স্থির থাকলে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিমার্গের আপাত-বিরোধের অবসান হয়। হৃদি স্থিত নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাই স্থিতপ্রজ্ঞ হওয়া, সেই কর্ম সূত্রেই ব্যক্তি সত্যের কাছে আবদ্ধ। কর্ম অর্থ সেবা, সেবাই যজ্ঞ, যজ্ঞের বোধই জ্ঞান, অহিংস ডান্ডি যাত্রা সেই নির্দেশিত বোধের ফল। ভাষান্তরেই গাঁধীর মতো অনুবাদকের কাজ শেষ হয় না। প্রোক্ত সত্যবোধকে জীবন চর্চা ও চর্যায় প্রয়োগ করা ও অনুশীলন করাই যথার্থ অনুবাদ, স্থিতপ্রজ্ঞের অনাসক্তি যোগ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি বিচরণক্ষম, সন্তের ধর্ম ও রাজনীতির ধর্ম দুটিই তো অনাসক্ত ভাবে পালনীয়। মহাত্মার কাছে রাজনীতি অচ্ছুৎ নয়, বরং সত্যের প্রয়োগক্ষেত্র। কোনও লোকক্ষেত্রই বর্জনীয় নয়, বরং কলুষতায় তো সত্য-নারায়ণের স্বভাব-ঔজ্জ্বল্য ধরা পড়ে।

সত্যনা প্রয়োগ। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৪৬, দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালির শ্রীরামপুর। গুহবাড়ির ধ্বংসস্তূপ দেখে গাঁধী বিচলিত হলেন, প্রার্থনাসভায় স্বীকার করলেন দাঙ্গার বীভৎসতায় তিনি ক্রুদ্ধ, রাতে ঘুম হচ্ছে না, স্থিতপ্রজ্ঞের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটছে। তাঁর অহিংসা নীতি প্রয়োগের পদ্ধতিতে কি কোনও ত্রুটি আছে, তাই অমোঘ যন্ত্র কাজ করছে না? উত্তরটা খুঁজে বার করতেই হবে, অন্বেষণের, বোঝা ও বোঝানোর তো শেষ নেই। কোরানের ব্যাখ্যা করছেন, মৌলবিরা ক্রুদ্ধ হচ্ছে। প্রার্থনাসভায় সহজ অনুবাদ করে বলছেন যে ‘আল্লাহো আকবর’ অর্থ ‘ঈশ্বর মহান’, তবুও জেহাদি জিগির হিসাবে অপব্যবহার কেন? ‘পাকিস্তান’ অর্থ তো ‘পবিত্র স্থান’, সবার সম অধিকার থাকা উচিত, তবুও নিঃসীম শঙ্কা কেন? কোনও অনুবাদ ও ভাষ্যে ভবি ভুলছে না। প্রতিশোধী বীভৎস দাঙ্গার খবর বিহার থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ভারত ভাগ হতে চলেছে। গাঁধী প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন যে অম্বেডকর বা জিন্না নন, এখন তাঁর কাছের লোকদেরই তিনি সত্যের নির্দেশ শোনাতে পাচ্ছেন না। অনুবাদক ব্যর্থ হচ্ছেন, সত্য ও কর্মের সব সেতু যেন ভেঙে পড়ছে। সঙ্কটে গাঁধী যেন অন্তর্যামীর নির্দেশ চাইছেন, রাত্রিতে তাঁর একান্ত জিজ্ঞাসা নির্মলকুমার বসু শুনতে পাচ্ছেন, ‘কেয়া করুঁ?’

সত্যনা প্রয়োগ। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। সকালে উঠেই গাঁধী সব জরুরি চিঠির উত্তর দেওয়া তাড়াতাড়ি শেষ করলেন, কেন যেন মনে হচ্ছে যে আগামী কাল আর দেখতে পাবেন না। বিকেল পাঁচটায় গাঁধী প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার সময় তিনটে বুলেটে বিদ্ধ হলেন, শেষ স্বর শোনা গেল ‘হা রাম’। ইষ্ট নাম, সত্য নাম। গাঁধী জানতেন যে সত্যকে বোঝা ও বোঝানোর দায় তাঁর, মননচর্চা ও কর্মে নিজস্ব সত্যবোধকে অনুবাদ করার মূল্য তাঁকে দিতেই হবে। গাঁধী প্রস্তুত ছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahatma Gandhi মহাত্মা গাঁধী
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE