Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

লেখক শুধু লেখে না, জীবনও বাঁচায়

মিথ্যে মামলা সাজিয়ে নির্দোষ এক ইহুদিকে ফাঁসিয়েছিল পুলিশ ও আদালত। প্রখর যুক্তি ও মগজাস্ত্রে তাকে মুক্ত করলেন এক লেখক।মিথ্যে মামলা সাজিয়ে নির্দোষ এক ইহুদিকে ফাঁসিয়েছিল পুলিশ ও আদালত। প্রখর যুক্তি ও মগজাস্ত্রে তাকে মুক্ত করলেন এক লেখক।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সেও ছিল এক শীতের সকাল। ক্রিসমাস আসেনি তখনও, উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহর। তারই মধ্যে এল হাড়হিম খবরটা। খুন! শহরের এক অভিজাত ফ্ল্যাটে! বিরাশি বছরের বৃদ্ধা মারিয়ন গিলক্রিস্টকে কে খুন করেছে তাঁর বাড়িতেই। খুনের বীভৎসতা দেখে শিউরে উঠল পুলিশও। হাতুড়ির মতো কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মুহুর্মুহু। এত বার, এমন তীব্র আক্রোশে মারা হয়েছে, অটপ্সির জন্য তোলা ফোটোগ্রাফ দেখে বোঝা যাচ্ছে না, ওটা একটা মানুষের মুখ ছিল!

বৃদ্ধা রীতিমতো ধনী ছিলেন। বিস্তর টাকাপয়সা, অলঙ্কার ছিল ঘরে। পরিচারিকাটি খুঁজেপেতে পুলিশকে জানাল, একটা মহার্ঘ ব্রোচ গায়েব। কাস্তে আকারের চাঁদের মতো দেখতে, ধার বরাবর এক সারি হীরে বসানো! ১৯০৮ সালে, আজ থেকে ১১১ বছর আগে ওই খাঁটি জিনিস চুরি যাওয়ার অর্থ পরিষ্কার। ওটা বাগানোর জন্যই হত্যা করা হয়েছে হতভাগ্য অশীতিপরকে। কিন্তু, খুনি কে?

আহাহা, যেন জানো না! এ আবার মুখে বলে দিতে হয় না কি? কিছু দিন আগেই শহরে এসেছে এক বিদেশি। এই ঠান্ডার দেশের, ফ্যাকাশে গোলাপিরঙা স্কটিশদের ভিড়ে একেবারে বেমানান এক জন। কালো চুল, গোঁফ। ব্যাটা জার্মান ইহুদি, ছ্যা ছ্যা! আর চরিত্র? না বলাই ভাল। জুয়ার ঠেকে, সস্তা সহজলভ্য বিনোদনের জায়গাগুলোতে ঘোরে-ফেরে। নিষিদ্ধপল্লিতেও যায় নিশ্চয়ই! এ সব চোরছ্যাঁচোড় না হয়ে যায়? তক্কে তক্কে থাকো, নজর রাখো!

আর নজর রাখতেই, দেখাও গেল, অস্কার স্লেটার নামের এই পরদেশিও একটা ব্রোচ বন্ধক রেখেছে শহরের এক দোকানে! আর যায় কোথা। পরিচারিকা, অন্য লোক সাক্ষী দিল, এই লোকটাই চোর। এ-ই খুনি! পুলিশ পিছু নিল। লোকটা আমেরিকা গিয়েছিল, সেখানে পর্যন্ত ধাওয়া করে, ধরে আনল স্কটল্যান্ডে। অতঃপর হাজত এবং আদালত। সেখানেও বিচারপর্ব অতি সংক্ষিপ্ত এবং সক্রিয়। ব্রোচের লোভ+হত্যার পাপ= দুয়ে দুয়ে চার, মৃত্যুদণ্ড! ফাঁসিই হত অস্কারের, দ্বিধাবিভক্ত নাগরিকদের একাংশ সইসাবুদ জোগাড় করে রাজার কাছে পাঠাল, রাজা শেষ মুহূর্তে তাকে আজীবন (কুড়ি বছর) কারাদণ্ডে পাঠালেন পিটারহেড-এর অতিকায়, খাঁ-খাঁ এক দুর্গ-কারাগারে। ক্যালেন্ডারে তখন ১৯০৯ সাল।

এক, দুই, তিন, ছয়, নয়-নয় করে আঠেরোটা বছর চলে গেল পাথরের চাঁই ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো রুটি আর বিস্বাদ ঝোল খেয়ে। ১৯২৭ সালের এক দিন, হঠাৎই দরজা খুলে গেল সেল-এর। অস্কার স্লেটার, তুমি মুক্ত! কেন? কী করে? এক সাহেব ওর ‘কেস’টা হাতে নিয়েছিলেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জেলের বাইরে অস্কারের আইনজীবীকে। তাতেই এসেছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি! তবে হ্যাঁ, বছর দুয়েক আগে অস্কার নিজেও জেল থেকে লুকিয়ে পাঠিয়েছিল এসওএস, ওই সাহেবকেই। প্যারোলে ছাড়া-পাওয়া এক সহবন্দির নকল দাঁতের ফাঁকে গোঁজা কুচি কাগজে লিখে দিয়েছিল, আমি নির্দোষ, দয়া করে বাঁচান আমাকে!

সাহেব মস্ত লেখক, ওঁর বই বাজারে বিকোয় হুহু। ওঁর কাহিনির নায়কের বুদ্ধি ক্ষুরধার, পর্যবেক্ষণ নিখুঁত, যুক্তিবোধ অতুলন। তাই বহু মানুষই সাহেবকে অনুরোধ করেন, আমার পরিবারে অমুক হারিয়ে গেছে, তমুক মারা গেছে; আসল রহস্যটা কী, একটু দেখবেন? অস্কার জেলে যাওয়ার দু-তিন বছরের মাথাতেই সাহেব এই কেসটা নিয়ে লেগে পড়েছিলেন। সাক্ষ্যপ্রমাণ, পুলিশ রিপোর্ট, নথিপত্র-ভর্তি ফাইল ঘেঁটে জলদি বুঝেও যান, গোটা কেসটাই সাজানো। নিয্যস অবিচার হয়েছে অস্কারের উপর। চুরি-যাওয়া ব্রোচ আর অস্কারের বন্ধকি ব্রোচ এক নয়, একেবারে আলাদা। অস্কারের ব্যাগে পাওয়া নিরিমিষ হাতুড়ি দিয়ে ও রকম আঘাত করা যাবেই না, বলেছিলেন এক ডাক্তার— তাঁকে সাক্ষী হিসেবে রাখাই হয়নি! সাক্ষ্য পাল্টানো হয়েছে, প্রমাণ চেপে যাওয়া হয়েছে, সত্যকথনের শপথ নিয়েও মিথ্যে বলা হয়েছে আদালতে— স্রেফ অস্কারকে ফাঁসাতে। পুলিশ, সরকারপক্ষের আইনজীবী সব জানত, জেনেও একটা নির্দোষ লোককে শুধু কাঠগড়াতেই তোলেনি, আদালতকে প্রভাবিত করে তাকে প্রাণে মেরে দিচ্ছিল! আর এত সব কিছুই— অস্কার স্লেটার আন-দেশের, ভিন্‌-ধর্মের লোক বলে! ইহুদি বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, তা বলে জাতিবিদ্বেষ থেমে থাকবে কেন? বেজাত, বিধর্মী লোক ভয়ের কারণ, এই ধুয়ো তোলা সমষ্টির পক্ষে অতি সহজ। আর পুলিশ বা বিচারব্যবস্থা তাতে পোঁ ধরলে তো পোয়াবারো! মার ওকে। চুরি, ডাকাতি, খুনের কেস সাজা। জেলে ভর। ফাঁসি দে। পরিস্থিতিটা চেনা লাগছে? একুশ শতকেও তো এই ঘটনা অহরহ!

অস্কার স্লেটারও মরেই যেত। তাঁকে বাঁচালেন সেই সাহেব। তিনি পুলিশ নন, গোয়েন্দা নন, বিচারকও না। কিন্তু মানুষটার বড় একটা মন ছিল। গরিবদুঃখী, বা অবিচারের শিকার মানুষের দুঃখে যে মনটা দ্রব হত। আর ছিল তাঁর গোয়েন্দা-কাহিনির নায়কের মতোই, খর বুদ্ধি-যুক্তিতে শক্তিমান মগজাস্ত্র। এহেন মন আর মাথাই এক হয়ে, বাঁচিয়েছিল অস্কারকে।

সাহেবের নামটা যে ‘স্যর আর্থার কোনান ডয়েল’, এর পরেও সেটা বলে দিতে হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE