Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

দরকারে পাঠিয়ে দাও জেলখানায়, বিচ্ছিন্ন করে দাও অসমিয়া-চিনাদের পরিবারগুলিকে

চিন-ভারত যুদ্ধের পর অসমের চা বাগানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করা অসমিয়া-চিনাদের অবস্থা ছিল এ রকমই! দরকারে পাঠিয়ে দাও জেলখানায়। বিচ্ছিন্ন করে দাও পরিবারগুলিকে। চিন-ভারত যুদ্ধের পর অসমের চা বাগানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করা অসমিয়া-চিনাদের অবস্থা ছিল এ রকমই!

তিনসুকিয়া হোক বা হংকং—অত্যাচারিত, বিতাড়িত ‘অসমিয়া চিনা’ সমাজের বুকে ক্ষতটা এখনও দগদগে।

তিনসুকিয়া হোক বা হংকং—অত্যাচারিত, বিতাড়িত ‘অসমিয়া চিনা’ সমাজের বুকে ক্ষতটা এখনও দগদগে।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০২
Share: Save:

আয়া কিঁউ? কেয়া হোগা বোলকে? কিও আহিলে ইমান দিনর পিছত? কি লাগে? কেন এসেছ এত দিন পরে? কী দরকার? কী হবে এখন আর ওই সব কথা তুলে?

বুকভরা অবিশ্বাস আর চোখভরা সন্দেহের সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় বোধ করেন অসম থেকে যাওয়া লেখিকা। তিনসুকিয়া হোক বা হংকং—অত্যাচারিত, বিতাড়িত ‘অসমিয়া চিনা’ সমাজের বুকে ক্ষতটা এখনও দগদগে। ঘা শুকোবে কী করে? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, মানবতাবাদের ধ্বজাধারী দেশ যে ভাবে ছারখার করে দিয়েছে তাঁদের পরিবার, তাঁদের জীবন— সেই ক্ষতে মলম লাগানোর চেষ্টাটুকুও তো করেনি কেউ।

৫৬ বছরে অনেক জল বয়ে গিয়েছে ব্রহ্মপুত্র আর হোয়াংহো বেয়ে। কিন্তু আজও লেখক বা সাংবাদিকদের সামনে সেই সব দিনের কথা বলতে চান না লাইলিন, প্রমীলা, হোং হোইরা। কারণ, তাঁদের দৃঢ় ধারণা, এখনও ভারতীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহের নজর তাঁদের ঘিরে রয়েছে। এত পুরুষের বসবাস আর এত দিনের অপমানের অগ্নিপরীক্ষার পরেও শুদ্ধ ভারতীয় হয়ে পারেননি অসমের চিনারা। আবার এ দেশ থেকে বিতাড়িত চিনা পরিবারগুলিও ‘পিতৃভূমি’তে ফিরে পাননি ‘খাঁটি চৈনিক’-এর স্বীকৃতি।

হ্যাঁ, পিতৃভূমিই। কারণ, মাকামের চিনা বাসিন্দাদের কাছে, এবং সেখান থেকে বিতাড়িত ও বর্তমানে চিন বা বিশ্বের অন্যত্র থিতু হওয়া ‘অসমিয়া চিনা’দের কাছে তিনসুকিয়া তথা অসমই হল আদি ‘জনম জাগাহ’। জন্মস্থান বা মাতৃভূমি। শত লাঞ্ছনার পরেও সেই পরিচয় বুকের গভীরে সযত্নে লালন করে চলেছেন তাঁরা।

‘জনম জাগাহ’ কথাটা তো মোটেই চিনা হতে পারে না। হবেই বা কী করে? সেই উনিশ শতকের প্রথম দিকে চিনের দরিদ্র পেনাং, মাকাও প্রদেশ থেকে সোনালী ভবিষ্যৎ আর অঢেল উপার্জনের মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে আনা মানুষগুলোর বংশধরেরা তো চিনা কম, ‘বাগানিয়া’ই বেশি হয়ে গিয়েছিলেন। অসম তথা ভারতে চা চাষের ইতিহাসের পিছনে নীরবে পড়ে আছে চিনা কুলিদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা আর নিরলস শ্রমের গল্প।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল আর্টিলারি ইউনিটের মেজর রবার্ট ব্রুস অসম-অরুণাচল (তখন অবশ্য সেই বিভাজন ছিল না) সীমানায় সিংফো রাজত্বে যে ‘ফালাপ’ পানীয় চেখে দেখেছিলেন, তা যে খাঁটি চা, সেই নিয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু কর্তাদের কাছে সেই কথা প্রমাণ করতে তাঁকে বিস্তর বেগ পেতে হয়। সেনা-জীবন ছেড়ে চা উৎপাদনে মন দেন রবার্ট। তিনি বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু তাঁর দেখানো পথে অসমে চা উৎপাদন রমরমিয়ে শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষ চা চাষের অ-আ-ক-খ জানে না। তাই ইংরেজরা চিন দেশের স্থানীয় দালালদের কাজে লাগিয়ে, বিরাট বিরাট চিনা ‘জাঙ্ক’ জাহাজের খোল ভর্তি করে চা চাষে দক্ষ ‘কুলি’ চিন থেকে ভারতে আনতে থাকল। তাদের সঙ্গেই এল কাগজ আর কাঠ তৈরিতে দক্ষ কারিগরেরাও। এদের একাংশ চলে যান উত্তরবঙ্গের দিকে। অন্যরা উজানি অসমে।

স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি। কিন্তু ফেরার পথ ছিল না। তাই ইংরেজ মালিকদের অধীনে অসমের বাগানগুলিতেই থেকে গিয়েছিলেন চিনারা। চিনাদের সচরাচর ঘাঁটাতে চাইতেন না সাহেবরা। পরবর্তী কালে চিনা শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে ভারতের আদিবাসীদের ধরে আনা হয় বাগানে কাজ করার জন্য। বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর সম্মেলনে তৈরি হয় অসমের ‘বাগানিয়া’ বা চা জনগোষ্ঠী।

তত দিনে চিনাদের অনেকেই স্থানীয় অসমিয়া মেয়ে, বাগানিয়া সাঁওতাল মেয়েদের বিয়ে করেন। বদলাতে থাকে উত্তরপুরুষদের চেহারা, ভাষা। চিনা ভাষার চর্চা, বিভিন্ন আচার পালন করতে থাকেন চিনাপট্টির মানুষরা। কিন্তু দেড় শতক পার করে তাঁরা হয়ে ওঠেন ‘অসমিয়া চিনা’। সে প্রায় নতুন এক জনগোষ্ঠী। যাঁদের পরনে অসমিয়া মেখলা-চাদর। মুখে বাগানিয়া ভাষা, অসমিয়া ভাষা আর ভাঙা হিন্দি। খেটে খাওয়া, দক্ষ কারিগর চিনারা দ্রুত নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। অনেকেই ব্যবসা গড়ে তোলেন। উজানি অসমে ছড়িয়ে থাকা অসমিয়া চিনাদের সবচেয়ে বড় আবাস ছিল তিনসুকিয়া জেলার মাকাম চিনাপট্টি। চিনা ক্লাব, চিনা স্কুল, চিনা রেস্তঁরা, চিনা দোকানপাট— সব মিলিয়ে একেবারে অসমের ‘চায়না টাউন’। আর ছিল ক্লাব ফুটবল। ফুটবল প্রতিযোগিতা নিয়ে উন্মাদনা চরমে উঠত। ক্যান্টনিজ় ভাষায় ‘মাকাম’ শব্দের অর্থ ‘সোনালি ঘোড়া’। অসমিয়া চিনাদেরও সে ছিল স্বর্ণযুগ। আদি দেশ থেকে বহু দূরে, সেই নিশ্চিন্ত বসতিতে স্থানীয় মানুষজনের বন্ধুত্ব, সাহচর্য, আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘আন্ডাবাচ্চা নিয়ে গুষ্টিসুখ উপভোগ করা’ চিনারা ভাবতেও পারেননি, ১৯৬২ সাল তাঁদের জীবনে কী আঘাত হানতে চলেছে।

সীমান্ত নিয়ে অসন্তোষ আগেও ছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালের ৩০ মার্চ চতুর্দশ দলাই লামা তিব্বতের প্রাসাদে চিনা আক্রমণের জেরে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই কার্যত রণদামামা বাজতে শুরু করে। ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে অস্বীকার করে, তিব্বতের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, তাওয়াংকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করে চিন যখন অস্ত্রে শান দিচ্ছে, তখনও উজানি অসমের বাগান ও চিনাপট্টিগুলিতে বাস করা চিনারা সে সবের কোনও খবরই রাখেননি। অনেকেই লেখাপড়া জানেন না। বাইরের খবরও তেমন আসে না মাকামে। কোথায় তিব্বত, কোথায় তাওয়াং, কোথায় তেজপুর, তার হদিসই রাখেন না তাঁরা। এটাও খেয়াল নেই যে সঙ্গে থাকা কুয়োমিনতাং পাসপোর্টগুলোর বৈধতা ফুরিয়েছে। অনেকের কাছে তো সেই পাসপোর্টও নেই। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা ‘স্টেটলেস’। চিনা বাহিনী তাওয়াং আক্রমণ করার পরেও শান্ত মাকামে ঘুম ভাঙেনি তেমন। রেডিয়োয় পণ্ডিত নেহরুর আশ্বাসবাণী শুনেই তাঁরা নিশ্চিন্ত।

কিন্তু চিনা বাহিনী যত এগিয়ে আসে, চারপাশের চেনা মুখগুলোও কেমন বদলে যেতে থাকে। ভারতের প্রতিরোধের খড়কুটো উড়িয়ে দেয় চিন। পিতৃভূমির এমন কাণ্ডে লজ্জিত, মর্মাহত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষগুলো আগ বাড়িয়ে সভা-সমিতি করে চিনের নিন্দায় সরব হন। কিন্তু তাতে মুখ বাঁচে না। এত দিনের বন্ধুরা, আত্মীয়রা অসমিয়া চিনাদের পরিচিতি থেকে ‘অসমিয়া’ অংশটি ছেঁটে দেন তীব্র ঘৃণায়। যে চিনা দোকানে বসত আড্ডা, যে চিনা ক্লাবে চলত গান-বাজনা, যে চিনা লাইনে চলত প্রেমের খুনসুটি, সেই সব চিনা এলাকায় পড়তে থাকে ঘেন্নার পাথর। বেরোয় চিনবিরোধী মিছিল। চেনামুখের বদল দেখে হতবাক মাকামের চিনাপট্টি। তাঁরা অনুভব করেন, গুপ্তচর সন্দেহে জোড়ায়-জোড়ায় চোখ তাঁদের উপরে নজর রাখছে।

কিন্তু কার চরবৃত্তি করবেন তাঁরা? কোন খবর জোগাড় করবেন? দেবেনই বা কাদের? কিছুই স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের অজানা নয়। কিন্তু ‘উপরের নির্দেশ’ আসে শত্রুপক্ষের লোক চিনাদের নজরবন্দি করার। পুরোপুরি বন্দি হতেও বেশি দিন লাগেনি। হঠাৎ করেই ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ল পুলিশ। সকলকে জড়ো করে, তিন-চার দিনের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ নিয়ে যাওয়া হল। সেই ‘তিন-চার দিন’ ভাগ্যবানদের ক্ষেত্রে তিন-চার বছরে শেষ হয়। বাকিরা আর কোনও দিনই নিজভূমে ফিরতে পারেননি। চা বাগানের চিনা কুলিদের এ ভাবে গ্রেফতার করার সময় ইউরোপীয় মালিক, ম্যানেজাররা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সামনে মেলে ধরা হয় ভারত সরকারের জরুরি অবস্থার নির্দেশনামা। যা কিছু হচ্ছে, সবই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে!

পুলিশেরও হল জ্বালা। তত দিনে মাকামের মিশ্রিত সমাজে চেহারা দেখে চিনা-অসমিয়া ভেদ করা সম্ভব ছিল না। ভাষাতেও নয়। তাই গুপ্তচরদের খবরকে ভিত্তি করে পরিবার ধরে ধরে দুই-তিন পুরুষ ধরে মাকামে বসবাসকারী চিনাদের একজোট করা হল। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন চিনা স্বামীর অসমিয়া স্ত্রী, বা অসমিয়া ছেলের চিনা বউ। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শ’য়ে শ’য়ে পরিবার। প্রথমে মুরলী গোলার গুদামঘর, পরে ডিব্রুগড় জেলে ‘নিরাপদ আশ্রয়’-এ ঠাঁই হল তাঁদের। অনেককে নিয়ে যাওয়া হল নগাঁও জেলে। এর পর উত্তরবঙ্গ ও অসমে বন্দি চিনাদের মালগাড়ির বন্ধ কামরায় ঠেসে দিয়ে রাজস্থানের দেওলিতে পাঠানো হল। সাত দিনের সেই কষ্টকর যাত্রাপথে বন্ধ কামরায় থাকা শিশু, গর্ভবতী মহিলা, বৃদ্ধদের অবস্থা শোচনীয় হয়। মানবাধিকারের বালাই ছিল না। মেলেনি খাওয়ার জল। ট্রেনেই মারা যান অনেকে। গোটা যাত্রাপথে ট্রাক হোক বা ট্রেন, যেখানেই ভারতের মানুষ চিনাদের দেখতে পেয়েছে, ছুড়েছে ইট, বোতল, জুতো। কোনও দোষ না করেও মিলেছে অশ্রাব্য গালিগালাজ।

খবর পেয়ে চিন সরকার বন্দি চিনাদের দেশে ফেরত আনতে কয়েকটি জাহাজ পাঠায়। ফলে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলি আরও এক বার, আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তত দিনে বিভিন্ন জেলে ছড়িয়ে পড়েছে চিনা ও অসমিয়া পরিবারগুলি। অনেকেরই স্বামী বা স্ত্রী চিনের জাহাজে উঠলেন। সন্তান পড়ে থাকল ভারতে। ভারতীয় জেলে বন্দি থাকা চিনা পরিবারের অনেক ভারতীয় সদস্যও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় চিনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আবার অনেকের অসমিয়া স্ত্রী স্বভূম ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে চিনে পাড়ি দিতে রাজি হলেন না। অনেকে আবার জানতেও পারলেন না, তাঁদের স্বজন চিনের জাহাজে চড়েছেন। সিংহভাগ পরিবার আর কোনও দিন জোড়া লাগেনি। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীরও আর দেখা হয়নি।

যুদ্ধ শেষ হয়। অনেক আবেদন-নিবেদনের পরে কারামুক্তিও ঘটে। কিন্তু কপালে সেঁটে থাকা চিনা গুপ্তচরের অপবাদ মিটতে চায় না। তিনসুকিয়া ফিরে চিনা পরিবারগুলি দেখে, তাঁদের বাড়ি, ব্যবসা সব বেহাত হয়ে গিয়েছে। লুঠ হয়ে গিয়েছে সব সম্পত্তি। এমনকি, সীমান্ত যুদ্ধে নাস্তানাবুদ, বিধ্বস্ত, পরাজয়ের দগদগে ঘা নিয়ে ফেরা ক্ষিপ্ত ‘অসম রাইফেলস’-এর জওয়ানরাও চিনা মহল্লায় দেদার লুঠতরাজ চালান বলে অভিযোগ। মাকামের অন্যতম গর্ব চিনা স্কুল বদলে গিয়ে হয়ে যায় হিন্দি স্কুল। সে সব নাহয় বাইরের নিঃস্বতা। তার চেয়েও বেশি দাগ কাটে যখন ‘পরাজিত ভারত’-এর বাসিন্দা, পুরনো প্রতিবেশী, বন্ধু, প্রেমিকরা কিছুতেই চিনাদের আগের মতো আপন করে নিতে চায় না। শূন্য থেকে ফের শুরু করতে হয় তাঁদের। সুযোগ পেয়েও মাতৃভূমির টানে তাঁরা চিনের জাহাজে ওঠেননি। কিন্তু ‘জনম জাগাহ’-তে ফিরে এসে গুলিয়ে যায় আপন-পরের পরিচয়। নিজভূমে পরবাসীর মতোই থাকতে হয় তাঁদের।

মাকামের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের কথা জানতে পেরে সাহিত্যিক রীতা চৌধুরী যখন তিনসুকিয়া পাড়ি দেন, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সেই সব দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে অনেক প্রবীণ মারা গিয়েছেন। অনেকে চলে গিয়েছেন বাইরে। আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও কিছুতেই মুখ খুলতে চান না। রীতা বলেন, “অসমের তিনসুকিয়া, ডিব্রুগড় হোক, বা দেশত্যাগী হয়ে হংকং বা চিনের অন্যত্র থাকা চিনারাই— সকলেই যেন আমার প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠেন। সিঁদুরে মেঘ দেখেন তাঁরা। মনে পড়ে যায় কালো দিনগুলো। তীব্র বিদ্বেষে প্রশ্ন ছোড়েন, ‘‘কেন এসেছ? কেন এ সব জানতে চাইছ? কী হবে বলে?” তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতের কথা বলতে রাজি হলেও নাম প্রকাশে রাজি হননি।

সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাওয়া লেখিকা রীতা জানান: “মাকামের কথা বিশ্বকে জানাতে চাইছিলাম। কিন্তু কেউ সাহায্য করছিলেন না। খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ইউজিন টাম, আমেং ও টুং চিন এগিয়ে এলেন।” সেই সূত্র ধরেই এগিয়ে চলে ১৯৬২-৬৪ সালের অন্ধকার দিনগুলির দলিল, ‘মাকাম’ উপন্যাস লেখার কাজ। যে উপন্যাসকে কেন্দ্র করে ফের শত্রু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়া সংক্রান্ত আইন সংশোধনীর দাবি ওঠে সংসদে।

মাকামের বিষয়ে গবেষণা এবং রীতাকে হংকংয়ের চিনাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন ইউজিন টাম। বেঙ্গালুরুতে কাজ করার সময়ে আত্মীয়দের কাছ থেকে রীতার ইতিহাস সন্ধানের কথা জানতে পেরেছিলেন টাম। ফেলে আসা অন্ধকার দিনের দস্তাবেজ ঘাঁটতে থাকা লেখিকাকে নিয়ে প্রথমে সন্দিহান ছিলেন তিনিও। পরে সেই দেওয়াল ভাঙে। রীতাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হংকংয়ে যান, যেখানে অসমিয়া চিনাদের সংখ্যা এখন প্রায় ৪০০০।

ভারতে বসে ভারত সরকারের অত্যাচারের দলিল যখন লেখিকার হাতে তুলে দিতে ডরাচ্ছেন মাকামের চিনারা, তখনই টাম রীতাকে নিয়ে যান হংকংয়ের ‘রিটার্নিজ় কলোনি’তে। টাম সেতুবন্ধন না করলে হয়তো সেখানকার চিনাদের গল্প অজানাই থেকে যেত।

এই কলোনির লোকেরা আবার শুরুতে ছিলেন নীরব। পরে জানা যায়, এই অসমিয়া চিনাদেরও চিনে মোটেই সাদরে গ্রহণ করা হয়নি। তার উপরে অনেকের সঙ্গেই ভারতীয় বউ! তাই পিতৃভূমিতেও অবিশ্বাসের সঙ্গেই ঘর করতে হয়েছে তাঁদের। অনেকে আমেরিকা-ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদেরও খুঁজে বের করলেন রীতা। মাকাম তত দিনে তাঁর কাছে শুধুই উপন্যাস নয়, একটা জেদের নাম।

প্রাথমিক জড়তা কাটার পরে হংকংবাসী অসমিয়া চিনাদের অনেকেই ভেঙে পড়েন কান্নায়। ৪৫ বছর পরে ‘জনম জাগাহ’ থেকে আসা রীতাকে কাছে পেয়ে উগরে দিতে থাকেন ক্ষোভ। জানা যায়, সেখানকার মেয়েদের বেশির ভাগই এখনও মেখলা বা শাড়ি পরেন। হিন্দু মতে পুজো করেন। বলেন অসমিয়া ভাষা। গুনগুন করেন বিহুর সুর। পান করেন দুধ-চা। তাঁদের কাছে এখনও নিজের জায়গা বলতে মাকাম, অসম। এখনও প্রতি বছর অসমের স্মৃতিতে বার্ষিক অনুষ্ঠানে একজোট হন অসমিয়া চিনারা। আয়োজন হয় অসমিয়াদের বনভোজন। গল্পে-গানে জীবন্ত হয়ে ওঠে মাকামের চিনাপট্টি। গাওয়া হয় হিন্দি গান, অসমিয়া গান। চালানো হয় হিন্দি সিনেমা। অনেকের ঘরেই অসমিয়া ভিসিডি ও হিন্দি ক্যাসেট সাজানো। রীতা জানান, চিন বা বিদেশে থাকা অসমিয়া চিনাদের গাড়িতেও অসমিয়া গান বাজতে শুনেছেন তিনি। তাঁদের অনেকের মনে এখনও একটি বার জন্মভূমিতে ফেরার বাসনা ঘুমিয়ে আছে।

দীর্ঘ সাধ্যসাধনার পরে মাকামের চিনা পরিবারগুলি যখন মুখ খোলা শুরু করেন, রীতা জানতে পারেন লিঙ্গি লেয়ং চিয়ের কথা। ছোট্ট মেয়েটার তখন মাত্র ছ’বছর বয়স। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সে ছুটিতে দিদিমার বাড়িতে গিয়েছিল। জানতেও পারেনি, গুপ্তচর সন্দেহে চা বাগানের শ্রমিক তার বাবা লেয়ং কোক হোই ও লুসাই উপজাতির মা চানু লেয়ংকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। যত ক্ষণে দিদিমা খবর পেয়ে নাতনিকে নিয়ে স্টেশনে পৌঁছন, ট্রেন দেওলি রওনা হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের ৩০ বছর পরে চিন থেকে বাবার একটিমাত্র চিঠি এসেছিল লিঙ্গির নামে।

২০১৫ সাল। রীতা ও লিঙ্গির মোলাকাত হয়। লিঙ্গি তখন ৫৭ বছর বয়সি প্রমীলা দাস। কিন্তু এখনও বিচ্ছিন্ন বাবা-মা’র জন্য মন কাঁদে তাঁর। তাঁর হয়ে খোঁজ শুরু করেন রীতা। জানা যায়, হংকং থেকে ১০ ঘণ্টার দূরত্বে থাকা লাইবিনে এখনও বেঁচে আছেন প্রমীলা ওরফে লিঙ্গির বৃদ্ধ বাবা-মা। তোড়জোড় শুরু হয় মহামিলনের। রীতা ও তাঁর ভারতীয় এবং চিনা বন্ধুদের সাহায্যে বাবা-মা’র সঙ্গে কথা হয় প্রমীলার। তার পর কলকাতা হয়ে হংকং। সেখান থেকে লাইবিন। ৫৩ বছর পরে দেখা হয় বাবা-মা ও মেয়ের। মেয়ের ব্যাগে তখন বাবার আবদার মতো অসম থেকে নিয়ে যাওয়া বুন্দিয়া ভুজিয়া, ঘটি, বান বাটি আর অসমিয়া ঐতিহ্যের প্রতীক সরাই।

আবার পাল্টা যোগাযোগও ঘটে। রীতার নিরন্তর প্রয়াসের ফলে ২০১৩ সালে ৬০ বছর বয়সি হো ইয়াক্ট মিং ও তাঁর ন’জন সঙ্গী-সঙ্গিনী পাঁচ দশক পরে ফের মাকামে পা রাখেন। জনম জাগাহ-তে আর কোনও দিন পা রাখবেন, ভাবতে পারেননি তাঁরা। অসমে তাঁর নাম ছিল অঞ্জলি গোয়ালা। এখনও অসমিয়া ও হিন্দি বলতে পারেন অঞ্জলি ওরফে হো মিং। বাবা ছিলেন কাঠের মিস্ত্রি। ছোটবেলায় লক্ষ্য, ভুদা, সুজি, কালু, জয়লালের মতো বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা তাঁর স্মৃতিতে সজীব। পুরনো পাড়া ঘুরে, পুরনো মানুষদের সঙ্গে দেখা করে চোখের জল বাধ মানে না কারও। পুনর্মিলনে একজোট হয় মাকামের নবীন-প্রবীণ প্রজন্ম। অঞ্জলি জানান, যখন পুলিশ তাঁদের গোটা পরিবারকে গ্রেফতার করে, মাত্র আট বছর বয়স ছিল তাঁর। দেওলি জেল থেকে তাঁদের মাদ্রাজ নিয়ে গিয়ে চিনের জাহাজে তোলা হয়েছিল। হংকংয়ে এখনও বাগানিয়া হিন্দিই তাঁদের কথা বলার ভাষা।

শিলঘাটের স্থানীয় অসমিয়া মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন তিং সাম চই। তাঁদের ছয় পুত্র ও তিন কন্যা হয়। ছেলেদের পড়তে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন তিং। ফিরে সকলেই স্থানীয় বাগানে কাজ নেয়। যুদ্ধের সময় গোটা পরিবারকে গ্রেফতার করে দেওলিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে চিন।

অবশ্য কপাল ভাল হো কক মেংয়ের। অসমিয়া স্ত্রী রত্না বরা ও দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁর। চালাতেন গ্যারাজ। যুদ্ধের সময় বন্দি হয়ে দেওলি গেলেও পরে সকলেই তিনসুকিয়ায় ফিরতে পেরেছিলেন।

শিবসাগরের রাসমণি গোয়ালার সঙ্গে বিয়ে হয় হো কং ওয়ার। তাঁদের আট ছেলেমেয়ে। মাকাম স্কুলে হাতের কাজ ও কুংফু শেখাতেন হো। তাঁদের গ্রেফতার করে চিনে পাঠানো হয়। শিবভক্ত রাসমণি চিনে আমৃত্যু শিবপুজো করেছেন, শাড়ি পরেছেন।

চিনা স্বামীকে বিয়ে করা শিবসাগরের প্রমীলা গগৈ অসমিয়া স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। স্বামী ও সন্তানদের পুলিশ গ্রেফতার করলে তিনিও তাঁদের সঙ্গেই ধরা দেন। মুখে ‘আহোম’ ছাঁদ। তাই আপত্তি করেনি পুলিশ। তাঁদের পাঠানো হয় চিনে। সেখানে পিআরসি সরকার তাঁকে অসমিয়া ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি দেয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মেখলা-চাদর পরেন প্রমীলাদেবী। তাঁরই এক ছেলের বিয়ে হয়েছিল গোলাঘাটের মেয়ের সঙ্গে। ছেলেকে পুলিশ ধরলেও তাঁর স্ত্রী-ছেলেমেয়ে ভারতেই থেকে যায়। ছেলে পরে হংকংয়ে একটি কারখানায় কাজ নেন। কিন্তু মন পড়ে থাকে অসমে। সারা ক্ষণ মনমরা কর্মীকে দেখে মালিক কারণ জানতে চান। উত্তরে তিনি জানান পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কাহিনি। উদারমনা সেই কারখানা-মালিক প্রতিশ্রুতি দেন, গোটা পরিবারকে চিনে আনার ব্যবস্থা করে দেবেন। তত দিনে বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। উৎফুল্ল স্বামী চিঠি পাঠান গোলাঘাটে স্ত্রীর বাড়িতে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা তত দিনে অসমিয়া সমাজ-ভাষা-জীবনযাত্রার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তাই অজানা চিন দেশে বাবার কাছে যেতে চায়নি। এমনকি মা’কেও বাবার কাছে যেতে দেয়নি তাঁরা।

যে থানা অসমিয়া চিনা সমাজে সবচেয়ে বড় খলনায়কের ভূমিকা নিয়েছিল, সেই মাকাম থানার ওসি ফিরদৌস আলি নিজেও কি কোনও দিন ‘চিনা খেদানো’র ধাক্কা মন থেকে মানতে পেরেছেন? যুদ্ধের আগে পর্যন্ত চিনাপট্টির সুখ-দুঃখে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা মানুষটার অ্যালবাম ভরা চিনা পরিবারগুলোর ছবিতে। বাড়ি-ভর্তি চিনাদের দেওয়া উপহার। চিনা পরিবারগুলির উৎসবে সৌম্যদর্শন, হাসিমুখ বড় দারোগার ডাক পড়তই। প্রয়াত ওসির কন্যা সজমিনা বেগম জানান, আব্বার অ্যালবামে বিশেষ করে চোখ টানত এক হাসিমুখ চিনা মেয়ের ছবি। পরে আম্মার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, বাবার সঙ্গে এক বিশেষ প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওই মেয়েটির। কিন্তু যুদ্ধ সব শেষ করে দেয়। পরিবারের সঙ্গে মেয়েটিকেও ধরে পুলিশ। পরে চিনে পাঠানো হয় তাকে। অবশ্য শেষ হয়েও শেষ হয় না কিছু সম্পর্ক। তাই পরবর্তী কালে দুজনেই দুজনের ঠিকানা জোগাড় করেন। সম্পর্কের রেশ টিকে থাকে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে। হংকং থেকে সেই মেয়ে নিজের ছবিও পাঠাতেন। সব ছবি ও চিঠি একটি বাক্সে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন ফিরদৌস। বর্তমানে ডিব্রুগড়ের বাসিন্দা ফিরদৌসের ছেলেমেয়েরা জানান, বেঁচে থাকতে বাবা ওই বাক্সে তাঁদের হাত দিতে দেননি।

অসম শুধু নয়, দেশের ইতিহাসের ওই অনুচ্চারিত অধ্যায়কে লাগাতার অধ্যবসায়ে, এ দেশ-সে দেশ ছুটে বেড়িয়ে, হাল-না-ছাড়া জেদের মাধ্যমে এক সুতোয় গেঁথেছেন রীতা। সে বই পড়তে পড়তে পাঠকের মনেও রাগ ছড়িয়ে পড়ে। এই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে ইতিমধ্যেই তাঁর ব্লগে উচ্ছ্বসিত অমিতাভ ঘোষ। রীতা বলেন, ‘‘বইয়ের মলাটে আর কতটুকু ধরা যায়! অসমিয়া চিনাদের ছারখার হওয়ার পিছনের গল্পকে খুঁড়ে তুলে আনতে গিয়ে যেন ১৯৬২-৬৫ সালের সময়টাকেই যাপন করে এসেছি। সেই রেশ থেকে যায়। ভিতরে এক ক্ষোভ জন্ম নেয়। মনে হয়, এক জন এক জন করে সব অসমিয়াকে গিয়ে বুঝিয়ে আসি— ওঁরা গুপ্তচর ছিলেন না, এখনও নন। সেই সব দিনের প্রায়শ্চিত্ত করা তো আর সম্ভব নয়, ওঁরা যা হারিয়েছেন তা ফিরিয়েও দিতে পারি না আমরা।’’ আরও জানান তিনি, ‘‘এখনও যদি ভারতে বসবাস করা চিনারা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা ফিরে পান, বিতাড়িত অসমিয়া বা ভারতীয় চিনারা গুপ্তচরের তকমা সরিয়ে নিশ্চিন্তে স্বজনদের কাছে, স্বভূমে ফেরার সুযোগ পান, তবেই আমার কষ্ট সার্থক হবে।’’

‘চায়নাটাউন ডেজ়’ নামে ইংরেজিতে সদ্য অনূদিত হয়েছে এই উপন্যাস। অনুবাদক লেখিকা নিজেই। বইটা পড়ে মনে হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে যেন আমাদের মনুষ্যত্ব আর কোনও দিন আচ্ছন্ন না হয়ে পড়ে। কয়েক পুরুষ ধরে এখানে বাস-করা দেশবাসীদের যেন আর ঘরছাড়া না হতে হয়!

পুনশ্চ: সাম্প্রতিক নাগরিকপঞ্জির খসড়া তালিকায় পাঁচ পুরুষ অসমে থাকা ৬২ বছরের ওয়াং হি হুয়া, ৬১ বছরের ওয়াং শিন তুংয়ের নাম নেই। বাদ পড়েছেন তাঁদের ৯১ বছরের মা-ও। তাঁরা এখন ষাটের দশকের সিঁদুরে মেঘ দেখছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam NRC China
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE