Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

তোর জলকে নেমেছি

নৌকোতেই রান্না, খাওয়া, ঘুম। বাকি সময়, এমনকি জীবনের বেশির ভাগটাই সমুদ্রের জলের তলায় কাটে বাজাউ মানুষদের। শিশির রায়নৌকোতেই রান্না, খাওয়া, ঘুম। বাকি সময়, এমনকি জীবনের বেশির ভাগটাই সমুদ্রের জলের তলায় কাটে বাজাউ মানুষদের।

শিকার: সমুদ্রের তলায় মাছ ধরছে বাজাউ শিশু

শিকার: সমুদ্রের তলায় মাছ ধরছে বাজাউ শিশু

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১৯
Share: Save:

বাচ্চাগুলোর কতই বা বয়স? চার-পাঁচ? ওরা নাকি হাঁটতে শেখার আগেও শেখে জলে সাঁতার কাটা, ভাসা, আর সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ— সমুদ্রের গভীরে ডুবে এক দমে অনেকটা সময় ডুবে থাকা! গালগপ্পো নয়, একেবারে পরীক্ষিত সত্য, জলের তলায় আমরা দম নিয়ে যতটা সময় থাকতে পারি, ওরা থাকতে পারে তার অন্তত দু’গুণ!

ওরা ‘বাজাউ’ জনজাতির শিশু। এই নামটা আসলে একটা ছাতার মতো নাম, যার তলায় আছে অনেকগুলো গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের গোষ্ঠীগত নাম আলাদা, উচ্চারণও বহুতর, অনেক ক্ষেত্রে ভাষাও। এরা সবাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাগরজলের বাসিন্দা। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বোর্নিয়ো, তাইল্যান্ড ঘিরে যে জলরাশি, ওরা থাকে সেই জলের উপরে। উপরে বলাটা ভুল হল, জলের উপরে নৌকোয় ওদের সংসারটুকু— হাঁড়িকুড়ি, রান্না, খাওয়া, ঘুম। তা বাদে বাকি সময় বাজাউ ছেলেমেয়ে আর তরুণ-যুবাদের দেখা মিলবে জলের তলায়! যুবকেরা নৌকো থেকে বর্শা ছুড়ে মাছ মারে, খুদেগুলো তারও ধার ধারে না। সটান ডুব (যাকে বলে ‘ফ্রি ডাইভ’) দেয় জলের গভীরে, ২৩০ ফুটেরও বেশি যাওয়া কোনও ব্যাপার নয় ওদের কাছে! কোমরে ছোট্ট একটা পেন্টুল, চোখে জলচশমার মতো একটা জিনিস, দেখার সুবিধের জন্য। এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। বেশ কিছু ক্ষণ পর ভুস করে ভেসে ওঠে নিজেদের নৌকোর কাছে, মা-ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে হিহি হেসে হাত উঁচু করে দেখায়, এই দেখো ধরেছি, অক্টোপাস!

মরুভূমির যাযাবরদের কথা তো জানে অনেকে, বাজাউ-মানুষরা পরিচিত নন তত। ওঁদের অনেকে বলছেন সমুদ্র-যাযাবর, বা সমুদ্র-জিপসি। সুইডেনের এক গবেষক এসেছিলেন ওঁদের কাছে, দেখেছেন, জলের তলায় বাজাউ-শিশুরা দেখতে পায় যেন ঠিক ডলফিনের মতো! বিজ্ঞান-পত্রিকায় লেখালিখিও কম হয়নি এই নিয়ে। ওঁদের শরীরে প্লীহাটা নাকি বিশেষ বিবর্তনে বড় হয়ে গিয়েছে, তাই ডুব দিয়ে অনেক বেশি সময় ওঁরা থাকতে পারেন জলের তলায়। আবার অনেক গবেষক শুধু বলেনইনি, পরীক্ষাও করে দেখিয়েছেন, এটা বাজাউ-মানুষদের অতিমানবিক ক্ষমতা নয়, ওঁদের পরিবেশ-প্রতিবেশে থেকে একই জিনিস ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবে’ অভ্যেস করলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষও তা পারবেন।

নৌকো ছাড়াও, ওঁদের ঘরবাড়িও আছে। সমুদ্র থেকেই খাবার আহরণ, তা বলে নোনা জলটুকু তো খাওয়া যায় না! বাজাউ-মানুষরা তাই বাড়ি বানান কোনও না কোনও দ্বীপের গায়ে, দ্বীপের ভিতরে তো মিষ্টি স্বাদু জলের জোগান থাকবেই কোথাও! লম্বা খুঁটির উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকে ওঁদের ছোট্ট ঘর। বেশির ভাগ সময়েই সেই ঘরে থাকেন দাদুদিদারা। পরিবারের শক্তসমর্থ সদস্যেরা আর শিশু ভোলানাথের দল সব সময় নৌকো আর জল, জল আর নৌকো করে বেড়ায়।

এই জলমানুষদের ইতিহাস শত শত নয়, হাজার হাজার বছর পুরনো। এঁদের পূর্বপুরুষেরা নাকি জলদস্যু ছিলেন, এমন মতও আছে। জীবন ও জীবিকা পাল্টেছে, শুধু পাল্টায়নি জলের সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক। তবে বিশ্বায়িত পৃথিবীতে এই মানুষগুলোর সামনেও এখন বিপদ কম নয়। মাছ ধরার আধুনিকতম সাজসরঞ্জাম আর ‘ডিনামাইট ফিশিং’-এর মতো পদ্ধতির বহুল ব্যবহারে ওঁদের রোজকার রোজগার এখন বিপন্ন। জলই ওঁদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, তবে এখন বাজাউ-শিশুরা ইস্কুলের চকখড়ির শিক্ষাও পাচ্ছে। ‘সভ্য’ সমাজে তো সব কিছুই ‘অ্যাট দ্য কস্ট অব’, সেটাই ভয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bajau Sea বাজাউ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE