Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ছোটগল্প
Short Story

ভেজা তোয়ালে

অদ্রি বুঝিয়েছে। দিয়া আদমের কাছেই আপেল খেতে চেয়েছিল। খেয়েছেও। আর দরকার নেই।

ছবি: মনোজ রায়

ছবি: মনোজ রায়

সাগরিকা রায়
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২২
Share: Save:

বারান্দায় তোয়ালে মেলে রাখা একেবারেই পছন্দ নয় দিয়ার। ও যেন ঘরের কথা বাইরে মেলে দেওয়া। তা ছাড়া, এতে বাড়ির বিউটি নষ্ট হয়। কথাটা ওর নয়। বালিগঞ্জের পিসির। বারান্দায় থাকবে চমৎকার টব। রাজস্থানি দোলনা। ঘাসের কার্পেট। সেখানে ভেজা তোয়ালে থাকবে কেন?

এই কেন-টা মাথায় ঢোকে না অদ্রির। ও বাথরুম থেকে বেরিয়ে সরাসরি বারান্দায় চলে যাবে এবং ভেজা তোয়ালেটা জবুথবু করে ঝুলিয়ে রাখবে। আর তোয়ালেটাও পারে! পোষা বেড়ালের মতো ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকে। দিয়া বলে-বলে আর পারে না। আজ দুপুরেই প্ল্যান করে বারান্দার সরু দু’টো তার খুলে ফেলেছে। না রহেগা বাঁশ, না বাজেগি বাঁসুরি। অদ্রি এই খবরটা জানত না। অগত্যা ভেজা তোয়ালেটা রোজকার মতো ছুড়ে দিল তার লক্ষ্য করে। না তাকিয়েই করেছে অবশ্য। তোয়ালেটা আর্ত চিৎকার করে মেঝেয় ধপাস। চিৎকার কানে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়েছে অদ্রি। তাকিয়ে তোয়ালে দেখতে পায়নি চোখের সমান্তরালে। দেখেছে রাস্তা। রাস্তার সাইডওয়াকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়েছে অদ্রি। তার পর মুচকি হেসে দিয়াকে ডেকেছে। দিয়া চেঞ্জ করছিল। চুলে ব্যান্ড লাগাতে-লাগাতে এসে দাঁড়িয়েছে, ‘‘কী হল?’’ বলেই চমকে উঠেছে, ‘‘এই যে! ফের টাওয়েলটা মেলতে এসেছ বারান্দায়?”

অদ্রি হাসি চিকচিক চোখে আঙুল তুলে দেখাল, ‘‘টাওয়েল ছাড়ো, দেখো ও দিকে... তোমার তোয়ালে কেমন ঝুলে আছে ফুটে।”
দিয়া কিছুটা বুঝেই বিমূঢ় মুখে গলা বাড়িয়েছে। রাস্তার ও পারে ফুটপাতে স্থির দাঁড়িয়ে সুমন। এ দিকেই তাকিয়ে। দেখছে ওদের দু’জনকে।

বিরক্তি ঝরে পড়ল দিয়ার গলায়, ‘‘আচ্ছা, কী বিশ্রী বলো তো! লোকে কী বলবে?’’

“লোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, কে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোমার প্রেমে ডুবছে, সে দিকে নজর রাখবে!” একটু টিটকিরি ছিটিয়ে দিল অদ্রি। দিয়া অদ্রির দিকে রাগত চোখে তাকাল, “আমি বলেছি? দাঁড়িয়ে থাকো, আমাকে দেখো— বলেছি? তোমার বন্ধু, তুমি বলতে পারছ না? বলতে পারছ না যে, তুমি পছন্দ করছ না এ ভাবে আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে ওই লোকটা দাঁড়িয়ে থাকে?’’

‘‘ধুস, কী বলব? পরকীয়ায় মজা আছে, বুঝলে? বন্ধুর বৌ হল দুনিয়ার সেরা সুন্দরী। হা-হা। বুঝলে না? আরে, ও যদি তোমাতে মজে থাকে, আমি কী করতে পারি, বলো?’’ অদ্রি হাসে। আড়ে-আড়ে তাকিয়ে দিয়াকে দেখতে-দেখতে হাসে।
দিয়া ক্ষিপ্ত পায়ে বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। টিভি অন করে সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। চেঁচিয়ে বলে, ‘‘অদ্রি, বারান্দার দরজা বন্ধ করে দাও। আমার জাস্ট অসহ্য লাগছে!’’

দিয়া পছন্দ করে বলে মাঝে-মাঝেই অফিস থেকে ফেরার সময় পাস্তা নিয়ে আসে অদ্রি। আজও এনেছে। কিন্তু মজাটা উবে গিয়েছে যেন। দিয়া ভুরু কুঁচকে একটার পর একটা চ্যানেল পালটে যাচ্ছিল। অদ্রি খেতে-খেতে দিয়াকে লক্ষ করছিল। মুখে কিছু বলছিল না। দিয়ার শার্প চেহারাটা আজ আরও বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। অদ্রি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সুমনের কথা ভাবছিল। দিয়াকে কি ভালবাসে সুমন? বাসে। নইলে দিন-দুপুরে, রোদ মাথায় করে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন ওদের ফ্ল্যাটের সামনে? দিয়ার বিরক্তি অস্বাভাবিক নয়। আজ সুমনকে না দেখালেই ভাল হত। মাঝখান থেকে দিয়ার মুড খারাপ হয়ে গেল। নিজের বুদ্ধির উপর ভরসা চলে যায় কখনও কখনও। কী দরকার ছিল গৃহশান্তি নষ্ট করার! আজকের প্ল্যান ছিল পাস্তা খেতে-খেতে ভাল কোনও মুভি দেখার। সুমন এসে সব খুশিতে জল ঢেলে দিল। সুমন এসেছে, সেটা দিয়াকে ডেকে দেখিয়ে সব গুবলেট করেছে অদ্রি।

“তুমি খাচ্ছ না? ভাল করেনি আজ?” অদ্রি এক টুকরো পাস্তা মুখে পুরছে, দিয়া তাকাল, “কী করা যায় বলো তো? সে দিন তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে দাঁড়িয়ে কী করছিল? গা জ্বলে যায় আমার। লোকটা আমার মৃত্যু না দেখে যাবে না।’’

অদ্রির খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ও সিগারেট আনতে উঠে গেল। দিয়ার সামনে সিগারেট টানা বারণ। পিছনের ছোট বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে সুমনের কথাই ভাবছিল অদ্রি। সুমন দিয়াকে পছন্দ করে। ব্যাপারটা কি সত্যিই একতরফা? দিয়ার তরফ থেকে সামান্য হলেও কি কোনও প্রশ্রয় নেই? নইলে সুমন কেন অদ্রির স্ত্রীর জন্য এমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে? আগে আপেল নিয়ে এসেছে কয়েকবার। কেন? না, দিয়া নাকি আপেল ভালবাসে।
অদ্রি বুঝিয়েছে। দিয়া আদমের কাছেই আপেল খেতে চেয়েছিল। খেয়েছেও। আর দরকার নেই। কিন্তু সুমন বিব্রত মুখে আপেলগুলো নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে রেখেই চলে যাচ্ছিল। অদ্রি পিছন থেকে ডেকে দাঁড় করিয়েছে, “তুই আর এ-সব আনিস না সুমন। আমি জানি দিয়াকে আপেল দিতে এসেছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, দিয়া আপেল খেতে চায় না। পছন্দ করে না। ব্যাপারটা আমি না বলে পারলাম না। প্লিজ়। নিজেকে একটু কন্ট্রোল কর। আর এগুলো নিয়ে যা।”
আপেলগুলো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল সুমন। অদ্রি ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিতে-দিতে গালি দিল, ‘‘নাম। নেমে যা। যত নামতে পারিস, নেমে যা। দিয়া অন্যের বৌ, সেটা মাথায় থাকে না?’’

রাতে ভালবাসাবাসির পর দু’জনে দু’দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু একটা সময় অদ্রি বোঝে, আজ ওর ঘুম হবে না। ফ্যালফেলে চোখ-মুখ নিয়ে সুমন এসে দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে। সুমন কি দিয়ার মনের ভিতরে ঢুকে আছে? বিশ্বাস হয় না দিয়াকে। আজ যখন খুব ভালবাসা হচ্ছিল, তখন কি অদ্রির জায়গায় সুমনকে ভেবেছে দিয়া? এই যে পাশ ফিরে শুয়ে আছে দিয়া, অদ্রির স্ত্রী, সে কি এখন সুমনকে ভাবছে? একান্তে মানুষ নিজেকে মেলে ধরে। পাশ ফিরে শুয়ে অদ্রির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে কাকে ভাবছে অদ্রির বৌ? যদি সুমনকে নিয়ে ভাবে, তা হলে বুঝতে হবে দিয়া পরকীয়ায় মত্ত। এটা কি এক ধরনের পরকীয়া নয়? সুমনও পরকীয়া করছে। ছিঃ! ঘুম যখন এল, তখনও ভুরু কুঁচকে ছিল অদ্রির।

দিয়া মর্নিং ওয়াকে গিয়েছে। অদ্রি ঘুম থেকে উঠে দিয়াকে দেখেনি। আজ মন চটকে আছে। দিয়ার উচিত ছিল ওকে বলে যাওয়া। অদ্রিকে নিয়েও ভোরে হাঁটতে বেরতে পারে দিয়া। আগে বলেছে কয়েকবার। অদ্রি ভোরে উঠতে পারে না বলে দিয়া একাই যায়। সামনের পার্কটা কয়েকবার পাক খেয়ে ফিরে আসে। আজ মনে হল, ওর উচিত ছিল অদ্রিকে জোর করে নিয়ে যাওয়া। কে জানে, দিয়া হয়তো এই সময় সুমনের সঙ্গে দেখা করে! করতেই পারে। একটা মেয়েকে এতটা বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি অদ্রির। কে বলেছিল, মেয়েদের মনে গভীরতা কম। দিয়া তো মেয়েই!

অদ্রি উঠে ওয়াশরুম ঘুরে এসে শার্টের সঙ্গে বারমুডা পরে নিল। জুতো পায়ে দ্রুত হেঁটে পার্কের কাছাকাছি এসে দিয়াকে খুঁজল। দেখা যাচ্ছে না দিয়াকে। গেল কোথায়? মানে ও এখানে আসে, এমনটা নাও হতে পারে! হয়তো অন্য কোথাও যায়! অদ্রি পার্কের পাশের রাস্তাটা দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল। গুচ্ছের মানুষ স্বাস্থ্য উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অনেকে এই সুযোগে প্রেম করছে। বয়স্ক ভদ্রলোক শর্টস আর মেরুন গেঞ্জি পরে চুলে হাইলাইট করে, “হ্যাল্‌লো মিসেস মুখার্জি! কাল ফোন করেছিলাম, রিসিভ করেননি...” বলতে-বলতে মিষ্টি চেহারার মহিলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভোরবেলাটা যেন বার্ধক্যের বারাণসী। এক মহিলা কাকে ফোন করে কী ভাবে দেওরকে ঢিট করা যায়, তার প্ল্যান কষছিলেন। আর-একটু এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল অদ্রি। ওটা সুমন কি? রাস্তার এক ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে! এ বাবা! কেস তো জন্ডিস মনে হচ্ছে। তা হলে দিয়া এ দিকেই ছিল! তাই তো বলি... চোয়াল শক্ত করে অদ্রি হাতে হাত ঘষে। এই জন্য দিয়ারানি সুমনকে দেখে মাথা গরম করে! আসলে অদ্রির সামনে ড্রামা করে। এ দিকে ভোর বেলায় দেখা হয় ওদের। অদ্রিকে লুকিয়ে এ-সব চলছে কত দিন ধরে? অদ্রি ঘুমিয়েই থাকুক!

*****
দিয়া জগিং করতে করতে পার্ক ছাড়িয়ে খানিকটা গিয়েছে। ব্যাক করার সময় দেখল দুই যুযুধান ব্যক্তি। দুই নয়, এক জনই যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝে আড়ষ্ট হয়ে গেল দিয়া। অদ্রি ওকে ফলো করে এখানে এসেছে? দিয়াকে ভরসা করতে পারছে না? সুমন ইদানীং রোজ পার্কের আশপাশেই থাকে। দেখেছে দিয়া। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে-তাকিয়ে দিয়াকে দেখে। এই দেখার যেন শেষ নেই! দিয়া দু’চার দিন ভয় পেয়েছিল। তবে সুমনের সেই সাহস নেই। ও চিরকালই ভিতু। সামনে এসে দিয়াকে কিছু বলার ক্ষমতা আছে ওর? দিয়া অবজ্ঞা করে লোকটাকে। আজ এসে একটা প্যাকেটে করে আপেল দিয়েছে। দিয়ে দাঁড়ায়নি। এত দ্রুত চলে গেল, দিয়া আপেলগুলো ফেরত দিতে পারল না। দিয়া কেমন যেন থতমত খেয়েছে। অদ্রি জানতে পারলে...!

ঘটনা বেশি দূর এগিয়ে যাওয়ার আগেই দিয়া মেটাতে চেয়েছিল। দ্রুত দু’জনের কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছে। তত ক্ষণে অদ্রি সুমনের কলার টেনে ধরেছে। সুমন হিংস্র চোখে অদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্রি দাঁতে দাঁত চেপে বলছে, ‘‘লজ্জা করে না অন্যের বৌয়ের দিকে নজর দিতে? মনে রাখিস, দিয়া এখন আর তোর বৌ নয়।”
সুমনের হিংস্র চোখ অদ্ভুত হাসছিল, “তোর লজ্জা করেনি অন্যের বৌয়ের দিকে নজর দিতে? পরকীয়ায় মজা বেশি?’’
‘‘একা নজর দিইনি রে! তোর বৌও মজেছিল। বৌকে নিজের করে রাখতে পারিসনি কেন?’’ অদ্রি হিসহিস করে চন্দ্রবোড়ার মতো।

দিয়া স্তব্ধ হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। দু’জনের মধ্যে কে যে প্রেমিক, কে যে স্বামী মাথায় আসছে না। না কি দু’জনেই ডাবল রোল প্লে করছে! দু’জনেই চন্দ্রবোড়া! দিয়াকে পেঁচিয়ে ধরে আছে। অনেকটা কাছ থেকেও দু’জনকে দেখতে একই রকম লাগছে। শার্টের রং এক বলেই কি?

দু’জনের কথা কাটাকাটি এক্ষুনি থামানো উচিত। অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। কেউ-কেউ হাঁটার স্পিড কমিয়েছে। দিয়া পিছন ফিরে ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ব্যাগে কয়েকটা আপেল ছিল। ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়ে থেমে গেল। দামি আপেল নিয়ে এসেছে সুমন। দিয়ার পছন্দ জানে। ফেলে দিতে মায়া হল দিয়ার। সুমনের জন্য, না কি আপেলগুলোর জন্য! কে জানে! ও দিকে দু’টো মানুষ লড়ে যাচ্ছে অন্যের বৌকে নিয়ে... দিয়া যে কার বৌ! সুমনের? না কি অদ্রির? দু’জনেরই? নাকি কারওই নয়? দু’জনেরই পরকীয়া?

ফিরে আসতে গিয়ে দিয়া দেখে, বারান্দার কেটে রাখা তারে আজও ঝুলে আছে ভেজা তোয়ালে। ব্যক্তিগত ব্যাপার এমন করে সবার সামনে মেলে রাখে কেউ? অদ্রি কী যে করে…!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short Story Bengali Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE