Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

চায়ে তামাকে তর্কের তুফান

সে কালে লেখক-সম্পাদকদের আড্ডা ছিল দেখার মতো। কোথাও মেঝেতে ফরাস পেতে প্রুফ দেখতে দেখতেই দেদার গল্প। কোথাও নানান রকম চায়ের ব্যবস্থা, ঢালাও সিগারেট-তামাক। অবিবাহিত লেখকে বিয়ে করতে উস্কে দিতেন সবাই। সে কালে লেখক-সম্পাদকদের আড্ডা ছিল দেখার মতো। কোথাও মেঝেতে ফরাস পেতে প্রুফ দেখতে দেখতেই দেদার গল্প। কোথাও নানান রকম চায়ের ব্যবস্থা, ঢালাও সিগারেট-তামাক। অবিবাহিত লেখকে বিয়ে করতে উস্কে দিতেন সবাই।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

বারিদবরণ ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ভদ্রলোককে আপনাদের জানার কথা নয়। সাহিত্য-টাহিত্যের ধার বড় একটা ধারেন না, তবে সাহিত্যিকদের খুব ধার ধারেন। খুব বড়সড় আমলা বা ব্যবসায়ীও তিনি নন যে লোকে একডাকে চিনবে। তবে হৃদয়টা খুবই বড়। আজ তাঁর ঠিকানাটা দিলেও দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বিধান সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ের কাছে, ৩৮ বিধান সরণি। ভদ্রলোকের নাম গজেন। না, গজেন্দ্রকুমার মিত্র নন, ইনি ঘোষ। পোশাকি নাম ছিল সম্ভবত গজেন্দ্রকুমার ঘোষ, কিন্তু কস্মিনকালে তাঁকে এই নামে কেউ ডেকেছেন বলে খবর মেলেনি। তিনি ‘গজেনদা’, ‘গজেনবাবু’ এবং ‘গজেন’।

দরজা দিয়ে ঢুকেই বৈঠকখানা। তার এক দিকে ফরাস বিছানো তক্তপোশ। তার মাঝখানে গড়গড়া হাতে যিনি আসীন— তিনিই গজেনদা। চাকরি করেন র‌্যালি কোম্পানিতে, ক্যাশিয়ারের কাজ। আকৃতি ও প্রকৃতিতে মহাদেবোপম। বাতের তারসে চলাফেরা করা দুষ্কর, তাই প্রিয় মানুষজনদেরই ডেকে আনেন নিজের আড্ডায়। আড্ডার মানুষ সংখ্যায় প্রচুর, নানা রকমের চা— লিকার, দুধেলা, চিনিশূন্য, চিনির রকমফের— ঘন ঘন আসে। গড়গড়ার আলবোলা, ফরাসি নল এক হাত থেকে ও-মুখে সতত সঞ্চরমাণ, বংশীকে নিত্য কলকে বদল করতে হয়।

সে দিন এসেছেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের কার্তিক প্রেসে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় আর হেমেন্দ্রকুমারদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মেরে। আড্ডাটার একটা নাম ছিল— ‘ভারতীর আড্ডা’। তিনি এসেছেন মণিলালের আহ্বানে। সেখানে মেঝেতে পাতা ফরাসের ওপর উবু বয়ে বসে ‘ভারতী’র প্রুফ দেখছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। গোড়ায় তিনি পাত্তা দিলেন না পবিত্রবাবুকে। কিন্তু যেই জানলেন তিনি ‘সবুজপত্রী’ প্রমথ চৌধুরীর কাগজের সহকারী, আগন্তুককে আর অপদার্থ মনে হয়নি। মণিলালই শুরু করলেন, ‘‘যে ভাবে আপনি আমার শ্বশুরমশায়কে হাত করেছেন! তিনি তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ!’’ সে কী রকম? পবিত্রবদন লজ্জাবনত, শ্বশুরমশায়টি আর কেউ নন, শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর— মণিলাল তাঁর জামাই। ভাল অভ্যর্থনা দিয়ে পবিত্র-বরণ হল।

ঘরে ঢুকলেন এক ভদ্রলোক। আকারে ছোটখাটো। পরিপাটি বেশবাস, গায়ে সাদা চাদর, ক্লিন শেভড, চুল তিন সেন্টিমিটারের বেশি বড় নয়। চশমাবৃত। ইনি বলেন, আমি সবুজপত্রে চাকরি করি, সেখানে যাঁরা আসেন তাঁদের সঙ্গে আড্ডা মারব এমন সাধ্যি কী আমার! উনি বলেন, আমি প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দবাবুর ‘হুকুমপাটি’। দুই ‘চাকরে’ আড্ডার চাকরিতে বহাল হয়ে গেলেন। যিনি এলেন চাদর গায়ে তিনি চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পরে বিখ্যাত ‘রবিরশ্মি’র গ্রন্থকার। হিন্দুস্থানি চাকর এঁদের চা দিয়ে গেল। চারুবাবুকে দিল না, তাঁর নামের শুরুতেই ‘চা’ থাকলেও তিনি নাকি চা খান না। চারুবাবুর অদ্ভুত গুণ। সন্ধেবেলায় ভাত খেয়ে রাত আটটায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার পরে একটা থেকে উঠে পড়াশোনা, ‘প্রবাসী’র কাজ। হেমেন্দ্র হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আচ্ছা চারুবাবু, আপনি সন্ধ্যায় ভাত খান, রাতের মধ্যে খিদে পেয়ে যায় না আপনার? আমার হলে তো ঘুমই ভেঙে যেত খিদের চোটে!’’

কথার মধ্যে চটি ফটফটিয়ে ঘরে ঢুকলেন ‘বুড়োদা’— প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। আড্ডাবাজ শুধু নন, একেবারে আড্ডারাজ! ছিপছিপে চোখা চেহারা। চারুবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁকা চোখে পবিত্রবাবুর দিকে তাকিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ ভাষণ, ‘‘একে তো আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না!’’ মণিলাল জানালেন, তার কারণ আগে ইনি কখনও এখানে আসেননি। জমে গেল আসর। শুধু একটি ছেদ ঘটালেন চারুবাবু, পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র রওনা হলেন।

তিনি যেতেই সাসপেন্ড মণিলাল— ‘‘বুড়োর অজ্ঞাতবাসের গল্পটা কী কোনও দিনই শোনাবে না?’’ হেমেন্দ্রকুমার টিপস দিলেন, ‘‘শোনাবে আর কী করে, বৃহন্নলা বেশে কত অন্তঃপুরে নেচেকুঁদে এসেছে, সে কথা কী আর সবার সামনে বলা যায়!’’ ব্রাহ্মসমাজের নিষ্ঠাবান মহেশচন্দ্র আতর্থীর ছেলে প্রেমাঙ্কুরের এ কী কাণ্ড! হয়তো এ ভাবেই তিনি পিতৃদত্ত নামে সার্থক করছিলেন।

সিগারেট চলতে লাগল। মণিলালকে দিলেন না, ‘‘তোমার তো আবার কুটির শিল্প, নেবে না পাকাবে?’’ রসিকজনকে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কথায় কথায় বুড়োদাকে মণিলাল জানালেন, গজেনদা তাঁর খোঁজ করছিলেন। প্রেমাঙ্কুরের ক’দিন সেখানে যাওয়া হয়নি। ২২ সুকিয়া স্ট্রিট ছেড়ে অগত্যা ৩৮ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে রওনা দিলেন বুড়োদা। পবিত্রকে ডেকে বললেন, ‘‘যাবি পবিত্র, আমার সঙ্গে? আড্ডা দেওয়া ছাড়া তো তোর অন্য কাজ নেই।’’ মিনিট পনেরোতেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ না হয়ে একেবারে ‘তুই’।

অতঃপর সব আড্ডাবাজ গলা জড়াজড়ি করে গজেনদা সমীপে রসগ্রহণ। রস পরিবেশনে দরাজহস্ত, দিলদরিয়া গজেন ঘোষের আড্ডাতে সকলেরই প্রবেশাধিকার। চা দিয়ে গজেনদা অভিষেক পর্ব সারলেন। তার পরেই এল বাটা-ভর্তি পান। আলবোলা ঘুরছে নাগরদোলার মতো। গজেনবাবু এরই মধ্যে একটা বোমা ফাটালেন, ‘‘বুড়োর বিয়ে নিয়ে একটা কানাঘুষো শুনছিলাম যেন, সেটা কত দূর কী এগোল?’’ শোনামাত্র পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘তা হলে আমাদের কপালে তো একটা নেমন্তন্ন নাচছে!’’ গজেনদা সত্যি কথা বলেই ফেললেন, ‘‘মোটেই না, এ কি তোমার-আমার বিয়ে পেয়েছ যে একেবারে যজ্ঞিবাড়ি! বুড়ো ‘তোমার হৃদয় আমার হোক’ করে সেরে দেবে।’’ গজেনবাবু আড্ডা বসাতে পারেন কোন গুণে, ভাষাটা ঠাহর করে শুনে নিন পাঠক নিজেই।

পবিত্রর এককাট্টা কথা, ভোজন ছাড়া কি বিয়ে হয়? শুনে গজেনদা ভরসা দেন, ‘‘ঠিক আছে, সে ভাবনা কোরো না। বুড়ো যদি শেষ পর্যন্ত বিয়েই করে, আর ভোজটা বাদ দেয়, না হয় আমিই...’’ ভোজ খাওয়ার ইচ্ছে কতটা প্রবল হলে কারও মনে এ কথাটা জাগে! অবশ্য গজেনদা দিলখুশ মানুষ, খাওয়ানোতেও দিলদরিয়া। ভোজের গন্ধ পেয়েই কি না জানা নেই, ঘরে এসে ঢুকলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়। আড্ডা জমে উঠল। করুণানিধানের গোঁফদাড়িতে ঢাকা মুখে যে এত রসোদ্ভাস, কে জানত? প্রেমাঙ্কুরকে এ বার কাত করার প্রচেষ্টা তাঁর, ‘‘বুড়োরই বা এমন কী গোঁ আছে! তোমরা পাঁচ জন উৎসাহ করে বলছ, বিয়ে করে ফেলবে ও। আমরা ইতরজন মিষ্টান্ন পাব।’’ গজেনদা ফোড়ন কাটেন, ‘‘সে গুড়ে বালি। বুড়োর হাবভাব দেখে মনে হয়, বিয়ের মতো একটা বেআক্কেল কাজ ও কিছুতেই করবে না। আর করলেই ইতরজনকে মিষ্টান্ন বিলোবে সে ভরসা আমাদের আদৌ নেই।’’ বোঝা যাচ্ছে বিয়ে না হয়ে যদি ভোজটাই হয় অন্তত, আড্ডাধারীরা তাতেই মজে যাবেন।

অনেক ক্ষণ ধরে এ সব শুনছিলেন বুড়ো ওরফে প্রেমাঙ্কুর। এ বার বোমা ছাড়লেন, ‘‘আচ্ছা সব পেটুকের পাল্লায় পড়েছি তো? এরা ভূরিভোজ করবে, আর তার জন্যে আমাকে বিয়ে করতে হবে! বলি, ভোজন যতই গুরু হোক, আজ নয় তা কাল হজম হয়ে যাবেই, বড়জোর একটু জোলাপ! কিন্তু বিয়ে যদি আমার বদহজম হয়, তখন কর্তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি? যত সব আদেখলা কাণ্ড!’’ এত দিন কনে, বৌ, স্ত্রী, দারা, ওগো-হ্যাঁগো শোনা গিয়েছে বিস্তর, কিন্তু বিয়েতেও যে বদহজম হতে পারে, তা প্রথম শোনা গেল এই আড্ডাতেই। বুড়োর আশঙ্কা মিথ্যে নয় সম্ভবত, ভুক্তভোগীরা সায় দেবেন। এ জন্যেই তিনি ‘বুড়ো’— বিচক্ষণ এবং ভবিষ্যৎদর্শী।

পাছে ভোজ ফসকে যায়, এ বার তাই পবিত্রর জিজ্ঞাসা, বিয়েতে কি শুধু বদহজমের ভয় বুড়োদা? প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা আমতা আমতা: ‘‘মানলাম বদহজম কিছুই নেই, সবই মুখরোচক। আর পরিপুষ্টি। তাতে তোমাদের কী? সাধে কি বলে পাড়াপড়শির সুখ নাই!’’

করুণানিধানের মুখে অভিমান কম্পমান, ‘‘আমরা তা হলে গিয়ে তোমার পাড়াপড়শি?’’ গুড়গুড়ির নলে টান দিয়ে গজেনদা সহসা দার্শনিক হয়ে উঠলেন, ‘‘আর কা তব কান্তা, সংসারই তো মায়া!’’ প্রেমাঙ্কুর মোক্ষম প্রশ্নটি ছুড়লেন এ বার, সত্যি করে বলুন তো দাদা, কন্যাদায়গ্রস্ত কেউ এসে কি আপনাকে ধরেছে? আমি নাহয় বলেই ফেলেছিলাম নিজেকে বাউড়া-বাউন্ডুলে, তাতেই কি আমাকে ঘরের বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছেন আপনি?’’

আড্ডাবাজদের সামনে এ বারে প্রেমাঙ্কুরের ভাবুক, দার্শনিক হওয়ার পালা। ‘‘আমি কোনও হতাশা থেকে বলিনি, বরং কোনও বন্ধন চাইনে বলেই বলেছিলাম। তোমাদের মতো গতানুগতিক ভদ্রলোক হতে আমার দম আটকে আসে। বিয়েটা হল বদ্ধ জীবনের অক্সিজেন সিলিন্ডার।’’

কথাবার্তায় সময় গড়ায়। আর এক বন্ধু অসুস্থ, খবর আসায় তাঁকে দেখতে প্রেমাঙ্কুর বেরিয়ে পড়লেন। গজেনবাবুর এ বার চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা লাগল। মণিলাল আর হেমেন তো এলেনই না! হতাশা ঝরে পড়ল তাঁর গলায়: ‘‘ফাল্গুন-রাতে দক্ষিণ-বায়ে/ কোথা দিশা খুঁজে পাই না,/ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,/ যাহা পাই তাহা চাই না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Debate Gossip Tea
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE