Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মোদীর পাশাপাশি কানহাইয়াকেও দরকার

সেটাই গণতন্ত্রের দস্তুর। ভিন্ন মত কখনওই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গুমোর দেখিয়ে নিজের দেশপ্রেমিক ভাবমূর্তি তৈরি করা আসলে দেশেরই ক্ষতি সাধন করে। সেটাই গণতন্ত্রের দস্তুর। ভিন্ন মত কখনওই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গুমোর দেখিয়ে নিজের দেশপ্রেমিক ভাবমূর্তি তৈরি করা আসলে দেশেরই ক্ষতি সাধন করে।

প্রতিবাদ: দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারার বিরুদ্ধে নয়া দিল্লির যন্তর মন্তরে। ছবি: প্রেম সিংহ

প্রতিবাদ: দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারার বিরুদ্ধে নয়া দিল্লির যন্তর মন্তরে। ছবি: প্রেম সিংহ

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:৩০
Share: Save:

অর্ধেক শুনেছে লোকে, বাকিটুকু নিজের মতন

গোটা দেশটাই যেন ধীরে ধীরে জুনেইদের মুখ হয়ে উঠছে! দিল্লির একটু বাইরে, হরিয়ানার ফরিদাবাদ জেলার যে গ্রামে থাকত জুনেইদ খান, সেখানকার একটি লোকও এ বার রমজান বা ইদের অনুষ্ঠান পালন করেনি। সবাই জানেন, দিল্লি থেকে ইদের কেনাকাটা সেরে আরও তিন জনের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল ১৬ বছরের জুনেইদ। ট্রেনেই তাকে গণপিটুনিতে মারা হয়, কারণ তাদের ব্যাগে নাকি গরুর মাংস রয়েছে!

এখন চার দিকে গরুর রচনা লেখার প্রতিযোগিতা চলছে, তাই গরুর আখ্যান নতুন করে শোনানোর প্রয়োজন নেই। তার বদলে, আমরা একটি চিঠির উল্লেখ করব এখানে। কিছু দিন আগে চিঠিটি লিখেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েক জন উচ্চপদস্থ অফিসার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরদের কাছে পাঠানো ওই খোলা চিঠিতে তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, ‘ভিন্ন মত রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়, বস্তুত, তা গণতন্ত্রের মূল সুর।’ যে সেনাবাহিনী নিয়ে শাসক এবং বিরোধী, দু’পক্ষই ভয়ঙ্কর স্পর্শকাতর, সেই সেনাবাহিনীরই বেশ কয়েক জন অবসরপ্রাপ্ত সদস্য কী লিখছেন? লিখছেন, ‘আমরা আর অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। আমরা যদি উঠে না দাঁড়াই এবং উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের পক্ষে কথা না বলি তা হলে দেশেরই ক্ষতি করা হবে।’

এটাই তো প্রতিবাদের স্বাধীনতা! একাত্তরতম বছরের স্বাধীনতা এ বার অন্তত এই প্রতিবাদের ভাষার কথা বলুক! কথায় কথায় যে সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ ও দেশের জন্য বলিদানের উল্লেখ করেন আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা রাজনীতিকরা, সেই রাজনীতিকরা, সেই শাসক দল তা হলে এ বার বলুন, লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল, মেজর জেনারেল, ভাইস অ্যাডমিরাল, ব্রিগেডিয়ার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার সেনা অফিসারেরা সবাই দেশদ্রোহী! সেনাবাহিনীর অবদানের কথা তাঁরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন! কর্মজীবনে যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে দেশরক্ষায় ব্রতী হয়েছেন, সেই তাঁরাই অবসর নিয়ে দেশদ্রোহী হয়ে উঠলেন!

মুশকিলটা হল, বহুত্ববাদের যে অবাধ বিচরণভূমি এই ভারতবর্ষ, সেই বিচরণভূমিই এখন দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ভিন্ন মত, বিরুদ্ধ স্বর এই গণতন্ত্রে আর ঠাঁই পাচ্ছে না। বশংবদ হয়ে পড়লে কোনও সমস্যা নেই। আর কে না জানে, চার দিকে বামন বসিয়ে রাখলে প্রভুদের দানবত্ব নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না! এই মানসিকতা চিরকালীন, কী সমাজ-সংসারে, কী শাসকের মননে। একটু অন্য ধারার কথা শুনলেই গেল-গেল রব ওঠে। অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললেই কী রকম ‘মাওবাদী-মাওবাদী’ গন্ধ নাকে আসে! মনে হয়, আরে, এ তো ঠিক আমার সুরে কথা বলছে না! একে তো ‘কাল্টিভেট’ করতে হচ্ছে!

তা এই ‘কাল্টিভেট’ করার নানা পদ্ধতি এখন আবিষ্কৃত হয়েছে। গরুর মাংস আছে, স্রেফ এই সন্দেহে কুপিয়ে মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, বাড়িতে ঢুকে ‘দেশপ্রেমিক’-এর দল পিটিয়ে মারছে, স্কুটার থামিয়ে ডিকি খুলে মাংস দেখেই চরম সাজা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে যে পদ্ধতি সুবিধাজনক আর কী! সব কিছু তলিয়ে ভাবতে গেলে, সার্বিক ও চুলচেরা মূল্যায়ন করতে গেলে যে সময়, ধৈর্য ও মননের প্রয়োজন তা এখন ডাইনোসরের মতোই বিলুপ্ত।

ফলে, কানহাইয়া কুমার যখন ভিন্ন স্বরে কথা বলেন, সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) এই ছাত্রনেতা, তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়া আর কী অভিযোগ আনা যেতে পারে তাঁর বিরুদ্ধে? এমনকী, খাস কলকাতার যাদবপুরে তাঁর মুখে কালি লেপে দেওয়ার চেষ্টাও বাদ যায় না! আর তাঁর উঠে আসাটা তো আদৌ অভিজাত নয়। বিহারের বেগুসরাইয়ের যে বিহাত গ্রাম থেকে তাঁর এই পদচারণার শুরু, সেটি এমনিতেই প্রত্যন্তে পড়ে থাকা গ্রাম, সেখানকার এক ‘দেহাতি’ শাহি দিল্লি তথা গোটা দেশে তীব্র আলোড়ন ফেলছেন, এটাও আদৌ সহ্য করার মতো ঘটনাই নয়। কিন্তু কে বোঝাবে, এই গণতন্ত্রে নরেন্দ্র মোদীর যেমন প্রয়োজন আছে, কানহাইয়া কুমারদেরও তেমনই আছে। অমিত শাহদের যতটা প্রয়োজন আছে, মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেনদেরও ততটাই আছে! স্বাধীন এই ভারতবর্ষের দলিত মুখ রামনাথ কোবিন্দের যতটা প্রয়োজন আছে, ছত্তীসগঢ়ে খনি শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা শঙ্কর গুহনিয়োগীরও ততটাই আছে!

এটাই গণতন্ত্র, এটাই স্বাধীনতা, ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার গুমোর দেখিয়ে নিজের দেশপ্রেমী ভাবমূর্তি পাকাপোক্ত করা যায় বটে, কিন্তু তাতে আখেরে ক্ষতি হয় দেশেরই। দেশপ্রেম ও উগ্র জাতীয়তাবাদ কিন্তু এক নয়। তার মধ্যে ফারাক আছে। প্রকৃত দেশপ্রেম সীমান্ত মানে না। তার কাছে যে কোনও ভূখণ্ডের সম্মান অনেক বড়। প্রকৃত দেশপ্রেম পাকিস্তানকেও সম্মান করে, চিনকেও সম্মান করে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ অন্যকে সম্মান করতে শেখায় না। তার কোনও আভিজাত্য নেই। বরং তার ‘শিক্ষা’র মূল সুর হল অসম্মান, হিংস্রতা, একমাত্রিক উত্তেজনা সৃষ্টি। সে জানে, উল্টো দিকের কোনও কথা, কোনও ভাষ্য যেন আর কারও কানে না পৌঁছয়। তাকে হিংস্র ভাবে আক্রমণ করে, অসম্মান করে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলপ্রয়োগে দমিয়ে রাখে। তার কাজ সম্পর্কে, এ সমাজে তার সেই কাজের অবদান সম্পর্কে আদৌ অবহিত না হলেও চলবে। বরং টেলিভিশনের স্টুডিয়োয়, জনসভায়, মিডিয়ার বাড়িয়ে ধরা বুমের সামনে চিৎকার করে জানাতে থােক, ‘ওই লোকটা’ কতটা দেশদ্রোহী!

তা হলে গণতন্ত্রে দিলীপ ঘোষেরা থাকবেন আর অমর্ত্য সেনেরা নয়? দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে অন্যকে অসম্মান করাটা কোন পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে। জাতীয়তাবাদী নেতারাই অতীতের জাতীয়তাবাদী নেতাদের সম্পর্কে অনায়াসে কদর্য মন্তব্য করছেন। মহাত্মা গাঁধী সম্পর্কেও অক্লেশে বলে দেওয়া যাচ্ছে, তিনি ‘চতুর বানিয়া’!

সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যখন লিখছেন, কাশ্মীরে সেনা জিপের সামনে ‘মানব ঢাল’ (হিউম্যান শিল্ড) দেখে তাঁর জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের কার্যকলাপের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর মত যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের বদলে কুৎসিত ভাষায় তাঁকে দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। আমার দেশপ্রেম কোন ধারায় বইবে, তার প্রদর্শন কেমন হবে, তা ঠিক করবে সংখ্যাগরিষ্ঠরা। চলতে হবে তাদের পথে, বলতে হবে তাদের ভাষা! তা না হলে? ‘জুনেইদ’ বানিয়ে দেব!

সেই ১৯০৭ সালে অরবিন্দ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘পরাধীনতা, দাসত্বের মধ্যে মুক্ত চিন্তা করা সম্ভব নয়।’

এই ২০১৭-তেও কি ওই বাক্যটি পাল্টানো যাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE