Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Queen of Spice

বিদেশি শক্তিকে রুখে দিয়েছিলেন মশলা রানি

ষোড়শ শতকের কর্নাটকে রাজত্ব করতেন রানি চেন্নাভৈরাদেবী। গোলমরিচ-সহ নানা মশলার উপর পর্তুগিজদের দখল খর্ব করেছিলেন তিনি। আজকের ভারত চেনে কি তাঁকে?

সাক্ষী: উত্তর কন্নড় জেলায় রানির তৈরি বলে কথিত মিরজান দুর্গের অবশেষ, এখন যেমন। ডান দিকে, রানি চেন্নাভৈরাদেবীর মূর্তি

সাক্ষী: উত্তর কন্নড় জেলায় রানির তৈরি বলে কথিত মিরজান দুর্গের অবশেষ, এখন যেমন। ডান দিকে, রানি চেন্নাভৈরাদেবীর মূর্তি

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০০:০০
Share: Save:

গভীর রাত। পর্তুগিজ গভর্নরের নির্দেশে ক্যাপ্টেন কুটিনহো নৌবহর নিয়ে চলেছেন হোন্নাভারের দিকে। তাঁদের সংশয়, সোফালার রাজা সুলেইমানের এক অতিকায় জাহাজ সমুদ্র চিরে এগিয়ে চলেছে গেরাসোপ্পাকে সাহায্যের জন্য। এই গোটা অঞ্চলটা জুড়ে মশলার চাষ হয়। সেই মশলার দখল নিতে পারলে বাণিজ্যিক লাভ প্রচুর। কিন্তু একে তো শাসককে সহজে রাজি করানো মুশকিল, আর এর মধ্যে আবার অন্য শক্তি এসে দাঁড়ালে প্রতিকূলতা আরও বেশি। কিন্তু বন্দরে পৌঁছতে কুটিনহো অবাক। পর্তুগিজদের অবাক করে দিয়ে সেখানকার শাসক বললেন, সুলেইমানের জাহাজ বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অনুমতি ছাড়াই, কুটিনহো চাইলে তার দখল নিতে পারেন। দুই বিদেশি জাহাজের লড়াই হল, দখল করতে গিয়ে প্রতি-আক্রমণে পনেরো জন পর্তুগিজ মারা গেলেন, জাহাজ পালিয়ে গেল। অতর্কিত আক্রমণে বিস্মিত পর্তুগিজরা যখন ভাবতে শুরু করেছে গেরাসোপ্পা বুঝি তাদের শত্রুপক্ষকে সাহায্য করেছে, তখনই গেরাসোপ্পার পক্ষ থেকে তাদের আরও অবাক করে দিয়ে আহত পর্তুগিজ সৈন্যদের জন্য এল শান্তি চুক্তির প্রস্তাব। সঙ্গে ভেটও! এ কোনও রূপকথার কাহিনি নয়। ভারতে এক দীর্ঘ শাসনকালের সাক্ষী, সালুভা সাম্রাজ্যের রানি চেন্নাভৈরাদেবী তথা ‘মশলা রানি’-র গল্প।

বর্তমানে দক্ষিণে কর্নাটকের উত্তর কন্নড় জেলার ছোট্ট গ্রাম গেরাসোপ্পা। সেই সে দিনের জাহাজের দখল নিতে আসা হোন্নাভার এখন তার তালুক। শিলালিপি খুঁজে দেখলে এর নাম দেখতে পাওয়া যায় নাগিরে। প্রচলিত লোককথায় এর নাম ক্ষেমাপুর এবং ভাল্লাটাকিপুরা। প্রাচীন গেরাসোপ্পার উল্লেখ পাওয়া যায় টম পাইরেস নামে এক পর্তুগিজ ভেষজবিদের লেখায়। পাইরেস ভারতে আসেন ১৫১১ সালে। তার পরে দক্ষিণ এশিয়ার আরও অনেক দেশে যান। তাঁর লেখা বই থেকে জানতে পারা যায়, গেরাসোপ্পা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত এক সাম্রাজ্য। হোন্নাভার, মিরজান থেকে অঞ্জাদিভা— সব ক’টি বন্দর ছিল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। ‘গেরাসোপ্পা’ নামের উৎস খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় ‘গীরু’ এবং ‘সোপ্পু’-র মতো শব্দগুলো, যাদের অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘আগুনমুখো পাতা’। এই অঞ্চলে এই রকম পাতাওয়ালা গাছ প্রচুর দেখতে পাওয়া যেত। আপাত-নিরীহ আজকের এই গ্রামটিই একদা হয়ে উঠেছিল রানি চেন্নাভৈরাদেবীর তথা সালুভা সাম্রাজ্যের শাসকদের ক্ষমতাপীঠ। যোগ জলপ্রপাত এখান থেকে খুব দূরে নয়, জলপ্রপাতের শব্দেই মিশে আছে বিস্মৃতপ্রায় এক রানির কাহিনি, তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার ও বিন্যাসের গল্প— যুদ্ধ, প্রেম, ষড়যন্ত্র, দীর্ঘশ্বাস।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসে যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কথা আমরা পড়েছি, সেই সাম্রাজ্যেরই বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে কর্নাটকের পশ্চিম উপকূলে ক্ষমতায় আসে সালুভারা। বিজয়নগরের রাজাদের থেকে এই শাসকেরা ‘মহামণ্ডলেশ্বর’ উপাধি পেয়েছিলেন। সালুভা সাম্রাজ্য পরবর্তী কালে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়, কিন্তু একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে। সঙ্গীতপুরে রাজত্ব শুরু করেন চেন্নাদেবী আম্মা, আর গেরাসোপ্পার দায়িত্ব নেন রাজা কৃষ্ণদেবর্শ। এর পর কৃষ্ণদেবর্শের মৃত্যু হলে অভিষেক ঘটে তাঁর ভাইঝি চেন্নাভৈরাদেবীর। কথিত, সালুভা কৃষ্ণদেবর্শের ভাইঝি চেন্নাভৈরাদেবী আবার চেন্নাদেবী আম্মারও ভাইঝি (মতান্তরে সন্তান) ছিলেন। দুই পৃথক রাজত্বের দায়িত্ব নেন তিনি নিজেই। ১৫৫২ সালে (অন্য মত অনুসারে ১৫৫৬ সালে) রাজত্ব শুরু হয় তাঁর।

তত দিনে পর্তুগিজদের কন্নড়ে ঘাঁটি স্থাপন হয়ে গিয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মশলাভূমি, বিশেষ করে গোলমরিচের ভাণ্ডার তাদের অনিবার্য লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পর্তুগিজরা স্থানীয় শাসকদের ওপর নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে এক রকম দখল করার মানসিকতা নিয়েই একচ্ছত্র ব্যবসা বিস্তার করার চেষ্টা করছিল। বাধা দিলেন রানি চেন্নাভৈরাদেবী। ১৫৬৯ সালে প্রথম বার পর্তুগিজরা হোন্নাভার আক্রমণ করে এবং বন্দর দখল করে নেয়। রানির ওপর কর চাপিয়ে তারা কম মূল্যে গোলমরিচ কিনতে চায়। এই শর্তে একেবারেই সম্মতি ছিল না রানির। তিনি বরং পর্তুগিজদের পরাস্ত করে বন্দর পুনর্দখল করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। আদিলশাহির শাসকের সঙ্গে সুসম্পর্কের জোরে তিনি তাদের সহায়তায় হোন্নাভার আক্রমণ করেন। তবে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেও শেষরক্ষা করতে পারেননি। এ বার রানি কিছুটা সমঝোতার পথে হাঁটলেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ মরিচ পর্তুগিজদের বিক্রি করতে রাজি হন তিনি। বিপুল পরিমাণে মরিচ রফতানি শুরু হয় হোন্নাভার বন্দর থেকে। ভাস্কো দা গামা সমুদ্রপথে ভারত আবিষ্কার করার পর পরই পর্তুগিজরা গোয়ায় নিজেদের আধিপত্য দখল করে তার পর এই দিকগুলোয় নজর দেয়। বার বার পর্তুগিজদের আক্রমণ ও হুমকির মুখে দাঁড়িয়েও রানি অবিচল ছিলেন। নানা ভাবে চেষ্টা করেও পর্তুগিজরা গেরাসোপ্পার দখল নিতে পারেনি। পর্তুগিজদের কোনও চুক্তি না মেনে, কর দানে অসম্মত থেকে লড়াই করে গিয়েছেন তিনি। ভারতের প্রান্তবর্তী সালুভা সাম্রাজ্যের এক রানির দাপট পর্তুগিজরাও অনুভব করেছিল। তাদের মুখেই রানি চেন্নাভৈরাদেবী পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘রেইনা দে পিমেন্টা’— ‘পেপার কুইন’ বা ‘মশলা রানি’ নামে। মশলার ভাণ্ডারের দখল নিতে আসা তাদের সহজ হয়নি, মশলা রানির বাধা পেরিয়ে, তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে তবেই সম্ভব হয়েছিল।

কেবল পর্তুগিজদের রুখে দেওয়াই নয়। চুয়ান্ন বছরের দীর্ঘ শাসনকালে একাধিক স্থাপত্যের কাজও হয়েছিল রানি চেন্নাভৈরাদেবীর হাত ধরে। শান্তিনাথ তীর্থঙ্কর তাঁর রাজত্বকালেই গেরাসোপ্পায় স্থাপিত হয়। তিরুবেঙ্গলস্বামী, সানেশ্বর মন্দির নির্মাণেও তার ভূমিকা ছিল। ১৫৫৬, ১৫৬২ এবং ১৫৬৪ সালে উপুন্ডায় তিনটি তামার লেখনীতে রানির অবদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। জৈন ধর্মের উপাসক রানি নিজে সেই ধর্মের প্রচারও করেন।

তাঁর পরিণতি কিন্তু বীরাঙ্গনার মতো হয়নি। যন্ত্রণা পেয়েছেন ব্যক্তিগত জীবনেও। রানি হয়ে সব প্রথা ভেঙে, নিজের পছন্দের যে মানুষটিকে ভালবেসেছিলেন, সে-ই বিশ্বাসঘাতকতা করে রানিকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে নিজে সাম্রাজ্যের দখল নিতে চাইল। তীক্ষ্ণবুদ্ধি, দূরদর্শী যে রানি এত দিন বিদেশি শক্তিকে আটকে রাখা, দেশীয় রাজাদের সঙ্গে সহাবস্থানের মতো কাজ দক্ষতার সঙ্গে করে এত দিন সিংহাসন ও সাম্রাজ্য আগলে রেখেছিলেন, তিনি হারলেন ভালবাসার কাছে। প্রেমে পড়ে সব হারালেন। পরে কেলাদির রাজা হিরিয়া ভেঙ্কাটাপ্পা নায়েক গেরাসোপ্পা আক্রমণ করেন এবং বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করে চেন্নাভৈরাদেবীকে বন্দি করেন। কিন্তু যোগ্য সম্মানে খামতি রাখেননি। কোথাও হয়তো একটু অনুরাগ ছিল রানির জন্য। সসম্মানে বন্দি থাকা অবস্থাতেই রানির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে। পরবর্তী কালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন হলে কেলাদিরা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে এক বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় গেরাসোপ্পাও। ১৭৬৩ সালে হায়দার আলি কেলাদির নায়েকদের পরাস্ত করে মহীশূর সাম্রাজ্যের মধ্যে গেরাসোপ্পাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তারও পরে ব্রিটিশরা টিপু সুলতানকে হারিয়ে গেরাসোপ্পাকে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ইতিহাসের পরিহাসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়— বিদেশি শক্তির হাত থেকে সুরক্ষিত গেরাসোপ্পা ফিরে যায় বিদেশি শক্তির কাছেই, ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ হয়ে।
অ্যান্টোনিয়ো পিন্টো পেরেয়া, পিয়েত্রো দেলভাল্লে, ক্যাপ্টেন নিউবোল্ড-সহ আরও বহু পর্যটক ও ইতিহাসবিদ গেরাসোপ্পার কথা লিখেছেন, এবং প্রত্যেকেই রানি চেন্নাভৈরাদেবীর কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন। রাজাদের বিজয়গাথায় সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধারায় চেন্নাভৈরাদেবী এক জ্বলন্ত ব্যতিক্রম, দীর্ঘ শাসনকালে শৌর্যে-বীর্যে যিনি বিদেশিদের সম্মান ও সমীহও অর্জন করেছিলেন। এখনকার গেরাসোপ্পায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু স্থাপত্য, প্রস্তর খোদাই ও ধ্বংসস্তূপের ধুলোয় লেগে আছে প্রায়-বিস্মৃত এই রানি-কাহিনি। ক্যাপ্টেন নিউবোল্ড এই জায়গার কিছু জৈন মন্দির, কুয়ো, ভগ্নাবশেষের উল্লেখ করে বলেছিলেন— জলপথে এখানে পৌঁছনোর সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হল নৌকায় স্রোতের বিপরীতে যাওয়া।
আজ থেকে বহু বছর আগে, সরাহবতী নদী থেকে মাঝসমুদ্রে যুদ্ধজাহাজে ঠিক যেমন গিয়েছিলেন চেন্নাভৈরাদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Queen of Spice Chennabhairavi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE