Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জ্বরের হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল কলেজ

ঘিঞ্জি, জনবহুল পরিবেশ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। বড়লোকেরা ছেলের বিয়েতে রাস্তায় গোলাপ জল ছড়ান, অথচ তাঁদের বাড়ির লাগোয়া গলিতে হাঁটা যায় না। উনিশ শতকের কলকাতায় এ সব কারণেই জ্বরজ্বারির চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল খুলতে চেয়েছিলেন সাহেবরা। সেই চিকিৎসালয়ই আজকের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ঘিঞ্জি, জনবহুল পরিবেশ। বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব। বড়লোকেরা ছেলের বিয়েতে রাস্তায় গোলাপ জল ছড়ান, অথচ তাঁদের বাড়ির লাগোয়া গলিতে হাঁটা যায় না। উনিশ শতকের কলকাতায় এ সব কারণেই জ্বরজ্বারির চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল খুলতে চেয়েছিলেন সাহেবরা। সেই চিকিৎসালয়ই আজকের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

মেডিক্যাল কলেজ। (ইনসেটে) জেমস রেনাল্ড মার্টিন

মেডিক্যাল কলেজ। (ইনসেটে) জেমস রেনাল্ড মার্টিন

নিখিল সুর
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সালটা সম্ভবত ১৮৩৪ কি ১৮৩৫। হেমন্তের এক ভোরবেলা। তখনও সূর্য ওঠেনি ভাল করে। কলকাতার ঘুম ভাঙেনি। ডা. মার্টিন কিন্তু অভ্যেস মতো বিছানা ছেড়েছেন আঁধার থাকতেই। একটু আলো ফুটতেই প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন রাজপথ ধরে। হঠাৎ কী মনে হতে এগিয়ে গেলেন বড়বাজারের এক গলিতে। ঢুকতেই নাকে রুমাল চাপা দিতে হল। আবদ্ধ নোংরা জল দেখে গুলিয়ে উঠল শরীরটা। এর পর শুধু বড়বাজার নয়, ডা. মার্টিন ঘুরে বেড়ালেন কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায়। বাদ গেল না তখনকার শহরতলি ‘ইন্টালি’ এবং বালিগঞ্জও। বেছে বেছে গরিব মানুষের কুঁড়েঘরে ঢুঁ মারলেন কলকাতার জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য। জানতে চেষ্টা করলেন, তাদের অসুখবিসুখের কারণের সঙ্গে কলকাতার সার্বিক পরিবেশের কোনও সম্পর্ক আছে কি না।

বেশ কিছু দিন ধরে তথ্য সংগ্রহের পর ১৮৩৭ সালে প্রকাশ পেল তাঁর বিখ্যাত বই ‘নোটস অন দ্য মেডিক্যাল টোপোগ্রাফি অব ক্যালকাটা’। গ্রন্থটি উনিশ শতকের কলকাতার জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত অফুরন্ত তথ্যের ভান্ডার, যদিও লেখকের দু-একটি মন্তব্য যথেষ্ট বিতর্কিত। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে তিনি বিশ্বের মানুষকে সচেতন করতে যে আপ্তবাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন তার মর্মার্থ আজ একুশ শতকের বিশ্ববাসী উপলব্ধি করছে প্রতি মুহূর্তে। জে পি গ্রান্ট-এর এক প্রশ্নের উত্তরে লেখক মন্তব্য করেন, ‘‘ইন অল কান্ট্রিজ় ইট ইজ় ম্যান হিমসেল্ফ দ্যাট মেকস হিজ় ক্লাইমেট।’’

কে এই ডা. মার্টিন? পুরো নাম জেমস রেনাল্ড মার্টিন। ১৮১৭ সালে বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন তিনি। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় তিনি কলকাতার নেটিভ হাসপাতালের প্রেসিডেন্ট সার্জেন। মার্টিন তাঁর বইয়ে কলকাতার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের উপরে আলোকপাত করতে গিয়ে এ দেশের মানুষের জীবনচর্যার সমালোচনা করেছেন গভীর ক্ষোভের সঙ্গে। কলকাতার বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। নিমাইচাঁদ মল্লিকের নাতি রামরতনের বিয়ের সময় চিৎপুরের দু’মাইল রাস্তায় গোলাপজলের ছড়া দেওয়া হয়েছিল, নইলে ধুলো উড়বে, দুর্গন্ধ ছড়াবে যে! অথচ রাস্তার ধারে পগারের গায়ে সারি সারি খাটা পায়খানা। কলকাতার ধনীরা সামাজিক অনুষ্ঠানে অঢেল অর্থ ব্যয় করে, অথচ তাদের প্রাসাদতুল্য বাসভবনের সামনের গলি দিয়ে হাঁটাচলা দায়, এমন নোংরা আর দুর্গন্ধ। মার্টিন মনে করতেন, ইউরোপীয় জ্ঞান কিংবা পশ্চিমি স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করে কলকাতার জনস্বাস্থ্যের হাল ফেরানো যাবে না, যত ক্ষণ পর্যন্ত ‘নেটিভ’দের জীবনচর্যার মজ্জাগত ত্রুটিগুলো অনড় হয়ে থেকে যাবে। মার্টিন ছিলেন কলকাতার ‘নেটিভ’ এলাকার অন্যতম সমীক্ষক। কলকাতার মানুষের স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী এ রকম প্রায় একুশটা ত্রুটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর বইয়ে। সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল ঘিঞ্জি জনবহুল পরিবেশ, যথেষ্ট নিকাশি ব্যবস্থার অভাব, বিশুদ্ধ পানীয় জলের দুষ্প্রাপ্যতা, অনুপযুক্ত পোশাক, নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস, দেশীয় চিকিৎসকদের অজ্ঞতা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ এবং অবশ্যই হাসপাতালের অভাব। জনস্বাস্থ্যের পক্ষে সামাজিক রীতিনীতিগুলিও নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর। তবে সেই সঙ্গে ‘নেটিভ’ এলাকার প্রতি সরকারের উদাসীনতা ও চরম অবহেলা লক্ষ করে মার্টিন বিস্মিত না হয়ে পারেননি।

মার্টিন লিখেছেন, সারা বাংলা থেকে মানুষ কলকাতায় আসত রুজির টানে। সামান্য আয় করে মাসে দু’আনা থেকে দু’টাকা ঘরভাড়া দিয়ে থাকত। অভাবের তাড়নায় প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ মানুষগুলোর শোওয়ার বিছানা থাকত না। তারা শুত স্যাঁতসেঁতে মেঝের উপরে মাদুর পেতে। কলেরার মতো অসুখ হলে অন্যান্য সঙ্গীরা ওষুধ আনতে পারত না। মৃত্যু অবধারিত জেনে তাকে নদীর পাড়ে ফেলে রেখে চলে যেত তারা। কয়েক ঘণ্টা পরে মৃত্যু হলে শবদেহ চলে যেত শেয়াল-কুকুরের পেটে।

কলকাতার জনস্বাস্থ্যের এই শোচনীয় হাল দেখে মার্টিন মনে করেছিলেন, একটা ‘ফিভার হাসপাতাল’ খুব জরুরি। এর অভাবে শহর এবং শহরতলিতে হাজার হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে প্রতি বছর। তিনিই প্রথম ফিভার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। আশা করেছিলেন, এ রকম একটা প্রতিষ্ঠান সরকারি তহবিলের সাহায্য পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি এমন একটি মন্তব্য করেন যা রীতিমতো চমকপ্রদ: ‘সরকারি টাকার আসল উৎস যারা, সেই জনগণের জীবন রক্ষার জন্যই সেই টাকা খরচ করার চেয়ে ভাল কারণ আমার জানা নেই।’

১৭০৭-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় প্রথম হাসপাতাল স্থাপন করে। সেখানে চিকিৎসা হত সেনা, নৌ-বিভাগের কর্মচারী এবং গরিব সাহেবদের। পরে গড়ে ওঠে নেটিভ হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতাল। শেষেরটিতে কেবল সাহেবদেরই চিকিৎসা হত। বিভিন্ন কারণে নেটিভ হাসপাতাল কলকাতার বাসিন্দাদের চিকিৎসার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এ জন্য নেটিভ হাসপাতালের গভর্নররা ১৮৩৫ সালের ২০ মে টাউন হল-এ মিলিত হন এক সভায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডা. মার্টিন, ডা. জ্যাকসন, ডা. নিকলসন, স্যর এডওয়ার্ড রেম্যান, স্যর চার্লস গ্রান্ট, লর্ড বিশপ প্রমুখ। এদেশীয়দের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুস্তমজি।

কিন্তু প্রথমেই বিতর্ক বাধে ফিভার হাসপাতাল কাদের জন্য তৈরি হবে সেই প্রশ্নকে ঘিরে। পুলিশ হাসপাতালের সার্জেন প্রস্তাব দেন, এই হাসপাতাল তৈরি হোক অবস্থাপন্ন বাবু এবং সাহেবদের ভৃত্যদের জন্য। নাকচ হয়ে যায় এই প্রস্তাব। ফিভার হাসপাতালের জন্য যে ফিভার কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার বক্তব্য ছিল, বিশাল সংখ্যক মানুষ যখন জ্বর বা অন্য রোগে আক্রান্ত হয়, তখন নেটিভ হাসপাতাল সামলাতে পারে না। তা ছাড়া, ধর্মীয় সংস্কার নেটিভদের বাধা দেয় এই হাসপাতালে আসতে। সেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের চিকিৎসা হয়। পৃথক চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

তোড়জোড় শুরু হল ফিভার হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য। একটা উপসমিতি গঠিত হল। সেখানে কলকাতার বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে সদস্য করা হল রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব ও রাজচন্দ্র দাশকে। পরে এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয় রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, রসময় দত্ত, মথুরানাথ মল্লিক, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাত্র তিন জন নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন, বাকিরা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। রামকমল সেন তো সদস্য পদেই ইস্তফা দেন। রাধাকান্ত দেবও গুটিয়ে নেন সহযোগিতার হাত।

গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড সম্ভবত মার্টিনের বইয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিলেতের কর্তৃপক্ষকে লেখা তাঁর চিঠি পড়লে তা বোঝা যায়। কিন্তু সমস্যা হল হাসপাতালের জন্য অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে। গভর্নর জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে সায় দিলেও টাকার প্রশ্নে শক্ত, সরকারি টাকায় হাসপাতাল হওয়াটা তিনি পছন্দ করলেন না। পরিচালক সমিতিকে জানালেন, ‘এই শহরের বরাবরের অভ্যেস সব ব্যাপারে সরকারের উপরে নির্ভর করা। এই ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে মুক্তহস্তে দানধ্যানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।’ তাঁর যুক্তি, ব্রিটিশ ভারতের সাধারণ রাজস্ব একটা স্থানীয় স্বার্থে ব্যয় করা অবিচার মাত্র। পরামর্শ দিলেন, হাসপাতাল করতে হলে স্থানীয় কর বসিয়ে করা হোক।

প্রায় আজকের বাজার অর্থনীতির প্রতিধ্বনি। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের দিন থেকেই প্রতিবাদী। পরে, ১৯৩০ সালে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের গাড়িতে বোমা মারার জন্য নারায়ণ রায় ও ভূপাল বসু নামে মেডিক্যাল কলেজের দুই ছাত্রের আন্দামানে দ্বীপান্তর হয়। ১৯৩৩ সালে এঁরা দুজন উল্লাসকর দত্ত ও সতীশ পাকড়াশির নেতৃত্বে ৪৫ দিন অনশন করেন কয়েকটি দাবিতে। যথাযথ খাবার, স্নানের জন্য সাবান ও পড়ার জন্য বই চাই। মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের অনশন-ঐতিহ্য আজকের নয়।

শুরুর কথায় ফিরে আসি। জনস্বাস্থ্যে কোম্পানির আমলে সরকার থেকে একটা পয়সাও খরচ করা হয়নি। যা করেছে, সবই লটারি কমিটি। লটারি কমিটির তহবিল গড়ে উঠেছিল প্রধানত সাহেবদের টাকায়। তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রেতা, কারণ লটারি টিকিটের দাম এত চড়া ছিল যে এ দেশের খুব কম সংখ্যক মানুষ তা কিনতে পারতেন। ডা. মার্টিন বলেছিলেন, উনিশ শতকের কলকাতা লটারি কমিটির কাছে ঋণী, ‘এই শহরের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংস্কারগুলি নিশ্চিতভাবেই লটারি কমিটির পরিশ্রমের ফল।’

ফিভার হাসপাতাল গড়ে তোলার ব্যাপারে গভর্নর জেনারেলের অনীহা লক্ষ করে কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ম্যাকফারলান সরকারকে চেপে ধরলেন। সরকারের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, কেন, সরকার তো অনেক আগেই এই শহরের ‘নেটিভ’দের জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে মাদ্রাসা ও সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেছে। তা হলে, ফিভার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার কেন অর্থ মঞ্জুর করবে না? সে সময় ইংল্যান্ডের অধীন আয়ারল্যান্ডও হাসপাতালের জন্য সরকারি সাহায্য পেত, সেটাও ম্যাকফারলান উল্লেখ করতে ভুললেন না।

সরকারি আধিকারিকদের যুক্তির ঠেলায় গভর্নর জেনারেল এ বার একটু নরম হলেন। কিন্তু বিতর্ক শুরু হল অন্য প্রশ্ন ঘিরে। কলকাতার পক্ষে কোনটা উপযোগী, হাসপাতাল না ডিসপেনসারি? সরকার চাইল ডিসপেনসারি। নেটিভ হাসপাতালে ৭৬০০ রুগির জন্য খরচ হয় ২১,৮৩৬ টাকা। আর মাত্র ১৭,১৩৫ টাকায় ১,৬১,০০০ রুগির চিকিৎসা হতে পারে ডিসপেনসারিতে। হিসেব কষে সরকারের মনে হয়েছিল, হাসপাতালের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা দিয়ে সাত-আটটা ডিসপেনসারি চালালে বেশি উপকৃত হবে গরিব মানুষ। ডা. মার্টিন হাসপাতাল ও ডিসপেনসারির উপযোগিতার মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে বললেন, কলকাতার মতো শহরে হাসপাতাল ছাড়া জ্বর এবং আমাশয়ের সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। হাসপাতালে রুগির সুস্থ হয়ে ওঠার সব উপকরণ মজুত থাকে। পরিচ্ছন্ন ওয়ার্ড, উঁচু বিছানা, উপযুক্ত পথ্য, সবই হাসপাতালে সুলভ। ডিসপেনসারিতে রুগিকে ওষুধ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব নয়। ওষুধ নিয়ে রুগি ফিরে যায় সেখানেই, যেখানে সে রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। সেই স্যাঁতসেঁতে মেঝের উপরে শোয়, সঙ্গীরা যে খাবার আনে তা-ই খায়। সেখানে পরিচ্ছন্নতা বা মুক্ত আলো-বাতাসের বালাই নেই।

ডা. স্টিওয়ার্থ সরকারি বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে মন্তব্য করলেন, ‘ডিসপেনসারি নিয়ে আলোচনাটাই খুব দুঃখের ব্যাপার। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার পরিকল্পনা থেকে নগণ্য বিষয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা।’ ডা. নিকলসন বললেন, একমাত্র হাসপাতালের পক্ষেই সম্ভব আসন্ন মহামারির পূর্বাভাস পাওয়া, রোগ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা, মহামারির সময় কার্যকর ভূমিকা নেওয়া। আর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের হাতে-কলমে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের সুযোগ করে দিতে পারে একমাত্র হাসপাতালই। সেটা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফিভার কমিটি আশা করেছিল, যেহেতু নেটিভদের জন্য এই হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা, তাই তারা এগিয়ে আসবে আর্থিক সাহায্য নিয়ে। গভর্নর জেনারেলের প্রস্তাব মতো চাঁদা ও দানের রসিদ ছাপিয়ে বিলি করা হল সকলের মধ্যে। ডা. মার্টিন হাসপাতালের জন্য সাহায্যের আবেদন জানালেন সুদূর লুধিয়ানার ধনীদের কাছেও। কিন্তু এ দেশের মানুষের কাছ থেকে যে সাড়া মিলল, তা তেমন বলার মতো নয়। ম্যাকফারলান তাঁর প্রতিবেদনে লেখেন, ‘নেটিভদের কাছে আমাদের যে আশা ছিল, তা ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছে।’ এ দেশের ষোলো জন ধনী দান করেছিলেন ২৮,৭০০ টাকা আর সাহেবরা দিয়েছিলেন ২৯,০২৩ টাকা। এ দেশের মানুষ তেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, কারণ একটা সন্দেহ চেপে বসেছিল তাদের মনে। মাধব দত্ত এক হাজার টাকা দান করেছিলেন এই শর্তে যে, এক বছরের মধ্যে হাসপাতালের কাজ শুরু না করলে তাঁর অর্থ ফেরত দিতে হবে।

সংশয় দেখা দিল আর একটা প্রশ্নকে ঘিরেও। যাদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তারা কতটা সুযোগ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে? এ দেশের অনেক মানুষের পাশ্চাত্য চিকিৎসায় আস্থা ছিল না। হুতোম পদ্মলোচনের দেহত্যাগ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘তিনি প্রকৃত হিন্দু, সুতরাং ডাকতারী চিকিৎসায় ভারী দ্বেষ কর্ত্তেন, বিশেষত তাঁর ছ্যেলেব্যালা পর্যন্ত সংস্কার ছিল, ডাকতারী ঔষধ মাত্রেই মদ মেশান, সুতরাং বিখ্যাত কবিরাজ মশাইদের দ্বারা নানা প্রকার চিকিৎসা করান হয় কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না...’। পদ্মলোচন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তিন রাত্তির গঙ্গার পাড়ে পড়ে থেকে।

এমনই আরও অনেক পদ্মলোচন ছিল তখন কলকাতার বর্ণহিন্দুদের মধ্যে। হাসপাতালে তাদের জাত-ধর্ম বলে কিছুই থাকবে না, এমন একটা আশঙ্কা ছিল তাদের মনে। ফিভার কমিটিরও অজানা ছিল না ব্যাপারটা। সে জন্য হাসপাতালে বর্ণহিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের জন্য পৃথক ওয়ার্ডের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। গরিবের কোনও সংস্কার ছিল না। তবে ব্যতিক্রম ছিল ওড়িয়া পালকিবাহকরা। বড্ড গোঁড়া ছিল তারা।

মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে আরও আগে, ১৮৩৫ সালে। ক্লাসও শুরু হয়েছে সে বছর ১ জুন থেকে। ডা. মাউন্টফোর্ড জোসেফ ব্রামলি ছিলেন কলেজের প্রথম সুপারিনটেন্ডেন্ট— তখনও ‘অধ্যক্ষ’ পদটি তৈরি হয়নি, সেটিই শীর্ষপদ। ডা. ব্রামলি ও ডা. গুডিভ, এই দুজন সাহেব শিক্ষক ছাড়া আরও দুজন এদেশীয় শিক্ষক ছিলেন, মধুসূদন গুপ্ত ও নবকৃষ্ণ গুপ্ত। দুজনেই পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত, মধুসূদন গুপ্ত তো ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘মেডিক্যাল কলেজে শবব্যবচ্ছেদকারী প্রথম ভারতীয়’ হিসেবে। প্রাথমিক ভাবে একটা পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র ভর্তি নেওয়া হয়েছিল। জনা একশো প্রার্থীর অধিকাংশই ছিলেন হেয়ার স্কুল, হিন্দু কলেজ স্কচ অ্যাসেম্বলি স্কুল (এখন স্কটিশ চার্চ স্কুল) থেকে। মোট ৪৯ জনকে নেওয়া হয়েছিল ‘ফাউন্ডেশন ছাত্র’ হিসেবে।

ও দিকে হাসপাতালের প্রস্তুতি শেষ। এ বার প্রশ্ন উঠল, হাসপাতাল কোথায় হবে। অনেকগুলো প্রস্তাব এল। সেগুলোর মধ্যে ডা. ডব্লু গ্রাহামের প্রস্তাবটা মনে ধরল কমিটির। তাঁর প্রস্তাব ছিল, মেডিক্যাল কলেজের আশেপাশেই কোথাও হাসপাতাল তৈরি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁকে সমর্থন করলেন মেডিক্যাল কলেজের সচিব ডেভিড হেয়ার। ফলে কলেজ সংলগ্ন জমিতেই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। জমি দান করলেন মতিশাল শীল। ১৮৪৭ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করা হল। পরের বছর, ১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসি হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তবে ‘ফিভার’ নামটা পেডিমেন্টের নীচে স্থান পেল না। তাতে লেখা হল ‘মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল’। রুগি ভর্তি শুরু হল ১৮৫২ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে।

ডা. মার্টিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অন্যান্য সাহেব চিকিৎসকদের সম্মিলিত আগ্রহ এই অসাধ্য সাধন করেছিল সরকারের উপরে নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার ও সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে যুক্তি-তর্কের অবিশ্রান্ত লড়াইয়ের শেষে সরকার বাধ্য হয়েছিল নতি স্বীকার করতে। ডিসপেনসারি নয়, হয়েছিল হাসপাতাল। সবটাই ইংরেজ রাজপুরুষদের কৃতিত্ব। যাঁরা সাহেবদের সমস্ত কাজের মধ্যে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ পান, তাঁরা মনে করেন, কলকাতার উন্নয়নে কোম্পানির আধিকারিকদের আগ্রহ একটা রাজনৈতিক চাল মাত্র। উদ্দেশ্য, ঔপনিবেশিক শাসনের গ্রহণযোগ্যতা নেটিভদের কাছে তুলে ধরা। এই তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাসী, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লেখ্যাগারে সংরক্ষিত ‘জেনারেল কমিটি অব ফিভার হসপিটাল অ্যান্ড মিউনিসিপ্যাল ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক সাত খণ্ডের বিপুল পরিমাণ নথিপত্র এক বার উল্টে দেখতে পারেন। সেখানেই দেখা যাবে আজকের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা নিয়ে সরকার ও ফিভার কমিটির সদস্যদের মধ্যে লড়াইয়ের স্বরূপটা। হয়তো এই সিদ্ধান্তে আসা যাবে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ছোট ইংরেজ’রা সকলে ঔপনিবেশিক শাসনের অনুকল্প ছিলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE