Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গোটা জলহস্তী গিলতে পারে এই কুমির!

নাম গুস্তাভ। বাসস্থান বুরুন্ডির রুসিজি নদী। মানুষ তো কোন ছার, বিরাট হাতি বা মস্ত মোষও তার অসহায় শিকার। এত পুরু তার চামড়া, একে-৪৭’এর গুলি, রকেট লঞ্চারও নাকি কিছু করতে পারে না! নাম গুস্তাভ। বাসস্থান বুরুন্ডির রুসিজি নদী। মানুষ তো কোন ছার, বিরাট হাতি বা মস্ত মোষও তার অসহায় শিকার। এত পুরু তার চামড়া, একে-৪৭’এর গুলি, রকেট লঞ্চারও নাকি কিছু করতে পারে না!

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বুরুন্ডি দেশের রুসিজি নদীর ঘোর দুর্নাম। এই আফ্রিকান জলস্রোত গিয়ে পড়ছে সেই টাঙ্গানাইকা (এখন তানজানিয়া) হ্রদে। ঘোলা জলে গলা ভেজাতে আসে ক্ষুধার্ত চিতা আর সিংহ। তবু মানুষের হুঁশ নেই। নদীর পাড়ে খেয়োখেয়ি করছে তারাও। কখনও জার্মানির হেলিকপ্টার এসে বোমা ফেলে, কখনও দেশে লাগে গৃহযুদ্ধ। প্রায়ই গ্রামের লোকের গলাকাটা দেহ স্টিমার থেকে ছুড়ে ফেলে যায় চোরাশিকারি। এখানেই এক দিন চোখ মেলেছিল গুস্তাভ।

নথি বলছে, সেটা ষাটের দশক। বেলজিয়ামের দাসত্ব থেকে দেশকে মুক্ত করতে লড়ছেন বুরুন্ডির রাজা চতুর্থ মোয়ামবাৎসা। তাঁরই এক হুতু সৈন্য নদীর জলে স্নান করছিল। সেই প্রথম দেখে গুস্তাভকে। নদীর শ্যাওলা থেকে বিশ্রী শরীরটা তুলে, থ্যাপথ্যাপ করে এগিয়ে এল একটা বিরাট কুমির। একটা আস্ত জলহস্তী খপ করে ধরে নদীতে নেমে গেল। সৈন্য বলেছিল, কুমিরটা এত বড় যে হাতি গিলে নিতে পারে। স্থানীয়রা বলেছিলেন, হতেই পারে। বৃষ্টির তো বিরাম নেই। জল একটু বেশি মিঠে হয়ে গেলে এই এলাকায় নীলনদের কুমিরগুলো চলে আসে। লম্বায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট। মাছে পেট না ভরলে লাগোয়া জঙ্গলের কালো হরিণগুলোকে ধরে। বড়জোর কাছাকাছি ঘরের পশু-পাখি তুলে নিয়ে যায়। তার বেশি ভয় নেই।

কিন্তু এর পরেই ঘরের মানুষগুলো একে একে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে শুরু করল। আর হঠাৎ হঠাৎ ভুস করে ভেসে উঠত সে। নৃশংস খুনির মতোই দেখতে। কদাকার চেহারায় বুলেটের অনেকগুলো দাগ। ডান হাতের ওপর বড় একটা খোঁদল। নিমেষে ডাঙায় উঠে এসে একটা করে মানুষ বেছে নিয়ে জলে ফিরে যাচ্ছে। আধখানা খেয়ে, শবটাকে ছিন্নভিন্ন করে পানার তলায় ঘাপটি মারছে। ক’দিন পর লাশটা পচে ঢোল হয়ে ফুলে উঠছে জলে। স্রোতের আলতো ঠেলায় ভেসে আসছে চরের দিকে। এ ভাবেই জমছে লাশের পাহাড়। কাক-শকুনরা কুমিরের এঁটো খেয়ে সাফ করতেই হাড়-খুলিগুলো ঢিপি হয়ে পড়ে থাকছে। মৃতদেহের জামা ছিঁড়ে লজ্জা ঢেকে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে গরিব দেশের রোগা শিশু।

সে শিশুরা জোয়ান হয়ে সত্যিকারের যুদ্ধে গিয়ে মরেও গেল। কিন্তু গুস্তাভের খিদে মিটল না। দশক-দশক ধরে পূর্ব আফ্রিকার এই চিলতে ডাঙায় চলল মানুষের লড়াই আর জলে গুস্তাভের অত্যাচার। সে ইতিহাস কতকটা জানা যায়, বেশিটাই উপকথা। সময়ের স্রোতও বইতে বইতে এসে ঠেকল নব্বই দশকে। গুস্তাভ তত দিনে তিনশোর মতো মানুষ মেরেছে। জীববিজ্ঞানীরা তাকে দেখতে আসতে শুরু করলেন। তাঁরাই বললেন, সরীসৃপদের মধ্যে কুমিরেরই সবচেয়ে বেশি মানুষখেকো হওয়ার প্রবণতা। এমন বিরাট চেহারায় তো তুরন্ত গতিতে পালানো বন্য প্রাণী ধরতে সমস্যা হয়। আর এক বার দাঁতে মানুষের মাংস লাগলে নেশা হতে কত ক্ষণ! আমাজন, উগান্ডা, অস্ট্রেলিয়া ও এই এশিয়ার সুন্দরবনেও খালে-বিলেই এমন বহু মানুষখেকো কুমির থাকে।

গুস্তাভের ছবি খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞরাও থ। গুলির দাগগুলো তো একে ৪৭-এর! আর ডান পিঠের জখমটা তো কোনও রকেট-লঞ্চারের। মানে, কখনও সেনা বা চোরাশিকারীর দলের সঙ্গে সামনাসামনি লড়েছে সে। কোথায় গেল সে সব ইতিহাস? ত্রৈলোক্যনাথের ডমরুধর থাকলে হয়তো বলতেন, সে সব কাহিনি এখন তার পেটের গুহায় বসে বেগুন বেচছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বললেন, এ কুমির খিদের চোটে শিকার ধরে না। অসতর্ক মানুষকে পলকে জলে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মারা তার শখ। ইচ্ছে হলে একটু খায়, বাকিটা সেই পাড়ের দিকে ভাসিয়ে উধাও হয়ে যায়। এটাই তার মর্জি, খেয়াল। ও মানুষকে ঘেন্না করে।

বিখ্যাত সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিস ফে নব্বইয়ের শেষাশেষি, নীলনদের এই মানুষখেকোকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ‘গুস্তাভ’ নামটা তাঁরই দেওয়া। ফে বলেছিলেন, এই কুমিরের চামড়া এত মোটা যে ও বুলেটপ্রুফ। ফে ঠিক করেছিলেন, ওকে জ্যান্ত ধরবেন। তাতে জীব-বৈচিত্রের নতুন অধ্যায় খুলে যেতে পারে। তিনি এক দল বন্যপ্রাণী কর্মীদের নিয়ে ২০০০ সাল থেকে লাগাতার দু’-তিন বছর ধরে প্রচুর পড়াশোনা ও পরিশ্রম করে, গুস্তাভকে পাকড়ানোর একটা প্ল্যান কষেন। বহু কষ্টে গুস্তাভের এলাকায় পৌঁছনোর ছাড়পত্র জোগাড় করেন। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা খাঁচা বানিয়ে তাতে একটা ক্যামেরা লাগান। টানা দু’মাস ধরে বহু টোপ ব্যবহার করেন। শোনা যায় গুস্তাভের প্রিয় খাদ্য, জীবন্ত মানুষ পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আসেনি সে। শেষে এক দিন রণে ভঙ্গ দিয়ে, আমেরিকা ফিরে যান ওঁরা।

সে সময় গ্রামের লোকেরা তাঁদের বলেছিল, গুস্তাভের বয়স একশো। কিন্তু ফে বলেছিলেন, ভুল কথা। তার অতিকায় শুকনো হাঁয়ে, অগুনতি ধারালো দাঁতের সারি যে ভাবে সাজানো, তা দেখলেই বোঝা যায় সে মোটেও বুড়ো হয়নি। দাঁতে খয়া রোগও নেই। এই অঙ্ক বলে, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কোনও সময়ে তার জন্ম। তবে ভয়ানক কথা হল, এ জাতের কুমির সাধারণত দীর্ঘজীবী। কারণ, এরা কিছুটা কিছুটা করে খায়। তাতেই এদের অনেক মাস চলে। বাকি সময়টা তো পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে আয়ু বাড়ায়। এখনও একশো হতে ঢের দেরি থাকলেও, একশো পার করতে কোনও সমস্যাই হওয়ার কথা নয় গুস্তাভের।

এই ২০১৮-য় তার বয়স ষাটের একটু বেশি। এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরছে রুসিজি নদীর সাম্রাজ্যে। কুমিরের হিসাবে সে যুবক। এখনও বাড়ছে সে। খেয়ে খেয়ে ওজন করেছে হাজার কিলোর কাছে। শেষ দেখা মিলেছে আড়াই বছর আগে। একটা হৃষ্টপুষ্ট মোষকে টেনে নিয়ে জলে চুবিয়ে মারছিল। কেউ বর্শা ছোড়ার স্পর্ধা করেনি। মানুষে আপাতত অরুচি চলছে, বা বিশ্রাম নিচ্ছে। কত দিনের বিশ্রাম, কে জানে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE