Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাল্যবিধবা থেকে চিকিৎসক

হয়েছিলেন হৈমবতী সেন। যাঁর জন্মে কেঁদেছিলেন তাঁর মা। লুকিয়ে পড়াশোনা শিখেছিলেন। ন’বছরে বিয়ে। মেডেল পেয়েছিলেন ডাক্তারি পরীক্ষায়।হৈমবতীর জন্ম খুলনায়, ১৮৬৬ সালে। তাঁর মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু, যিনি পুত্রসন্তানের কামনায় পুজোআচ্চার কোনও ত্রুটি রাখতেন না।

গায়ত্রী সেন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সালটা ১৮৯৩। ‘ভার্নাকুলার লাইসেনশিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করলেন চুনিবাবু। শুধু পাশ নয়, পাঁচটি মেডেলও পেলেন। এর পর মহিলা চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন হুগলির লেডি ডাফরিন হাসপাতালে! মহিলা চিকিৎসক! চুনিবাবুর আসল নাম যে হৈমবতী সেন!

হৈমবতীর জন্ম খুলনায়, ১৮৬৬ সালে। তাঁর মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু, যিনি পুত্রসন্তানের কামনায় পুজোআচ্চার কোনও ত্রুটি রাখতেন না। যখন তিনি গর্ভবতী হলেন, গোটা গ্রাম তাঁকে নিয়ে আনন্দোৎসবে মেতে ছিল। তারা ধরেই নিয়েছিলেন তিনি পুত্রের জন্ম দিতে চলেছেন। কিন্তু জন্ম হল হৈমবতীর।

কন্যাসন্তান শুনে কেঁদে ভাসালেন মা। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ঠাকুমাও। কিন্তু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁর বাবা প্রসন্নকুমার ঘোষ। মেয়ের জন্মের আনন্দে নহবত বসিয়েছিলেন। আতশবাজির আলোয় আলোকিত হয়েছিল অন্ধকার আকাশ। পুরো বাড়ি আলোর মালায় সেজে উঠেছিল। তিনি আত্মীয়-পরিজনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, হৈমকে কেউ যেন ‘মেয়ে’ না বলে। বাড়ির ছেলেরা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, তাঁর মেয়ের ক্ষেত্রেও তা কম হবে না। মেয়েকে কেউ অবজ্ঞা করলে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না তিনি। নিঃসন্দেহে এমন বাবা সেই সময়ে বিরল! দাদা বা ভাইদের লেখাপড়া করতে দেখে হৈমর মন চাইত লেখাপড়া করতে। বাড়ির পাঠশালায় দাদারা পড়তে যেত, আর হৈম সেখানে আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে শুনে শুনে পড়া মুখস্থ করে ফেলতেন। বাবার তামাক চুরি করে এনে দিতেন গৃহশিক্ষকদের। সেই শিক্ষকেরাও তাঁকে পড়াশোনা শিখতে সাহায্য করেছিলেন।

প্রসন্নকুমার ঘোষ সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষ হলেও হৈমর বাল্যবিবাহ আটকাতে পারেননি। মাত্র ন’বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বিপত্নীক পাত্রের সঙ্গে। বরের বয়স পঁয়তাল্লিশ, তিনি তখন এক সাবালিকার বাবাও। মদ্যপ বয়স্ক স্বামীর যৌনাকাঙ্ক্ষা একরত্তি হৈম মেটাতে না পারায়, প্রায় প্রতি রাতে তাঁর স্বামী গণিকা নিয়ে আসতেন শোওয়ার ঘরে। হৈম সচক্ষে দেখতেন গণিকার সঙ্গে মদ্যপ স্বামীর রতিক্রীড়া। বিয়ের এক বছরের মধ্যে বিধবা হলেন তিনি। হৈম শ্বশুরবাড়িতে থাকলেন পরিচারিকার মতো। লেখাপড়া করার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি। শাশুড়ির মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে ভাসুর, দেওর তাঁকে থাকতে দিতে চাইলেন না। তত দিনে তাঁর বাবা-মা’ও গত হয়েছেন। বাপের বাড়িতেও ভাইদের কাছে আশ্রয় জুটল না। নিঃসম্বল ও নিরুপায় হয়ে যুবতী হৈম কাশীবাসী হলেন।

নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হবে। তাই কাশীতে কাজের খোঁজ করতে লাগলেন। একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেয়ে গেলেন। তাতে তাঁর টেনেটুনে চলে গেলেও ওই সামান্য কাজে তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি জানতে পারলেন, কলকাতায় বিধবাদের নানান ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। হৈম কাশী ছেড়ে একাই কলকাতায় চলে এলেন। যোগাযোগ হল ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে। এই সময় ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে ছাত্রী নেওয়া হবে জেনে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করলেন হৈমবতী। পরীক্ষায় পাশ করে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেলেন। বৃত্তিও পেলেন।

পড়তে পড়তেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করলেন ব্রাহ্ম সমাজসংস্কারক কুঞ্জবিহারী সেনকে। তখন হৈমর পঁচিশ বছর বয়স। এর তিন বছর পরে হুগলির লেডি ডাফরিন হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

দীর্ঘ ষোলো বছর এই হাসপাতালের সঙ্গে যোগ ছিল তাঁর। ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকায় এলএমএস ডিপ্লোমা তাঁকে দেওয়া হয়নি। কয়েক জন সহকর্মী তাঁকে ডাক্তার হিসেবে মর্যাদা দেননি। বরং তাঁদের ভাষায় হৈমবতী ছেলেন শিক্ষণপ্রাপ্ত দাই। কিন্তু সে সবে তিনি কান দেননি। বরং তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির গুণে, রোগীদের প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল মনোভাবের কারণে তিনি সকলের কাছে হয়ে উঠেন তাঁদের প্রিয় ‘ডাক্তার দিদি’।

হৈমর লেখাপড়া শেখার স্বপ্ন পূরণ হলেও বিবাহিত জীবনের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি। দ্বিতীয় স্বামীর কোনও উপার্জন ছিল না। সংসার ও পাঁচ সন্তানের সব খরচই চলত হৈমর ভরসায়। অথচ স্বামী প্রায়ই শারীরিক নির্যাতন করতেন তাঁকে। স্বামীর মৃত্যুর পর এক দিকে সন্তানপালন, অন্য দিকে হাসপাতাল, দুটো জীবনকে সমান তালে সামলেছিলেন তিনি।

কিন্তু যে হাসপাতালের জন্য তিনি প্রাণপাত করেছিলেন, সেই হাসপাতালও তাঁকে ছাড়তে হয়। কারণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতান্তর। তখন শুরু করেন প্রাইভেট প্র্যাকটিস। হৈমবতী নিজেকে শুধুমাত্র চিকিৎসকের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি সাহিত্যচর্চাও করেছেন। লিখেছেন কবিতা, ছোট গল্প। তাঁর আত্মজীবনী ‌‘স্মৃতিকথা’ ২০০০ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, ‘মেমোরিজ় অফ ডক্টর হৈমবতী সেন— ফ্রম চাইল্ড উইডো টু লেডি ডক্টর’ নামে।

১৯৩৩ সালে ৬৭ বছরে বয়েছে মারা যান হৈমবতী। হৈমবতী সেই বিরল বাঙালি মহিলাদের মধ্যে এক জন, যাঁরা সেই বিশ শতকের শুরুতেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিকূল পরিবেশে কী ভাবে লড়াই করে দুর্ভাগ্যের বন্ধ চাকাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Haimabati Sen হৈমবতী সেন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE