Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আমার কলেজের ছেলেদের মারবি?

হুংকার দিলেন বিদ্যাসাগর। তখন সংস্কৃত কলেজ আর হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পুলিশকে ইট ছোড়েন। অধ্যক্ষকে ধিক্কার দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা বেরিয়ে আসে। ছাত্রদের বিক্ষোভ কি আজকের ব্যাপার? হুংকার দিলেন বিদ্যাসাগর। তখন সংস্কৃত কলেজ আর হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পুলিশকে ইট ছোড়েন। অধ্যক্ষকে ধিক্কার দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা বেরিয়ে আসে। ছাত্রদের বিক্ষোভ কি আজকের ব্যাপার?

ছবি: কুনাল বর্মণ

ছবি: কুনাল বর্মণ

শুভাশিস চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

দুই কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ থামাতে রীতিমত পুলিশ ডাকতে হত। রক্তগঙ্গা বইত কোনও কোনও দিন, এতই তীব্র ছিল দু’টি কলেজের ছাত্রদের রেষারেষি। আজ থেকে কম–বেশি দেড়শো বছর আগে। যুযুধান দুই পক্ষের একটি সংস্কৃত কলেজ, অন্যটি হিন্দু কলেজ।

সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা ইট–পাটকেল জোগাড় করে রাখত তেতলার ছাদে। মারামারি শুরু হলে উপর থেকে ছুড়ে মারত। আটকে পড়ত শান্ত, গোবেচারা ছেলেরা। দু–পক্ষের সংঘর্ষ যত ক্ষণ চলত, তারা লুকিয়ে থাকত কলেজের কোনও ক্লাসঘরে। পুলিশ এলে লড়াই থামত, তারা সাহস পেত বাড়ি যেতে। ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ পত্রিকার ১৮৬২–র ৩০ অগস্ট সংখ্যায় লেখা, ‘হিন্দু কালেজ ও সংস্কৃত কালেজের কতিপয় ছাত্র বিরোধী হইয়া পথিমধ্যে পরস্পর দাঙ্গা করিয়াছে।’ এই সংবাদেই জানা গেছে সংস্কৃত কলেজের ছেলেরা হেরে গেছে; হারের কারণ নাকি ‘হিন্দু কালেজের ছাত্রেরা তেজস্বী বিশেষতঃ ধনী ভাগ্যধর লোকের সন্তান।’

হিন্দু কলেজের ছাত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, দুই কলেজের মধ্যে প্রায়ই যে সংঘর্ষ হত তার জোরালো কোনও কারণ থাকত না, ‘বালকসুলভ চাপল্য মাত্র। তখনকার দিনে এ এক প্রকার ফ্যাশানের মধ্যেই পরিগণিত ছিল। কখনও কখনও এই দুই দলের লড়াইয়ে রক্তারক্তি ও মাথাফাটাফাটি পর্যন্ত হইত।’

আশ্চর্যের বিষয়, হিন্দু স্কুলের ইংরেজ হেডমাস্টারের কাছে এই নিয়ে নালিশ করতে যেত কেউ–কেউ, কিন্তু তিনি খুব একটা গ্রাহ্য করতেন না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর মশাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে–দাঁড়িয়ে দেখতেন কোন পক্ষ জেতে, কোন পক্ষ হারে।

দাঙ্গাবাজ ছাত্রদের পুলিশ এক বার থানায় নিয়ে গেলে বিদ্যাসাগরই ছুটেছিলেন তাদের ছাড়িয়ে আনতে। তবে ছাত্রদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না কখনও। এক বার তরুণ অধ্যাপক কালীচরণ ঘোষকে অপদস্থ করার অপরাধে একটা ক্লাসের সব ছাত্রকে তাড়িয়ে দিলেন বিদ্যাসাগর। ছাত্ররাও কম যায় না। তারা দল বেঁধে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগপত্র জমা দিল, সঙ্গে ধর্মঘটের হুমকি। কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরকে শো–কজ নোটিশ পাঠালে বিতাড়িত ছাত্রদের মহাফুর্তি— এ বার বিদ্যাসাগরের চাকরি যাবেই। কিন্তু বিদ্যাসাগর জানিয়ে দিলেন, এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষ তাঁর যুক্তি মেনে বহিষ্কৃত ছাত্রদের জানিয়ে দিলেন, এ–বিষয়ে বিদ্যাসাগর যা করবেন, তা-ই হবে।

শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, সংস্কৃত কলেজের ভিতরেও ছাত্রদের মধ্যে যথেষ্ট মারদাঙ্গা হত। এক বার সামান্য একটা ছোট কাঠের মই নিয়ে দু’টো ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে ভয়ানক মারামারি হয়েছিল যাতে শিবনাথ নিজেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। দাঙ্গার জেরে ছুটির পর কলেজের অধ্যক্ষ কাউয়েল সাহেব ছাত্রদের আটকে রেখে নিজে তদন্ত করেছিলেন। সে–যাত্রায় প্রত্যেক ছাত্রকে দু’টাকা করে জরিমানা গুনতে হয়েছিল।

হিন্দু কলেজের ভিতরেও ছাত্ররা মারদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ত প্রায়ই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন তাঁর স্মৃতিচারণায় আছে এমন এক ঘটনা। হিন্দু স্কুল তখন শ্যাম মল্লিকদের জোড়াসাঁকোর থামওয়ালা বাড়িতে কিছু দিনের জন্য স্থানান্তরিত হয়েছে। এক দিন টিফিনের ছুটিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, স্কুলের গণ্ডির মধ্যেই একটা লোককে পুলিশের এক কনস্টেবল থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর তাঁর বন্ধুরা পুলিশটিকে অনুরোধ করলেন তাকে ছেড়ে দিতে। কনস্টেবল সে কথা কানেই তুলছে না দেখে ইটের ঢিবি থেকে ইট তুলে ছুড়ে মারতে শুরু করলেন পুলিশটিকে তাক করে। প্রাণ বাঁচানোর দায়ে কনস্টেবল লোকটিকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল।

প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন সটক্লিফ। তিনি ছুটি নিলে অধ্যাপক ফ্লিন্ট অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতেন। এই ফ্লিন্টের উপরে ছাত্ররা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল। তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ কলেজের কিছু ছাত্র ফ্লিন্টের মাথার টুপি দিয়ে তাঁরই মুখ ঢেকে দিয়ে বেদম প্রহার করেছিল। টুপিতে মুখ ঢাকা ছিল বলে প্রহারকারী ছাত্রদের চিনতে পারেননি।

বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ। কলেজের দু’দল ছাত্রের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে। এক দল আর এক দলের পিছনে ভাড়া-করা গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। কলেজের এক দল ছাত্র সে দিন বাড়ি যেতে পারছে না, গুন্ডার ভয়ে কলেজেই বসে আছে।

সে দিন বিদ্যাসাগর অসুস্থ ছিলেন বলে কলেজে আসেননি। তবু তাঁর কানে এই সংবাদ পৌঁছে গেল। অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠলেন পালকিতে। কলেজে পৌঁছে প্রথম যে গুন্ডাকে সামনে পেলেন, তাকে ডাকলেন। পায়ের চটি হাতে নিয়ে বিদ্যাসাগর তাকে বললেন, ‘‘আমার কলেজের ছেলেদের তোরা মারবি? এত সাহস!’’ গুন্ডাটা উত্তর না দিয়ে বিদ্যাসাগরকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করেই দৌড়ে পালিয়ে গেল। দেখাদেখি অন্য গুন্ডারাও তার পিছু নিল।

আর একটি ঘটনা এই মেট্রোপলিটনেরই। সেখানকার ছাত্র জয়কৃষ্ণ সেনের নামে একটা অপ্রিয় মন্তব্য করেছেন সুপারিনটেনডেন্ট ব্রজনাথ দে। মন্তব্যটি শুনে জয়কৃষ্ণ রেগে অগ্নিশর্মা। দারোয়ানের ঘর থেকে এক খণ্ড জ্বলন্ত পোড়াকাঠ নিয়ে ব্রজনাথকে তাড়া করে গেল, বলতে লাগল, ‘‘আজ ষাঁড়দাগা করে ছাড়ব।’’ ব্রজনাথ সেই যাত্রায় দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।

১৮৬২ সালের শেষ দিকে মেডিক্যাল কলেজের বাংলা ক্লাসের দেড়শো জন ছাত্র একটি ঘটনায় একসঙ্গে কলেজ ত্যাগ করেছিল। প্রতিদিন সকালবেলায় তখন বাংলা ক্লাসের ডাক্তারি পড়ুয়াদের হাতে-কলমে ওষুধ ও পথ্যদানের পদ্ধতি শেখানো হত। এর জন্য ছাত্রদের চিকিৎসালয়ে হাজির থাকতে হত। বনমালী চট্টোপাধ্যায় নামে এক ছাত্র কাজটি করছিলেন, তখনই সেখানে এক পরিচারকের সঙ্গে তাঁর বচসা হয়। বনমালী চলে গেলে ওই পরিচারক প্রতিশোধ নিতে নামল। একটা কুইনাইনের পাত্র হাতে নিয়ে সোজা চলে গেল প্রিন্সিপাল লেক সাহেবের কাছে। বনমালী নাকি কুইনাইন চুরির জন্য এই পাত্র সরিয়ে রেখেছিল, কিন্তু যাওয়ার সময় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। বাংলা ক্লাসের ছেলেগুলোকে দু’চোখে দেখতে পারতেন না প্রিন্সিপাল। কার্য–কারণ অনুসন্ধান না করে, বাংলা ক্লাসের ছেলেগুলোকে চোর, বদমাশ ইত্যাদি গালাগাল দিয়ে সোজা পুলিশে জানালেন। পুলিশ অধ্যক্ষ ও পরিচারকের কথা শুনে বনমালীকে কুইনাইন চুরির অপরাধে দশ দিনের কারাদণ্ড দিয়ে দিল। সংবাদটি বিস্তারিতভাবে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার ২২ ডিসেম্বর ১৮৬২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

উত্তাল হয়ে গেল মেডিক্যাল কলেজের বাংলা ক্লাস। বিনা দোষে সহপাঠীর কারাবাস, প্রিন্সিপালের অশ্রাব্য গালিগালাজের প্রতিবাদে দেড়শো ছাত্র কলেজ ত্যাগের চিঠি জমা দিল। নেতৃত্বে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। প্রিন্সিপাল ছাত্রদের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে, সেই সঙ্গে মন্তব্য লিখে দিলেন, ‘ছাত্রেরা একজন চোরের সহিত সমদুঃখতা ও অবাধ্যতা প্রকাশ করিতেছে, অতএব তাহাদিগের নাম কাটিয়া দেওয়া হইল।’

বিজয়কৃষ্ণ সদলবলে বিদ্যাসাগরের কাছে গেলেন। পুরো ঘটনার বিবরণ শুনে উত্তেজিত বিদ্যাসাগর ছোটলাটকে সব জানালেন। তাঁরই হস্তক্ষেপে কর্তৃপক্ষ প্রিন্সিপালকে দোষী সাব্যস্ত করে ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করল।

মেডিক্যাল কলেজের মিলিটারি শ্রেণিতেও ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। ১৮৫০ সালের জুন মাসে। বেশ কিছু ছাত্র তাদের দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে কাজকর্ম, ক্লাস সব বন্ধ করে দিলে কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে তদন্তে নামেন এবং সাত জন ছাত্রকে ‘দুষ্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে দেন। ১৮৫২ সালে শিক্ষাবর্ষের শেষে মেডিক্যাল কলেজ পড়ুয়া কয়েক জন ছাত্র কলেজ চত্বরের বাইরের কিছু লোকের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। পুলিশকে এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং দশ জন ছাত্রকে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে বিচারের জন্য পেশ করা হয়। শাস্তি হিসেবে তাদের জরিমানা হলেও কলেজের সচিব এই গুরুতর বিষয়টির উপর তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠান শিক্ষা কাউন্সিলের কাছে। কাউন্সিল এই দশ জন ছাত্রকে (৬ জন বৃত্তিধারী এবং ৪ জন বিনা বেতনের) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে।

কলেজে পড়ার সময় গোরা সৈন্যদের সঙ্গে অনেক বার মারদাঙ্গা করেছেন রাধানাথ সিকদার। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে আছে। গোমাংস–প্রিয় রাধানাথ নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। বক্সিংও লড়তেন ভালো। অন্যায় আচরণ সহ্য করতে পারতেন না। প্রতিবাদ করলে অবধারিত দাঙ্গা শুরু হত। এক দিকে এক দল সাদা চামড়া, উলটো দিকে তিনি একা।

জিততেন অবশ্য রাধানাথই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE