Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তবে একলা

বাইশ-তেইশ বছর আগের কথা। পাহাড় চড়ার শখ, পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ে গেছি। মাঝে মাঝেই যাই। সে বার হঠাৎ বৃষ্টি। পাহাড়ের মাঝের ফাঁকা মন্দিরে আশ্রয়ের জন্যে ছুটে যাই। না, মন্দির ফাঁকা ছিল না। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এক সাধু।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অরিন্দম চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

বাইশ-তেইশ বছর আগের কথা। পাহাড় চড়ার শখ, পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ে গেছি। মাঝে মাঝেই যাই। সে বার হঠাৎ বৃষ্টি। পাহাড়ের মাঝের ফাঁকা মন্দিরে আশ্রয়ের জন্যে ছুটে যাই। না, মন্দির ফাঁকা ছিল না। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এক সাধু। সেই প্রথম পরিচয়, যদিও তা তেমন সুখের নয়। তার পর বহু বার দেখা, পরিচয় ক্রমশ নিবিড় হয়ে ওঠে। কত দিন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় কেটে গেছে সময়।

ধীরে ধীরে জয়চণ্ডী পাহাড় যাওয়া কমেছে। সাধুর অনুযোগ শুনে কত বার ভেবেছি, আরও বেশি করে আসব। হয়ে ওঠেনি।

আবার এক শীতার্ত বিকেলে জয়চণ্ডী পাহাড়ে পৌঁছলাম। অনেক দিন পর গেছি, মন উৎফুল্ল। চলতে চলতে পৌঁছই সেই মন্দিরে। বন্ধ। শুনশান প্রাঙ্গণে হাওয়ায় উড়ছে শীতের ঝরা পাতা। সাধুবাবা নেই। তাঁর পার্থিব পথ চলা সম্পূর্ণ হয়েছে।

পিছন থেকে হঠাৎ শুনি ভাঙা বাংলায় গান, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে... তাকিয়ে দেখি, সাদা পোশাক, কম্বল জড়ানো এক অল্পবয়সি সুদর্শন ব্রহ্মচারী। ভাঙা বাংলায় আলাপ শুরু হয়। পঞ্জাবি ছেলে। দার্জিলিঙের কনভেন্ট স্কুলে পড়ার সুবাদে ভাঙা বাংলা জানেন। দিল্লি থেকে এমএসসি করার পর ঘর ছেড়েছেন। পথে পথে খুঁজে চলেছেন জীবনের মানে। ইচ্ছে, এই শীতকালটা গঙ্গোত্রীতেই থাকবেন। একটা কুঠিয়া জোগাড় করেছেন। শীতকালীন পোশাক? কেন, গায়ের কম্বলটা তো আছে। তা ছাড়াও একটা সোয়েটার আছে। আর কী চাই! খাবারদাবার? অল্প কিছু পাওয়া গেছে। দিন পনেরো-কুড়ি কেটে যাবে। বলে কী! সামনে সুদীর্ঘ শীত। কিছু দিনের মধ্যেই বরফ পড়ে গঙ্গোত্রী উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কয়েক জন সন্ন্যাসী আর মন্দিরের চৌকিদার ছাড়া আর কেউ থাকবে না। তাঁকে অনেক বুঝিয়েও নিবৃত্ত করতে পারি না। শেষে কিছু গরম কাপড় আর সামান্য রসদ দিয়ে উদ্বিগ্ন মনে ফিরে আসি।

সেই গদ্দিওয়ালাকে মনে পড়ে, হাজার ভেড়-বকরি নিয়ে যে ঘর করছিল গভীর হিমালয়ের তৃণভূমিতে। এক শৃঙ্গাভিযানে অংশ নিয়ে পৌঁছেছিলাম সেখানে। অভিযানের মূল শিবির বলে সেখানে তখন অতি ব্যস্ততা। অভিযানের রসদ ও সরঞ্জাম পরবর্তী শিবিরে ফেরির কাজ চলছে। গদ্দিওয়ালাকে প্রস্তাব দেওয়া হল, কিছু রসদ প্রথম শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার। সে সাগ্রহে রাজি। আমার ওপর ভার পড়ল তাকে প্রথম শিবিরের পথ বুঝিয়ে দেওয়ার। সমস্ত পথটাই পাথর সাজিয়ে চিহ্নিত করা ছিল। তবু তাকে অনেক কিছু বোঝালাম। বললাম, গোটা পথটাই পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা, তাই শিবির পৌঁছতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। অনেক বুঝিয়ে তবে থামলাম। সে মাথা নিচু করে আমার নির্দেশ শুনছিল। আমি চুপ করার পর বিনীত ও মৃদু স্বরে উত্তর দিল, ‘ওহ পাত্থর ম্যায়নে লগায়া সাব।’

arindamchowdhury44@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

purulia temple Rabibashariya Arindam chowdhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE