মোহিনী: ১৯৮১ সালের ‘উমরাও জান’ ছবিতে রেখা
রাজস্থান আজ যা ভাবে, বারাণসীও ভাবে কাল! কল্পনার ভূত রাজপুতানা ছেড়ে এ বার বরুণা ও অসি নদীর শহরে।
বারাণসীর এক ক্লাবের কর্মকর্তারা সম্প্রতি সিগরা গোরস্থানের একটি কবরের উপরে পরিপাটি সমাধিসৌধ বানিয়ে দিয়েছেন। কবরে শুয়ে যিনি, ২৬ ডিসেম্বর দিনটা নাকি তাঁর মৃত্যুদিন। বিস্তর লোকজন এসে দর্শনও করে যাচ্ছে সে দিন থেকে। যে সে মানুষের তো নয়, নবাবি লখনউয়ের কিংবদন্তি ‘তওয়াইফ’ উমরাও জান-এর কবর বলে কথা!
উমরাও জান! মানে ১৯৮১ সালের বম্বেতে মুজাফফর আলির সেই কাল্ট ছবি যাঁকে নিয়ে তৈরি! রেখা, ফারুক শেখ, নাসিরুদ্দিন শাহ, রাজ বব্বর, শওকত কাইফির অভিনয়ধন্য সেই ছবি, খৈয়ামের সুর আর আশা ভোঁসলের আশ্চর্য কণ্ঠ যাকে অমরত্ব দিয়েছে। নাচে-গানে-প্রেমে আর সর্বোপরি ট্র্যাজেডিতে মাখামাখি যে জীবন বিশ শতকের মানুষের স্মৃতিতে করুণ, মৃদু এক আলো ছড়িয়েছে, উমরাও জান নামের সেই নারী সত্যিই ছিল তা হলে! কবর, সমাধিসৌধ, পুষ্পার্ঘ্য, মানুষের ঢল তো সত্য, সকলই সত্য!
তারও চেয়ে বেশি সত্য, মানুষের বিশ্বাস। কবিমানসের কল্পনাকে যা বানিয়ে তোলে রক্তমাংসের বাস্তব। ষোড়শ শতকের অমেঠীর প্রত্যন্ত গ্রামে বসে লেখা মালিক মহম্মদ জায়সির ‘পদ্মাবত’ কাব্যের রানি পদ্মাবতী যে কারণে আজকের ভারতে সত্য হয়ে উঠে জ্বালিয়ে দেয় বলিউডি ছবির সেট। জায়সি মুছে গেছেন, সত্য হয়ে উঠেছে কল্পনার পদ্মাবতী। একই ভাগ্য উমরাও জানের। সেও আদতে মির্জা মহম্মদ হাদি রুসওয়া নামের এক লেখকের উর্দু উপন্যাস ‘উমরাওজান-এ-আদা’-র চরিত্র। এতই সাড়া ফেলেছিল সেই চরিত্র, সমসময় আর ভবিষ্যৎ তাকে বানিয়ে দিল বাস্তব। লেখক রুসওয়া তলিয়ে গেছেন বিস্মৃতিতে, উমরাওজান রয়ে গেছেন ঠিক। তারই প্রমাণ এ কালে তাঁর কবর আবিষ্কার, সমাধিসৌধ রচনা, দর্শনার্থীর ভিড়।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের বছরে জন্ম লেখক-কবি মির্জা হাদি রুসওয়ার। জীবনকালে গোটা পাঁচেক বই লিখে গেছেন উর্দুতে, তারই একটা হল ‘উমরাওজান-এ-আদা’। ফৈজাবাদের গরিব ঘরের ছোট্ট এক মেয়ে আমিরন, ভাগ্যের ফেরে বিক্রি হয়ে যায় লখনউয়ের ‘কোঠা’য়, গণিকালয়ে। উনিশ শতকের লখনউয়ে সেই মেয়ে বড় হয়, ধ্রুপদী নাচে-গানে আর রঙ্গে-বিভঙ্গে ক্রমে সে-ই হয়ে ওঠে উমরাও জান, লখনউয়ের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত গণিকা। নবাব-সুলতানের সঙ্গে তাঁর প্রেম পরিণতি পায় না বেশ্যা-পরিচয়ের জন্য, আবার ভালবাসা আসে ফজল আলি নামের এক ছদ্মবেশী ডাকাতের হাত ধরে। ক্ষয়িষ্ণু নবাবি লখনউ, ব্রিটিশ সেনালাঞ্ছিত লখনউয়ের বিড়ম্বিত, ট্র্যাজিক জীবন ছেড়ে শেষ বয়সে স্বভূমি ফৈজাবাদে ফিরে আসে আমিরন তথা উমরাও জান।
এ সব যদি কল্পনাই হয়, তা হলে কবর এল কোথা থেকে? উত্তর খুব সম্ভবত লুকিয়ে আছে রুসওয়ার ন্যারেটিভেই। গোটা উপন্যাসটা উত্তম পুরুষে মেমোয়ার্স-এর ঢঙে লেখা, লেখক আপনমনে স্মৃতিচারণ করছেন। রুসওয়া লেখেন, আমার সঙ্গে অমুক সময়ে অমুকের বাড়িতে দেখা হয়েছিল উমরাওজানের, পরে সে আমার কাছে তার জীবনবৃত্তান্ত বলে। এই যে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার আঙ্গিক, তার মধ্যেই সাল-তারিখ, একটা ঐতিহাসিক শহরের রাস্তাঘাট দালানকোঠা মানুষজন শব্দগন্ধের রিয়্যালিজম বুনে দেওয়া— এই সবই হয়তো আম-মানুষকে বাধ্য করেছে বিশ্বাস করতে যে, উমরাওজান সত্য। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় রুসওয়ার উপন্যাস, ১৯৩১-এ মারা যান তিনি। তার পর দেশভাগ হয়েছে, কিন্তু কাঁটাতার ভাগ করতে পারেনি উমরাও জানের জনপ্রিয়তা। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশেই বহু বার রুপোলি পরদায় ঝলসে উঠেছে লখনউয়ের ভাগ্যবিড়ম্বিত এই নারীর জীবন।
আর কে না জানে, জনপ্রিয় শিল্প কল্পনাকেও বাস্তবের সিলমোহর দেয়! এত বছর ধরে এত চর্চা হয়েছে যাঁকে নিয়ে, সে কি সত্যি না হয়ে যায় তাই? তাই অকস্মাৎ আন-শহরে কোনও অজ্ঞাতকুলশীল সমাধির উপরে এক দিন আদর পড়ে, চাদর পড়ে। আর সৃষ্টির অমরত্ব প্রাপ্তিতে কোথাও যেন লেখকই জিতে যান অলক্ষে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy