Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দাদা অ-বাঙালি, দিদি কিন্তু বাঙালি

অক্সফোর্ডের নতুন ইংরেজি অভিধান সে রকমই জানাচ্ছে।  এমনকী  হিন্দি ‘অচ্ছা’ও  ঢুকেছে সেখানে। কিন্তু সাহেবদের মত, শব্দটি নাকি অব্যয়। ভাল গোছের বিশেষণ নয়। অচ্ছে দিন তা হলে বিলেতের  স্বীকৃতি পেল না! অক্সফোর্ডের নতুন ইংরেজি অভিধান সে রকমই জানাচ্ছে।  এমনকী  হিন্দি ‘অচ্ছা’ও  ঢুকেছে সেখানে। কিন্তু সাহেবদের মত, শব্দটি নাকি অব্যয়। ভাল গোছের বিশেষণ নয়। অচ্ছে দিন তা হলে বিলেতের  স্বীকৃতি পেল না! 

পলাশ বরন পাল
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রতি বছর, বছরে একাধিক বার, অক্সফোর্ডের অভিধান প্রণেতারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, নতুন কী কী শব্দের তাঁদের ইংরেজি অভিধানে স্থান পাওয়া উচিত। আজকাল আন্তর্জালের কল্যাণে তাঁদের সিদ্ধান্তের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানা যায়, কবে আবার অক্সফোর্ড অভিধানের নতুন সংস্করণ ছাপা হয়ে বেরবে, তার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় না। ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে নতুন শব্দের যে তালিকা তাঁরা প্রকাশ করেছেন তার খবর পেয়ে বাঙালিরা উল্লাসে ফেটে পড়েছেন। কারণ ‘দাদাগিরি’ এবং ‘দিদি’, এই দুটি শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে ইংরেজি ভাষার অভিধানে। ‘দাদা’ আর ‘দিদি’ দুটোই বাংলা ঘরোয়া শব্দ। তার উপর ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এক জন সার্বজনীন দিদি হয়েছেন। কিছু কাল আগেই হয়েছেন এক জন সার্বজনীন দাদা, যিনি এখন টেলিভিশনে ‘দাদাগিরি’ নামক অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন। অতএব খানদানি অভিধানে এই দুটি শব্দের অন্তর্ভুক্তিতে বাঙালি আহ্লাদে গদগদ হয়ে ভাবছে এ তো বাংলার জয়!

সুখবর আরও আছে, যদিও অতটা প্রচার পায়নি। ওই তালিকায় আছে ‘অচ্ছে’ শব্দটিও। বহু ভারতীয় এই শব্দটিকে বাংলা ভাষার নিশান মনে করেন। অর্থাৎ কোনও অচেনা ভাষা যদি কেউ বলে, এবং সেই বলার মধ্যে যদি ‘অচ্ছে’ শব্দটি বারংবার শুনতে পাওয়া যায়, তা হলে শ্রোতা বুঝে যান, নির্ঘাত বাংলা বলা হচ্ছে। এ শব্দটিও এখন ইংরেজি ভাষা মেনে নিল। গর্বে ছাতি ফুলবে না?

সঙ্গে খারাপ খবরও আছে। ‘দিদি’ শব্দটির অর্থ এবং ব্যুৎপত্তি আলোচনা করতে গিয়ে অক্সফোর্ডের অভিধান প্রণেতারা বলেছেন যে এটি ‘‘সম্ভবত হিন্দি’’। যদিও তার সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন যে কথাটা নেওয়া হয়েছে ‘‘from Bengali’’। অর্থাৎ শব্দটা বাংলার খাস তালুকে নয়, যদিও তাঁরা জেনেছেন বাংলা মারফত। ‘দাদাগিরি’-র বেলায় বাংলা ভাষার উল্লেখ নেই। সোজাসুজি বলা হয়েছে যে, শব্দটি হিন্দি। ‘অচ্ছে’ শব্দটি, তাঁরা বলেছেন, নেওয়া হয়েছে পঞ্জাবি ভাষা থেকে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে হিন্দি, পঞ্জাবি ইত্যাদি ভাষায় ‘আচ্ছা’ শব্দটি আছে বিশেষণ হিসেবে, যার মানে ‘ভাল’। এ থেকে বহুবচনে ‘আচ্ছে’ (হিন্দি বানানে ‘অচ্ছে’), যে শব্দটি ব্যবহার করে জনগণের কাছে ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি ফিরি করেন তাবড় রাজনীতিকরা। কিন্তু এই অর্থে শব্দটি স্থান পায়নি অক্সফোর্ড অভিধানে। সেখানে বলা হয়েছে, শব্দটি ‘interjection’, যে অভিধার সঙ্গে সঙ্গে মিলে যায় বাংলায় এই শব্দটির ব্যবহার। তবু অক্সফোর্ডের অভিধান সমিতি বলেছেন যে, শব্দটি তাঁরা পেয়েছেন পঞ্জাবি ভাষা থেকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও চরিত্র হলে বলত, ‘‘আচ্ছা শোনালে যা হোক!’’

‘দাদাগিরি’ শব্দটার বেলায় অবশ্য তাঁরা যা করেছেন তা নিয়ে খুব কিছু বলার নেই। এ শব্দের অর্থ মস্তানি বা হুমকিবাজি, এ সব কাজ যাঁরা নিয়মিত করে থাকেন তাঁদেরকে হিন্দিতে ‘দাদা’ বলা হয়। বাংলায় যে অর্থে আমরা ‘দাদা’ বলি, অর্থাৎ ‘বড় ভাই’, হিন্দিতে সেটা ‘ভাইয়া’। হিন্দির ‘দাদা’-র সঙ্গে ফার্সি প্রত্যয় ‘গিরি’ যোগ করে তৈরি হয়েছে যে শব্দটি, দু’দশকের পুরনো বাংলা অভিধানেও তার দেখা পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ডের পণ্ডিতেরা এই শব্দটির উৎস ধরেছেন হিন্দি, এতে কিছুই বলার নেই। ঠিকই হয়েছে। ‘দাদাগিরি’ শব্দটা বাংলাতেও এসেছে হিন্দি থেকে, ইংরেজিতেও এল সেই পথেই।

‘দাদা’-র অবশ্য আরও অর্থ আছে। হিন্দিতে ‘দাদা’ কথাটার প্রধান অর্থ যেটা, সেটা বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছিল ‘দাদামশায়’, এখন তার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘দাদু’-ই চলে। তার স্ত্রীলিঙ্গে ‘দিদিমা’, সেটার মধ্যে ‘দিদি’ শব্দের উপস্থিতি। দুই প্রজন্ম আগের মানুষজনের জন্য যে দুটি শব্দ বরাদ্দ ছিল সেগুলো এখন কী ভাবে নিজের প্রজন্মের বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য ব্যবহার করা শুরু হল, তা আমার জানা নেই।

এইটুকু বলতে পারি, শব্দগুলো খুব প্রাচীন নয়। কয়েক শতক আগের বাংলাতেও এ শব্দগুলো পাওয়া যায় না। কৃত্তিবাসী রামায়ণে লক্ষ্মণ কোথাও রামকে ‘দাদা’ ডেকেছে বলে মনে পড়ছে না। সংস্কৃতে একটিমাত্র শব্দ প্রয়োগে ‘জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা’ বোঝানো যায় না। ‘জ্যেষ্ঠা ভগ্নী’ বোঝানোরও কোনও শব্দ নেই। সুতরাং সংস্কৃত থেকে এ সব শব্দ আসেনি, অন্তত বর্তমান অর্থে আসেনি। যে সব প্রাচীন ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের ঐতিহাসিক আত্মীয়তা, তাদেরকে একসঙ্গে মিলিয়ে বলা হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর ইউরোপীয় প্রশাখার পাঁচ–ছ’টি ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, কোনওটিতেই ‘দাদা’ আর ‘ছোট ভাই’ বোঝানোর জন্য আলাদা শব্দ নেই, ‘দিদি’ আর ‘ছোট বোন’ বোঝানোর জন্যও নেই। অবশ্য এই গোষ্ঠীর বাইরে অন্য এমন ভাষা আছে যেখানে এই তফাত বোঝানো যায়, এবং না বোঝানোটা অশিষ্টতা বলে গণ্য হয়। একটি উদাহরণ হল কোরীয় ভাষা। আমি এ ভাষা জানি না, কিন্তু জানে এমন এক জনের কাছে খোঁজ নিলাম, সে বলল, সেখানে ব্যবস্থা নাকি আরও বিস্তারিত। ছোট ভাই যখন দাদাকে ডাকে তখন অন্য শব্দ, কিন্তু ছোট বোন যখন দাদাকে ডাকে তখন অন্য। দিদির জন্যও একই ব্যবস্থা। ভাইয়ের দিদি ও বোনের দিদি আলাদা দুটো শব্দ।

আধুনিক অন্য কিছু ভারতীয় ভাষাতেও ‘দাদা’ আর ‘দিদি’-সমার্থক শব্দ আছে। হিন্দিতে ‘দিদি’ আছে (হিন্দি বানান ‘দীদী’) সে কথা আগেই বলেছি। হিন্দির মতো পরিস্থিতি আরও কিছু ভাষাতেও। মনে আছে, বহু কাল আগে জীবনে প্রথম যখন মুম্বই গিয়েছিলাম, এক জন শুভাকাঙ্ক্ষী বলে দিয়েছিলেন, ‘খবরদার রাস্তাঘাটে কাউকে ‘দাদা একটু রাস্তা ছাডুন’ বলতে গেলে ‘দাদা’ কথাটার অনুবাদ করো না।’’ কারণটা তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন, ও শব্দটা দিয়ে সম্বোধন করলে অসম্মান করা হয় ওদের ভাষায়।

আমাদের ভাষায় ‘দাদা’ বা ‘দিদি’ কিন্তু সর্বদাই সম্মানের সম্বোধন। বাংলায় এই দুটো শব্দের অর্থের অসাধারণ ব্যাপ্তি ঘটেছে। শুধু সহোদর অগ্রজদের জন্য নয়, শব্দগুলো এখন আমরা যে কারও প্রতি শিষ্টতার সম্বোধন হিসেবে ব্যবহার করি। স্বল্পপরিচিত পুরুষকেও আমরা বলি, ‘‘দাদা কোথায় চললেন?’’ অপরিচিত মহিলাকেও জিজ্ঞেস করি, ‘‘দিদি এই বাসটা কি ধর্মতলা যাবে?’’

এবং সেই সঙ্গে এই দুটো শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ তৈরি হয়েছে বাংলায়, ‘দা’ আর ‘দি’। একাধিক সহোদরের মধ্যে বিশেষ কাউকে বোঝাতে গেলে এই হ্রস্ব রূপগুলোর ব্যবহার, যথা ‘বড়দি’ বা ‘মেজদা’। আত্মীয়তার সম্পর্কে যারা দাদা আর দিদি তাদের কথা বলতে গেলেও নামের সঙ্গে যোগ করা হয় শুধু এই ছোট রূপগুলো। তার পরেও আরও বিস্তৃত হয়েছে এই শব্দগুলোর ব্যবহারের পরিধি, যাঁরা পরিচিত কিন্তু আত্মীয় নন তাঁদের নামের সঙ্গে ‘দা’ বা ‘দি’ যোগ করে ডাকি আমরা। বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী, স্কুল-কলেজের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়া, খেলার সাথী বা পাড়া প্রতিবেশী, যারা বয়সে বড়, সবাই অমুকদা বা তমুকদা। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষককে এই ভাবে সম্বোধন করছে, এই চিত্র স্কুলে দেখা যায় না বটে, কিন্তু কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্চর্যের কিছু নয়। আমার চুলদাড়ি কি়ঞ্চিৎ পাকার পরে, নতুন ছাত্রছাত্রীরা আমাকে ‘পলাশদা’ বলে সম্বোধন করতে সংকোচবোধ করছে, কেননা বয়সে আমি তাদের বাবা-মায়ের কাছাকাছি বা হয়তো বড়। কিন্তু আগেকার ছাত্রছাত্রীরা সবাই আমাকে ওভাবেই ডাকে। আমি নিজেও এমন অনেককে ‘দা’ বা ‘দি’ বলে ডাকি যাঁরা বয়সে আমার বাবা-মা’র কাছাকাছি।

‘দাদা’ বা ‘দিদি’ শব্দ দুটো নিয়ে এইখানেই আমরা গর্ব করতে পারি। আগে কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য বলা হতো ‘অমুকবাবু’। পুরুষমানুষের জন্য এই ব্যবস্থা, মহিলাদের জন্য অনুরূপ কোনও শব্দ ছিল না। এখন ‘দা’ আর ‘দি’ ব্যবহারের একটা সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। উপরন্তু শব্দটা, ‘বাবু’-র মতো অত ভারী নয়। তাই আরও সহজে ব্যবহার করা যায়। অনেক বিদেশি ছাত্র ও অধ্যাপকও মুগ্ধ হয়েছেন আমাদের মধ্যে এই ডাক শুনে। এই মাধুর্যই আসল গর্ব বাংলার ‘দাদা’ আর ‘দিদি’ ডাকের, অক্সফোর্ডের পণ্ডিতেরা যা-ই বলুন না কেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE