আনন্দসন্ধ্যা: পুজোর অনুষ্ঠানে গান গাইছেন মান্না দে
সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনের কলকাতা!’ মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ছিলই না, এমনকি টিভিও এক-এক পাড়ায় সব বাড়িতে থাকত না। খবরের কাগজ, রেডিয়োর জমানাতে মনোরঞ্জনের পথ হাতে-গোনা ছিল। তখনও মানুষ যথেচ্ছ আনন্দ করেছে, উৎসব করেছে, শুধু পদ্ধতিগুলো আলাদা ছিল। তখন টিভিতে মহালয়া বলে কিছু বানাবার সাহস বা ইচ্ছে কোনওটাই ছিল না; সকাল থেকে দুপুর কোনও বিখ্যাত অভিনেত্রীর হাতে খুন হওয়ার জন্য অসুরকে অপেক্ষা করতে হত না। ভোরের আলো ফোটার আগেই অসুর নিধনের শুভবার্তা বেতারে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত আকাশবাণী কলকাতা। সেই সকালের সুপারস্টার দুজন— বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। দেশের বাড়ির মতো চিরকালের সত্য হয়ে রয়ে গেল আমাদের মহালয়া। ঘোষণা হয়ে যেত, পুজো এসে গেল। রাতারাতি শহর চনমনে হয়ে উঠত। আকাশটাও যেন হঠাৎ বদলে যেত।
আমি তখন স্কুলে। নরেন্দ্রপুর আশ্রমে থাকি। মহালয়াতেই সকালে পুজোর ছুটি পড়ত। দশটা বাজলেই বাড়ির লোক ছেলেদের নিতে আসতেন ঝাঁকে ঝাঁকে। যেন বায়না করাই ছিল, কর্মকর্তারা যার যার ঠাকুর মণ্ডপে নিয়ে যেতে এসেছে!
আমি বাড়ি ঢুকেই শারদীয়া বইপত্র দেখার আগে ‘শারদ অর্ঘ্য’ বইটা খুঁজতাম। এইচএমভি প্রতি বছর ছাপত এই বইটা। পুজোর গানের সব বৃত্তান্ত ছবি-সহ লেখা থাকত। বাড়তি পাওনা গানের কথাগুলো। মান্না দে-র ছবির নীচে, তাঁর সব ক’টি গানের কথা! লতা, আশা, হেমন্ত, শ্যামল, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্ধ্যা, আরতি, সব্বাই! চাঁদের হাট, গানের উৎসব। প্রত্যেক পুজোতেই ওই বইয়ে বাবার জন্য একটা পাতা বরাদ্দ থাকত। ‘সুনীল গাঙ্গুলি’-র ফ্যাশন আর অমিয় তরফদারের তোলা ছবি আমায় খুব গর্বিত করত। বাবা তো!
এই ‘শারদ অর্ঘ্য’ বাড়িতে আসা মানেই, বাবার বাড়িতে থাকার মেয়াদ কমে আসা। জলসা, ফাংশনের সিজ়ন শুরু মানেই বাবার দেশভর ভ্রমণ শুরু। পুজোতে বাবাকে কোনও দিনই পাইনি কারণ তুমুল ফাংশন শুরু হয়ে যেত।
এক দিকে পুজোর রেকর্ড বিক্রি হচ্ছে, সেই সব গানের অনুরোধ পৌঁছে যাচ্ছে জলসার মঞ্চে চিরকুট হয়ে। পাড়ায় পাড়ায়, অলিগলিতে সারা রাত ব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান। সন্ধে থেকে শুরু করে সকালে দুধওয়ালা, খবরের কাগজওয়ালা আসা অবধি চলত জলসা। হাজার হাজার মানুষ গান শুনছে, নাচ দেখছে, কৌতুকাভিনেতার মজায় হেসে লুটিয়ে পড়ছে। হলফ করে বলতে পারি, তখন ব্লাড প্রেশারের ওষুধ এত বিক্রি হত না, বা প্রয়োজনও হত না। এখন উল্টো— ছোটপর্দার কূটকচালি, অশান্তি আর মোবাইলের দৌরাত্ম্যে মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে! দৈনন্দিন কাজের ও সংসারের চাপের উপরে ওই বাড়তি কাল্পনিক চাপ, অবৈধতা মানুষের মনকে রোজ তিলে তিলে ক্ষয় করছে। আর তাই সিনেমাহল ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকল, গানের জলসা কমতে থাকল, আর সেই ভিড় গিয়ে ঢুকল ডাক্তারখানায়, ওষুধের দোকানে। পরনিন্দা, ঈর্ষার চর্চা মানুষকে ভোলাতে বসল স্বরলিপির দৈব আবেদন। কারও যেন মন ভালো নেই। তাই নতুন জামা গায়ে চাপিয়েও পুজো আসছে না ঠিক। শরতের আকাশ দেখার সময় নেই কারও হাতে। ঘাড় গোঁজা, মাথা নিচু করে থাকা এক অন্যমনস্ক মানবসভ্যতার জন্ম হচ্ছে। সেখানে পুজো একটা ছুটির কারণ মাত্র। তা হলে পুজোর গানের পরিস্থিতি কতটা দুর্বল সে তো বোঝাই যাচ্ছে।
নামী শিল্পীদের প্রশ্ন করলেও ব্যাপারটা বোঝা যাবে। সিডি, ডিভিডির দোকান বিলুপ্ত। বেসিক গান বা পুজোর গান বলে আর কিচ্ছু নেই। সব বন্ধ, সব শেষ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোটখাটো দু-একটা রিলিজ়! সিনেমায় প্লেব্যাক করে গান হিট না হলে কোনও গায়কের জীবনে বসন্ত আসছে না। মানুষের কাছে গান পৌঁছতে পারছেন না আমাদেরই প্রিয় শিল্পীরা। তাই কমে যাচ্ছে ফাংশন, মাচা। অর্ধেকেরও কম শো আসছে শিল্পীদের কাছে। এ কোন শহর! এ কোন বাংলা? নামীদের ছেড়েই দিন, কণ্ঠী-শিল্পীদের কষ্টটা ভাবুন! ছোট-মেজো পুজো কমিটির মানুষেরা, যাঁরা বিরাট খরচা করতে পারতেন না, তাঁদের ভগবান ছিলেন কিশোরকণ্ঠী গৌতম ঘোষের মতো গায়করা। তাঁরা আজ গভীর সঙ্কটে। মানুষ গান শুনছে না! শুনলেও মোবাইলে, কানে হেডফোন দিয়ে। জীবন্ত জলসার সামাজিক উৎসব রুগ্ন!
এই যন্ত্রণা, এই সব ভাবনা, প্রতিবাদ থেকেই জন্ম আমার নতুন ছবির, যার নাম ‘কিশোরকুমার জুনিয়র’। এক জন সাধারণ কিশোরকণ্ঠী গায়কের অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতার গল্প। আর সেই গল্প বলার অজুহাতে বড়পর্দার দর্শকদের পাঁচনের মতো মধু মিশিয়ে কুড়িটা কিশোরকুমারের গান শুনিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা। কারণ পুজোর সিনেমা আজও বেঁচে আছে। পুজোর গানের মতো বিপদসীমা অতিক্রম করেনি এখনও। তাই সিনেমা আর গানকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করলাম একসঙ্গে। সারা শহর জুড়ে কিশোরকুমারের গান, কুমার শানুর গান, বাবুলের গান বাজুক এ বার পুজোতে!
পুজোর গানের মতো সিনেমা রিলিজ়েরও বিরাট হিড়িক ছিল ছোটবেলায়। বাবা অনুষ্ঠান করতে যখন টানা বাইরে থাকতেন, তখন আমার মায়ের বান্ধবীরা এসে জুটত। বাবার অনুপস্থিতিতে মা’র তখন একমাত্র ভরসা উত্তমকুমার। উত্তম-সুচিত্রা, উত্তম-সুপ্রিয়া, উত্তম-সাবিত্রী... সামনে উত্তম থাকতেন আর পাশের নামটা বদলে বদলে যেত। দিনে দুটো সিনেমাও ওঁদের দেখতে শুনেছি। তার পর বাড়ি ফিরে সেই সব কাহিনির ন্যায়-অন্যায় আর মূল্যবোধ নিয়ে বান্ধবীদের তুমুল তর্কও হত। মজা পেতাম খুব। সেটাই ছিল পুজোর আনন্দ।
আনন্দ আজও আছে, প্রকরণ বদলে গিয়েছে। ‘কিশোরকুমার জুনিয়র’-এর শুটিংয়ে এক দিন বুম্বাদা বলছিলেন, একাধিক বার পুজোতে তাঁর তিনটে ছবিও একসঙ্গে রিলিজ় করেছে। আবার কালীপুজোতে আরও তিনটে। এ রকমও নাকি হয়েছে, ন’টা ছবি ঘটনাচক্রে একসঙ্গে চলছে! সিনেমা, জলসা, শারদীয়া পত্রপত্রিকা, সব মিলিয়েই তো বাঙালির নিজস্ব শারদ-সংস্কৃতি। তাই পুজোতে ঠাকুর দেখার পাশাপাশি সিনেমা দেখার চল আজও বহমান। এ বছরও ছয়-সাতটি সিনেমা একসঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে। অনেকের তা ঠাসাঠাসি ভিড় মনে হতে পারে। কিন্তু সত্য অন্যত্র। আগে অনেক বেশি সিনেমা-হল ছিল। আজ সেই সংখ্যা কমতে কমতে দুঃখজনক একটা জায়গায় পৌঁছেছে। তাই ছবি বাড়লেও পর্দা বাড়েনি। তবু আমার মতো সিনেমাওয়ালারা আজও আলাদা যত্ন, পরিকল্পনা নিয়ে পুজোর সিনেমার প্ল্যানিং করে। উৎসবকে চারপাশ থেকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার একটা প্রয়াস!
ফ্যাশন বদলের সময়ও কিন্তু চিরকালই পুজো। এই পুজোর ছবিতে নায়ক-নায়িকার পোশাক, জামা, কলার, প্যান্টের কাট, ঘের— সব নকল হত। মনে আছে, ‘মেহবুবা’ সিনেমার ডবল অ্যালবাম রেকর্ড বেরিয়েছিল সেই বছর। আমার এক দিদি সেই রেকর্ডের কভার নিয়ে দর্জির দোকানে গিয়েছিল, ঠিক ওই কাটিংয়ের পোশাক বানিয়ে নেওয়ার জন্য। হেমামালিনীর সেই পোশাকে আমার সেই দিদিকে হেমার থেকেও বেশি সুন্দর লেগেছিল সেই পুজোতে। পুজোর স্মৃতিতে এ ভাবেই গান আর সিনেমা মিলে গিয়ে অদ্ভুত একটা গ্রাফিক নভেল তৈরি হয়। তাই কোনও ভাবেই এই শারদোৎসবকে ‘কয়েকটা ছুটির দিন’ না ভাবাই ভাল।
উৎসবের চরিত্র একটা জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাসকে দুটোই প্রভাবিত করে। সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের অবদান এড়িয়ে ভাল থাকতে আমরা কোনও দিন পারব না। তাই গানবাজনা, টেলিভিশন, সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা ও মান দুটোই যদি সমানভাবে বাড়ে, আমাদের সত্যি অনেক সমস্যা মিটে যাবে। অস্থির সামাজিক অবস্থায় সংস্কৃতি একটা চিকিৎসার মতো। অডিয়ো-ভিস্যুয়াল যেমন খুব সহজে মনকে প্রভাবিত করে, তেমনই ‘মিউজ়িক থেরাপি’ আজ আমাদের রোজকার জীবনে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনি, নানান মানসিক চাপ, সম্পর্কের অদ্ভুত রংবদল, কদর্য বিশ্বাসঘাতকতা, অসৎ মানুষের সামাজিক দম্ভ, ব্যবসায়ীর কালচারাল মুখোশ, রাজনীতির অহিংসার স্ট্যাটুটারি ওয়ার্নিং-এর মাঝেই দেবী আসেন, এর মাঝেই থিম পুজোতে মানবিক মূল্যবোধের আয়োজন। সেখানে ছায়াছবি ও সঙ্গীতের সৎ আয়োজন গঙ্গাজলের মতো পবিত্র। উঠোনে দু’আঁজলা ছিটিয়ে দিলে যেন সত্যিই পবিত্র হয়ে যাবে বাড়ি। অন্তত মন তো তা-ই চায়। মনই তো পুজো করে, মনই তো সমাজ তৈরি করে, মনই তো সংস্কৃতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সেই মনের ডায়েট চার্টে সিনেমা, গানবাজনা থাকবে না, হয়?
তাই চিরকালের মতো পুজো জমে উঠুক সিনেমায়, গানে। ঠিক যেমনটা আগেও হত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy