চার দশক ধরে এই শহরের অলিগলি, বস্তি, ফুটপাতে ছিল জ্যাক প্রেগারের ছড়ানো সংসার।
ফোনটা তাঁকে দিতে গিয়েছিলেন পামেলা উইন। কিন্তু তিনি কথা বলতে নারাজ। শরীর একেবারেই ভাল নেই। এক ঘণ্টার মধ্যে নার্স আসবেন বাড়িতে পরিচর্যার জন্য। চিকিৎসকেরা চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তাই কারও সঙ্গেই তিনি কথা বলতে চাইছেন না। পামেলার বহু অনুরোধে ফোনটা ধরলেন। আর কলকাতার কথা শোনামাত্র তাঁর গলায় খুশির রেশ, বার্ধক্যের শ্রান্তি, ভাল-না-লাগার মধ্যেও । লন্ডনের সেই অনুরণন ফোনের এ-প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ল যেন। ৮৮ বছর বয়সি জ্যাক প্রেগার ফোনে বললেন, ‘‘কলকাতাতেই তো সারা জীবন কাজ করেছি। ভুলব কী করে?’’ একটু থেমে যোগ করলেন, ‘‘মিস করি কলকাতাকে!’’
চার দশক ধরে এই শহরের অলিগলি, বস্তি, ফুটপাতে ছিল তাঁর ছড়ানো সংসার। সমস্ত ফুটপাতবাসী যেন তাঁর আত্মজন। সেই কবে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন এই সাহেব। সঙ্গী শুধু নিজের মেডিক্যাল ব্যাগ আর ওষুধপত্র। শহরের সবচেয়ে ঘিঞ্জি, অপরিষ্কার, উন্নয়নের ছোঁয়া-না-পাওয়া বস্তি এলাকা— যা কিছুই এ শহর এড়িয়ে চলে, তাকেই এই ব্রিটিশ ডাক্তার আপন করে নিয়েছেন। অতি দরিদ্র, নিঃস্ব ফুটপাতবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা থেকে শুরু করে যক্ষ্মা, কুষ্ঠরোগের ওষুধ বিতরণ করেছেন বিনামূল্যে, পথশিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। এ শহরের অন্তত পাঁচ লক্ষ দুঃস্থ লোক, যাঁদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না, তাঁদের কোনও না কোনও ভাবে সাহায্য করেছেন। ‘ডক্টর জ্যাক’-এর দীর্ঘ দিনের বন্ধু পামেলা বললেন, ‘‘কলকাতাতেই তাঁর মন পড়ে থাকে আজও।’’
তিনি যে ডাক্তার হবেন, জ্যাক নিজেও কি তা জানতেন! ১৯৩০-এ ম্যাঞ্চেস্টারে জন্ম। অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনার পরে কার্ডিগানে নিজের খামারে প্রায় আট বছর চাষবাসের কাজ করেছেন। হঠাৎই ঠিক করলেন, ডাক্তার হবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিজের খামার বিক্রি করে দিয়ে ৩৫ বছর বয়সে মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন।
ডাক্তারি পাশ করার পরে প্রথমে গন্তব্য বাংলাদেশ। সদ্য-স্বাধীন দেশে চিকিৎসকের প্রয়োজন, রেডিয়োতে এমন আবেদন শুনে সেখানে পাড়ি দিলেন। সেখানে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে মানসিক ধাক্কা খেতে হল। চরম দারিদ্রের পরিবেশে মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকাটাই যেন বিলাসিতা। অন্য যে কেউ হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিত হয়তো, কিন্তু জ্যাক থেকে গেলেন। ধীরে ধীরে ফুটপাতবাসীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন। ১৯৭১-’৭৯ সাল পর্যন্ত টানা চিকিৎসা করলেন দরিদ্র, নিরন্ন মানুষদের।
তার মধ্যেই তিনি খোঁজ পেয়েছিলেন শিশুপাচার চক্রের। নিজের মতো করে তদন্তে নেমে দেখলেন, সরকারি লোকজনও জড়িত! বাংলাদেশ ছাড়তে হল এক দিন। তত দিনে বাংলা শিখে নিয়েছেন। জ্যাকের কথায়, ‘‘একটু-আধটু বাংলা বলতে পারি তখন। তাই কলকাতার চলে আসার কথা ভাবলাম।’’
অতঃপর ও-পার বাংলা থেকে এ বার গন্তব্য কলকাতা! হেস্টিংস, খিদিরপুর এলাকার বস্তি ও ফুটপাতের বাসিন্দাদের রোগ-অসুখের চিকিৎসা করে এ শহরের সঙ্গে আত্মীয়তার শুরু। প্রথম দিকে নিজে-নিজেই চলে যেতেন কোনও বস্তি এলাকায়। কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত রোগী, যাঁকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে তাঁর পরিবারের মানুষ, তাঁকে জড়িয়ে ধরে আধো-আধো বাংলায় বলতেন, ‘‘ভয় পাবে না। আমি আছি সঙ্গে।’’ আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকল। ঠিক করলেন, মিডলটন রো’তে একটি ক্লিনিক খুলবেন। সেই মতোই বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্লাস্টিক টাঙিয়ে তৈরি হল ক্লিনিক। রোগীদের ভিড়ও উপচে পড়ল। কিন্তু চিকিৎসা চালাতে গেলে তো অনেক অর্থের প্রয়োজন। ঠিক করলেন, রোগীদের চিকিৎসায় পথে ভিক্ষা করতে নামবেন। সংগঠনের ষাট জন কর্মী হাতে টিনের পাত্র নিয়ে শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভিক্ষাপর্ব ও চিকিৎসাপর্ব, একসঙ্গে চলল।
এর মধ্যেই বাধা এল। এ ভাবে ক্লিনিক চালানোর অনুমতি নেই! অভিযোগ এল, গ্রেফতারও হলেন জ্যাক। এমনকি আলিপুরে কিছু দিনের জন্য হাজতবাসও হল। জামিনে ছাড়া পেলেন, কিন্তু মামলা চলতে থাকল। জ্যাকের সাহায্যে এগিয়ে এলেন পর্বতারোহী এডমান্ড হিলারি। তাঁর হস্তক্ষেপে ন’বছর ধরে চলা মামলার নিষ্কৃতি হয়েছিল।
জ্যাকের তৈরি সংগঠনের সিইও জয়দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বিদেশের মাটিতে এ রকম একটি মামলা। নিজের অর্থের জোর নেই। এখানে চেনা কেউও নেই। তাঁর শুধু ছিল মনের জোর।’’ শেষ দিন পর্যন্ত সেই অদম্য মনের জোরেই কাজ করে গিয়েছেন তিনি। অশক্ত শরীর, দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়েও রোগী দেখতে গিয়েছেন ক্লিনিকে। সহকর্মীদের বলেছেন, ‘‘যত দিন বাঁচব, এই কাজ করে যাব।’’
কিন্তু শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। সম্প্রতি তিনি পাড়ি দিয়েছেন ইংল্যান্ডে। পামেলা বলছেন, ‘‘এখানে সারা দিন বিশ্রামেই আছেন। নিজের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গেও খুব একটা দেখা করতে চান না।’’
আর ফিরবেন না আপনার প্রিয় কলকাতায়? প্রশ্নটা শুনে কিছু ক্ষণ চুপ থাকলেন জ্যাক প্রেগার। তার পর বললেন, ‘‘এই শরীর নিয়ে আর যেতে পারব বলে মনে হয় না। তবে আমার মন কিন্তু কলকাতাতেই রয়েছে।’’ জ্যাকও জানেন, এই মহানগরের বহু অসহায়, প্রান্তবাসী মানুষের মনে তিনি আছেন। থাকবেনও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy